মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩৩ অপরাহ্ন

কেন বাংলাদেশের সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগছে?

  • Update Time : সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০২৫, ৪.৫৭ পিএম

সারাক্ষণ রিপোর্ট

সারাংশ

  • সুন্দরবনে প্রায় প্রতি বছরই শুকনো মৌসুমে আগুন লাগে
  • ২০২৪ সালের মে মাসের শুরুতে সুন্দরবনে আগুন লাগে, যা নেভাতে প্রায় চার দিন সময় লাগে
  • বন বিভাগে জনবল, বাজেট এবং যানবাহনের অভাবের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ে

এ মুহূর্তে সুন্দরবন আগুনে জ্বলছে। দুই দিন হলো এই আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি।২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের সুন্দরবনে আগুন লাগে, যা নিভাতে প্রায় চার দিন সময় লেগে যায়। এরপর স্থানীয় বাসিন্দারা সুন্দরবনের সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থাপনার দাবি জানান। এই ম্যানগ্রোভ বন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে এবং জীবিকার উৎস হিসেবেও কাজ করে।

আগুন কোথায় লেগেছিল

৫ মে ২০২৪, বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার আমরবুনিয়া গ্রামের কাছাকাছি পূর্ব সুন্দরবনে এই আগুন লাগে। স্থানীয়রা চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না, কারণ এই বন তাদের জন্য খুবই মূল্যবান — ২০০৭ সালে সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলা ঝড়ে এই বন বহু প্রাণ রক্ষা করেছিল। এছাড়া এখন মৌচাক সংগ্রহের মৌসুম হওয়ায় অনেকে বনে ছিলেন।

আগুনের পরিসংখ্যান

১৯৭০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সুন্দরবনে ৪১টি আগুনের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু ২০০২ থেকে ২০২৫ সালেই ঘটেছে ২৬ টি আগুন, যা আগুন লাগার হার বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। একইসাথে, পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এবং শুকনো জায়গা বেড়ে যাওয়ায় বনের আগুনের ঝুঁকি বাড়ছে।

বন বিভাগের সীমাবদ্ধতা

সুন্দরবনে প্রায় প্রতি বছরই শুকনো মৌসুমে আগুন লাগছে। ২০২৪ সালের  আগুনে প্রায় ১৩ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন বিভাগে জনবল, বাজেট এবং যানবাহনের অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সুপারিশগুলো ফাইলেই থেকে যায়।

ভারত বনাম বাংলাদেশ: ব্যবস্থাপনার তুলনা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অংশের সুন্দরবন আয়তনে ছোট হলেও সেখানকার ব্যবস্থাপনা ভালো। সেখানে বনের চারপাশে নাইলনের জাল দিয়ে ঘেরা হয় যাতে বাঘ গ্রামে না ঢুকে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘সুন্দরবন বিষয়ক দপ্তর’ নামে আলাদা একটি মন্ত্রণালয়ও গঠন করেছে।

বাংলাদেশেও অনেকবার নাইলনের জাল বসানোর সুপারিশ এলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বাঘ, কুমির এবং সাপের আক্রমণ এখানকার বাসিন্দাদের জন্য নিয়মিত ঘটনা। সুন্দরবনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয়ের দাবি থাকলেও এখনো তা গঠিত হয়নি।

কেন বারবার আগুন লাগছে?

পূর্ব সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়  , যেসব খাল গ্রাম থেকে বনে যেত, সেগুলো শুকিয়ে গেছে। এই অঞ্চল কিছুটা উঁচু হওয়ায় গ্রীষ্মে পুকুরগুলোও শুকিয়ে যায়। উত্তর প্রান্তের কাছাকাছি কাতাখালী থেকে দাসের ভরণী পর্যন্ত ২-৩ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশ উঁচু জমি হওয়ায় বর্ষা ছাড়া অন্য সময় পানি থাকে না।

উত্তরের খারমা নদীও মাটি দিয়ে ভরে গিয়ে খালে রূপ নিয়েছে। ভাটার সময় তা একেবারে শুকিয়ে যায় এবং শুধুমাত্র জোয়ারে ভোলা নদী থেকে কিছু পানি আসে। ফলে এ অঞ্চল খুব দ্রুত আগুনে পুড়ে যেতে পারে এবং বন বিভাগের জনবল কম থাকায় তা নিয়ন্ত্রণে আনাও কঠিন হয়ে পড়ে।

আগুনের কারণ ও তদন্ত

প্রত্যেকবার আগুন লাগার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আগের কমিটিগুলোতে দাবদাহ, অল্প বৃষ্টি ও খরার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এছাড়া মৌচাক সংগ্রাহকদের আগুন, জেলেদের ফেলা সিগারেট এবং বন অপরাধীদের প্রতিশোধমূলক আগুন লাগানোর কথাও উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুন্দরবনের বারবার আগুন লাগার প্রধান কারণই হচ্ছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা।

সর্বশেষ কমিটি ৪০ কিলোমিটার খাল এবং তিনটি পুকুর খননের পাশাপাশি, বন বিভাগে আরও জনবল নিয়োগ, বন প্রহরীদের টহল বাড়ানো, তিনটি নজরদারি টাওয়ার নির্মাণ, ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নাইলনের বেড়া তৈরি, নদীর পাশ ঘেঁষে একটি ফায়ার স্টেশন এবং ভোলা নদী খননের সুপারিশ করেছে।

সুন্দরবনের সুরক্ষায় করণীয়

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও কাঠ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, বনে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। বন, নৌপরিবহন ও নদী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় দরকার। খাল কাটার সময় যদি বনভূমি কাটা হয়, তবে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান জানান, প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণে সুন্দরবনে আগুন লাগার ঝুঁকি বেড়েছে। নদীগুলো মাটিতে ভরে যাচ্ছে, ফলে বন শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা বাড়ছে। জেলে বা মৌচাক সংগ্রাহকদের ফেলে দেওয়া সিগারেট থেকেও আগুন লাগতে পারে। আবার স্থানীয় দুষ্কৃতকারীরাও ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগাতে পারে।

তিনি বলেন, “শতবর্ষ পুরনো বন আইনের সংস্কার দরকার। প্রাকৃতিক বন যেন বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় জনগণকেও সুন্দরবন রক্ষায় সম্পৃক্ত করতে হবে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক নূর আলম শেখ বলেন, সুন্দরবনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই বন জোয়ারে ডুবে যায় আর ভাটায় ভেসে ওঠে। দিনে ও রাতে দুইবার বন জলমগ্ন হয়। কিন্তু যেখানে আগুন লাগছে, সেখানে এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থাপনা না থাকলে সুন্দরবন রক্ষা করা কঠিন হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024