১২:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

ধ্বংসই যেন এখন একমাত্র ভাষা

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যেমন সরাসরি সংঘর্ষ, তেমনি এর চারপাশে ছড়িয়ে আছে নানা গোষ্ঠী, মিত্র, শত্রু ও সংকটের বলয়। এই যুদ্ধে শুধু তেহরান বা তেল আবিব নয়, ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাসসহ আরও অনেক গোষ্ঠী। এর পাশাপাশি সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যকার জটিল সম্পর্ক এবং গাজার প্রতিদিনের ধ্বংসও এই সংঘাতকে আরও বিস্তৃত ও জটিল করে তুলেছে। কিন্তু একে একে দেখতে গেলে আমরা বুঝতে পারি—এই যুদ্ধ কেবল একটি সীমানার ওপর নয়, বরং এটি ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, এমনকি বিশ্ব রাজনীতির জটিল পটভূমিতে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী বহুদিন ধরেই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ইসরায়েলের বিরোধিতা করে আসছে। ইরান থেকে অস্ত্র ও অর্থসহ নানা সহযোগিতা তারা পেয়ে থাকে। ইরান যখন সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালায়, তখন হিজবুল্লাহও সীমান্তে সক্রিয় হয়ে ওঠে। লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে গোলাগুলি, রকেট নিক্ষেপসহ নানা হামলার দায় তারাই নেয়। এতে বোঝা যায়, ইরান নিজের দেশের সীমা না পেরিয়ে, মিত্রদের ব্যবহার করে এক বিস্তৃত ফ্রন্ট গড়ে তোলে। হিজবুল্লাহর সক্রিয়তা ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক হুমকি, কারণ তারা লেবাননের ভেতর থেকেই ইসরায়েলকে বিপাকে ফেলতে পারে। তাছাড়া হিজবুল্লাহর শক্তি ও ছদ্মবেশী যুদ্ধকৌশল ইসরায়েলকে স্থল যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করে, যা তাদের পক্ষে সবসময় সুবিধাজনক নয়।
এদিকে ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠীও ইরানঘনিষ্ঠ এবং সৌদি আরব ও ইসরায়েল দু’টিরই বিরোধী। হুথিরা ইরানের ইঙ্গিতে রেড সি ও আশপাশের সামুদ্রিক পথ ব্যবহার করে ইসরায়েলগামী জাহাজে হামলা চালায়, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। তারা বলছে, যতদিন গাজায় যুদ্ধ চলবে, তারা তাদের ‘সমুদ্র যুদ্ধ’ চালিয়ে যাবে। হুথিদের এই কৌশল ইসরায়েলের জন্য যেমন নতুন চাপ তৈরি করে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। অর্থাৎ ইরান তার মিত্রদের দিয়ে নানা দিক থেকে ইসরায়েলকে ব্যস্ত ও দুর্বল রাখার এক সমন্বিত কৌশল নিচ্ছে। হুথি ও হিজবুল্লাহর এই সক্রিয়তা যুদ্ধকে আর একটি দেশের যুদ্ধ রাখে না—এটা এক ধরনের অঞ্চলের যুদ্ধ হয়ে ওঠে।


এখন যদি আমরা গাজার দিকে তাকাই, তবে বোঝা যায়, আসল সংঘাতের আগুন কোথা থেকে জ্বলছে। গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই ইসরায়েল বলছে, তারা হামাসকে নির্মূল করতে চায়। কিন্তু বাস্তবে তা করতে গিয়ে পুরো গাজার অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ব্যবস্থা সব ধ্বংস। এমন পরিস্থিতিতে হামাসের মতো গোষ্ঠী শুধু অস্ত্রের শক্তিতে নয়, বরং জনমনে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠছে। ইরান এটাই চায়—গাজার ধ্বংস দেখে মুসলিম বিশ্বের মানুষ রুখে দাঁড়াক এবং তারা ইরানকে সমর্থন করুক। যদিও বাস্তবে তা ঘটে না, কারণ রাজনৈতিক স্বার্থ ও দ্বিধা মুসলিম দেশগুলোকে নিরব করে রাখে।
এই প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা চলছিল। এই আলোচনার মধ্যেই গাজার যুদ্ধ এবং ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ নতুন মাত্রা আনে। সৌদি আরব প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কিছু বলেনি, আবার একে স্বাভাবিকীকরণ আলোচনাও পুরোপুরি বাতিল করেনি। বরং তারা একটি কৌশলগত নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে। তারা চায় না, গাজার মানবিক বিপর্যয় তাদের কূটনৈতিক অভিযাত্রা বিঘ্নিত করুক, আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক করলে মুসলিম বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। ফলে সৌদি আরব একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থানে আছে, যেখানে তারা গাজা পরিস্থিতিতে ‘উদ্বেগ’ জানায়, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। আর ইরান সেই শূন্যস্থান কাজে লাগিয়ে বলছে, ‘আমরাই একমাত্র যাঁরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি।’


তবে ইরানের এই প্রতিরোধে একধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন, তারা এককভাবে অনেক কিছু বলছে, দেখাচ্ছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই প্রতিরোধ কি বাস্তবিক ফল দিতে পারছে? ইরানের অভ্যন্তরে অর্থনীতি দুর্বল, যুবসমাজের একাংশ সরকারবিরোধী, নারীর অধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপে আছে, উপরন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রপ্তানি খাত সংকটে। এই অবস্থায় যুদ্ধে সম্পৃক্ত থাকা তাদের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইরানের জনগণের মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে—গাজার মানুষের জন্য আমরা জীবন বাজি রাখব, অথচ নিজেদের দেশে ন্যূনতম জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে পারছি না?
এই অবস্থা আরও জটিল করে তোলে বিশ্ব রাজনীতির প্রতিক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিরক্ষা দেয়, অন্যদিকে সৌদি আরব ও আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তারা চায় না, ইরান বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠুক, আবার ইসরায়েলের কারণে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গও হারাতে চায় না। তাই আমেরিকা মুখে বলছে শান্তি চাই, কিন্তু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগও তৈরি করে দিচ্ছে। চীন ও রাশিয়া অন্যদিকে এই পরিস্থিতিকে নিজেদের জন্য কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখছে। চীন মধ্যস্থতা করতে চায়, কিন্তু শক্ত অবস্থান নেয় না। রাশিয়া প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করে, কিন্তু সামরিকভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না। অর্থাৎ সবারই কিছু বলার আছে, কিন্তু করবার মতো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
এই যুদ্ধে যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি হতাশা আসে, তা হলো মুসলিম বিশ্বের নিস্ক্রিয়তা। পঞ্চাশটিরও বেশি মুসলিম দেশ—কেউ এক কণ্ঠে কিছু বলতে পারে না। কোনো সামরিক জোট তৈরি হয় না, অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া হয় না, এমনকি বড় রাষ্ট্রগুলোর দূতও তলব করা হয় না। কেবল বিবৃতি, উদ্বেগ, এবং কিছু মিছিল—এই নিয়েই মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া সীমিত। এই অবস্থায় ইরান চাইলেও এককভাবে কিছু করতে পারে না। অথচ হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাসের মতো গোষ্ঠীরা যে সক্রিয়, তাও পুরো মুসলিম বিশ্বের সক্রিয়তার ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। কারণ রাষ্ট্র এবং গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য আছে।


সব মিলিয়ে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আমাদের একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়—মধ্যপ্রাচ্য এখন আর কেবল ধর্মীয় আবেগে গঠিত রাজনৈতিক অঞ্চল নয়, এটি হয়ে উঠেছে কৌশল, অর্থনীতি, আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের খেলার মাঠ। এখানে যুদ্ধে শুধু বোমা পড়ে না, পড়ে চিন্তা, নীতি, সম্পর্ক ও মর্যাদার ভিত্তিও। হিজবুল্লাহ বা হুথির অস্ত্র ইসরায়েলের বুক ছুঁতে পারে, কিন্তু তা যদি বড় কোনো কৌশলগত পরিবর্তন আনতে না পারে, তবে তা কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়ে থাকে। সৌদি আরব যদি মুখে মুসলিম ঐক্যের কথা বলে, আর বাস্তবে ইসরায়েলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে, তবে সেই ঐক্য কেবল কথার ফুলঝুরি হয়ে থাকে। আর ইরান যদি একা হয়ে এই প্রতিরোধ চালায়, তবে তা একসময় নিজের ঘরেও আগুন ধরাতে পারে।
তাই এই যুদ্ধ শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি এক আয়না, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র, গোষ্ঠী ও জনগণ নিজেদের মুখ দেখছে—কে সাহসী, কে সুবিধাবাদী, কে নিঃস্বার্থ, আর কে শুধু নীরব দর্শক। এই আয়নায় আমরা দেখতে পাচ্ছি মুসলিম বিশ্বের হতাশা, পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতা এবং সেইসঙ্গে এক নির্মম সত্য—ধ্বংসই যেন এখন একমাত্র ভাষা, যে ভাষা বোঝে সবাই, কিন্তু বুঝেও কেউ থামাতে চায় না।

লেখক:সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ধ্বংসই যেন এখন একমাত্র ভাষা

০৮:০০:৩৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যেমন সরাসরি সংঘর্ষ, তেমনি এর চারপাশে ছড়িয়ে আছে নানা গোষ্ঠী, মিত্র, শত্রু ও সংকটের বলয়। এই যুদ্ধে শুধু তেহরান বা তেল আবিব নয়, ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাসসহ আরও অনেক গোষ্ঠী। এর পাশাপাশি সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যকার জটিল সম্পর্ক এবং গাজার প্রতিদিনের ধ্বংসও এই সংঘাতকে আরও বিস্তৃত ও জটিল করে তুলেছে। কিন্তু একে একে দেখতে গেলে আমরা বুঝতে পারি—এই যুদ্ধ কেবল একটি সীমানার ওপর নয়, বরং এটি ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, এমনকি বিশ্ব রাজনীতির জটিল পটভূমিতে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী বহুদিন ধরেই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ইসরায়েলের বিরোধিতা করে আসছে। ইরান থেকে অস্ত্র ও অর্থসহ নানা সহযোগিতা তারা পেয়ে থাকে। ইরান যখন সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালায়, তখন হিজবুল্লাহও সীমান্তে সক্রিয় হয়ে ওঠে। লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে গোলাগুলি, রকেট নিক্ষেপসহ নানা হামলার দায় তারাই নেয়। এতে বোঝা যায়, ইরান নিজের দেশের সীমা না পেরিয়ে, মিত্রদের ব্যবহার করে এক বিস্তৃত ফ্রন্ট গড়ে তোলে। হিজবুল্লাহর সক্রিয়তা ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক হুমকি, কারণ তারা লেবাননের ভেতর থেকেই ইসরায়েলকে বিপাকে ফেলতে পারে। তাছাড়া হিজবুল্লাহর শক্তি ও ছদ্মবেশী যুদ্ধকৌশল ইসরায়েলকে স্থল যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করে, যা তাদের পক্ষে সবসময় সুবিধাজনক নয়।
এদিকে ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠীও ইরানঘনিষ্ঠ এবং সৌদি আরব ও ইসরায়েল দু’টিরই বিরোধী। হুথিরা ইরানের ইঙ্গিতে রেড সি ও আশপাশের সামুদ্রিক পথ ব্যবহার করে ইসরায়েলগামী জাহাজে হামলা চালায়, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। তারা বলছে, যতদিন গাজায় যুদ্ধ চলবে, তারা তাদের ‘সমুদ্র যুদ্ধ’ চালিয়ে যাবে। হুথিদের এই কৌশল ইসরায়েলের জন্য যেমন নতুন চাপ তৈরি করে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। অর্থাৎ ইরান তার মিত্রদের দিয়ে নানা দিক থেকে ইসরায়েলকে ব্যস্ত ও দুর্বল রাখার এক সমন্বিত কৌশল নিচ্ছে। হুথি ও হিজবুল্লাহর এই সক্রিয়তা যুদ্ধকে আর একটি দেশের যুদ্ধ রাখে না—এটা এক ধরনের অঞ্চলের যুদ্ধ হয়ে ওঠে।


এখন যদি আমরা গাজার দিকে তাকাই, তবে বোঝা যায়, আসল সংঘাতের আগুন কোথা থেকে জ্বলছে। গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই ইসরায়েল বলছে, তারা হামাসকে নির্মূল করতে চায়। কিন্তু বাস্তবে তা করতে গিয়ে পুরো গাজার অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ব্যবস্থা সব ধ্বংস। এমন পরিস্থিতিতে হামাসের মতো গোষ্ঠী শুধু অস্ত্রের শক্তিতে নয়, বরং জনমনে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠছে। ইরান এটাই চায়—গাজার ধ্বংস দেখে মুসলিম বিশ্বের মানুষ রুখে দাঁড়াক এবং তারা ইরানকে সমর্থন করুক। যদিও বাস্তবে তা ঘটে না, কারণ রাজনৈতিক স্বার্থ ও দ্বিধা মুসলিম দেশগুলোকে নিরব করে রাখে।
এই প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা চলছিল। এই আলোচনার মধ্যেই গাজার যুদ্ধ এবং ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ নতুন মাত্রা আনে। সৌদি আরব প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কিছু বলেনি, আবার একে স্বাভাবিকীকরণ আলোচনাও পুরোপুরি বাতিল করেনি। বরং তারা একটি কৌশলগত নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে। তারা চায় না, গাজার মানবিক বিপর্যয় তাদের কূটনৈতিক অভিযাত্রা বিঘ্নিত করুক, আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক করলে মুসলিম বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। ফলে সৌদি আরব একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থানে আছে, যেখানে তারা গাজা পরিস্থিতিতে ‘উদ্বেগ’ জানায়, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। আর ইরান সেই শূন্যস্থান কাজে লাগিয়ে বলছে, ‘আমরাই একমাত্র যাঁরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি।’


তবে ইরানের এই প্রতিরোধে একধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন, তারা এককভাবে অনেক কিছু বলছে, দেখাচ্ছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই প্রতিরোধ কি বাস্তবিক ফল দিতে পারছে? ইরানের অভ্যন্তরে অর্থনীতি দুর্বল, যুবসমাজের একাংশ সরকারবিরোধী, নারীর অধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপে আছে, উপরন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রপ্তানি খাত সংকটে। এই অবস্থায় যুদ্ধে সম্পৃক্ত থাকা তাদের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইরানের জনগণের মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে—গাজার মানুষের জন্য আমরা জীবন বাজি রাখব, অথচ নিজেদের দেশে ন্যূনতম জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে পারছি না?
এই অবস্থা আরও জটিল করে তোলে বিশ্ব রাজনীতির প্রতিক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিরক্ষা দেয়, অন্যদিকে সৌদি আরব ও আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তারা চায় না, ইরান বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠুক, আবার ইসরায়েলের কারণে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গও হারাতে চায় না। তাই আমেরিকা মুখে বলছে শান্তি চাই, কিন্তু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগও তৈরি করে দিচ্ছে। চীন ও রাশিয়া অন্যদিকে এই পরিস্থিতিকে নিজেদের জন্য কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখছে। চীন মধ্যস্থতা করতে চায়, কিন্তু শক্ত অবস্থান নেয় না। রাশিয়া প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করে, কিন্তু সামরিকভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না। অর্থাৎ সবারই কিছু বলার আছে, কিন্তু করবার মতো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
এই যুদ্ধে যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি হতাশা আসে, তা হলো মুসলিম বিশ্বের নিস্ক্রিয়তা। পঞ্চাশটিরও বেশি মুসলিম দেশ—কেউ এক কণ্ঠে কিছু বলতে পারে না। কোনো সামরিক জোট তৈরি হয় না, অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া হয় না, এমনকি বড় রাষ্ট্রগুলোর দূতও তলব করা হয় না। কেবল বিবৃতি, উদ্বেগ, এবং কিছু মিছিল—এই নিয়েই মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া সীমিত। এই অবস্থায় ইরান চাইলেও এককভাবে কিছু করতে পারে না। অথচ হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাসের মতো গোষ্ঠীরা যে সক্রিয়, তাও পুরো মুসলিম বিশ্বের সক্রিয়তার ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। কারণ রাষ্ট্র এবং গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য আছে।


সব মিলিয়ে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আমাদের একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়—মধ্যপ্রাচ্য এখন আর কেবল ধর্মীয় আবেগে গঠিত রাজনৈতিক অঞ্চল নয়, এটি হয়ে উঠেছে কৌশল, অর্থনীতি, আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের খেলার মাঠ। এখানে যুদ্ধে শুধু বোমা পড়ে না, পড়ে চিন্তা, নীতি, সম্পর্ক ও মর্যাদার ভিত্তিও। হিজবুল্লাহ বা হুথির অস্ত্র ইসরায়েলের বুক ছুঁতে পারে, কিন্তু তা যদি বড় কোনো কৌশলগত পরিবর্তন আনতে না পারে, তবে তা কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়ে থাকে। সৌদি আরব যদি মুখে মুসলিম ঐক্যের কথা বলে, আর বাস্তবে ইসরায়েলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে, তবে সেই ঐক্য কেবল কথার ফুলঝুরি হয়ে থাকে। আর ইরান যদি একা হয়ে এই প্রতিরোধ চালায়, তবে তা একসময় নিজের ঘরেও আগুন ধরাতে পারে।
তাই এই যুদ্ধ শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি এক আয়না, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র, গোষ্ঠী ও জনগণ নিজেদের মুখ দেখছে—কে সাহসী, কে সুবিধাবাদী, কে নিঃস্বার্থ, আর কে শুধু নীরব দর্শক। এই আয়নায় আমরা দেখতে পাচ্ছি মুসলিম বিশ্বের হতাশা, পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতা এবং সেইসঙ্গে এক নির্মম সত্য—ধ্বংসই যেন এখন একমাত্র ভাষা, যে ভাষা বোঝে সবাই, কিন্তু বুঝেও কেউ থামাতে চায় না।

লেখক:সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক