দুই বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’-কে রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে বেছে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২৩ সালে এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিলেন।
গাইতে হবে স্কুলে
১৯০৫ সালে যখন বাংলা উত্তাল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে, সেই সময়ে কবিগুরু এই গান লেখেন। গানের প্রথম ও শেষ দুই লাইন মিলিয়ে মোট চার লাইনকে রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। গানটির গাওয়ার সময় এক মিনিট।
জনপ্রিয় সেই গান ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ এবার গাইতে হবে প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অনুষ্ঠানে এই গান গাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এবার স্কুলের সঙ্গীত হিসেবে গানটি গাইতে হবে। জাতীয় সঙ্গীতের মতো মর্যাদা দিয়ে এই গান গাইতে বলা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীতগাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন গান গাওয়া হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্ব পায় জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়।

বঙ্গভঙ্গের পরে কেটে গিয়েছে ১২০ বছর। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এ রাজ্যে এখন বহু মানুষের বাস, যারা বাংলা ভাষাভাষী নন। অন্য রাজ্য থেকে এখানে এসে বসবাস করছেন। এছাড়া উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকা রয়েছে, যেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মানুষরা সংখ্যাগুরু। এই জায়গা থেকে প্রতিবাদের সুর শোনা যাচ্ছে।
দার্জিলিংয়ের স্কুলে এই নিয়ম কার্যকর হবে না বলে ঘোষণা করেছেন গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান অনীত থাপা। তার বক্তব্য, “দার্জিলিংয়ের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। এখানে প্রতিটি স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। সেই পরম্পরা বজায় রেখেই প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হবে।”
কোন গান গাওয়া হবে
অনেক স্কুলের নিজস্ব প্রার্থনা সঙ্গীত রয়েছে। অনেক জায়গায় জাতীয় সঙ্গীত ক্লাস শুরুর আগে গাওয়া হয়। কোথাও গাওয়া হয় এই দুটি গানই। এর সঙ্গে রাজ্য সঙ্গীত যুক্ত হওয়ায় কোন গানটি রাখা হবে, আর কোনটি বাদ দেওয়া হবে, নাকি তিনটি গাওয়া হবে কিনা, তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে।
সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত অনেক স্কুলে ইতিমধ্যে রাজ্য সঙ্গীত গাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। মিত্র ইনস্টিটিউশন মেইনের প্রধান শিক্ষক সায়ন্তন দাস ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত। এখন তার পরে রাজ্য সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠান প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে অন্য একটি গান আগে গাওয়া হত। সেটি এখন আর গাওয়া হয় না।
অনেক স্কুল এখনো সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেনি, কোন গান গাওয়া হবে। অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেস-এর সভাপতি হরিদাস ঘটক ডিডাব্লিউকে বলেন, “জাতীয় সঙ্গীত আমাদের কাছে গর্বের বিষয়। স্কুলে এই সঙ্গীত গাওয়া হয়। রাজ্য সরকার রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে কোনো গান গাইতে বলতেই পারেন। তবে এ ব্যাপারে স্কুলের পরিচালন সমিতি, শিক্ষকদের মতামত নেয়া দরকার সেক্ষেত্রে জাতীয় ও রাজ্য সঙ্গীত উভয়ই গাওয়া যেতে পারে। তবে জাতীয় সঙ্গীত বাদ দেয়া উচিত নয়। আমাদের স্কুলেও এখন বিষয়টা চূড়ান্ত হয়নি। রাজ্য সরকার এর আগে স্কুলের ইউনিফর্ম-এর রং নীল-সাদা করার নির্দেশ দিয়েছিল। আমরা আলোচনার পর ঠিক করেছি, আমাদের চিরাচরিত যে ইউনিফর্মের রং, তা বদল করা হবে না। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও একই ভাবে আমরা এগোব।”
সম্প্রতি অসমে রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কংগ্রেসের নেতা বিধুভূষণ দাস শ্রীভূমি এলাকার একটি সভায় এই গান গেয়েছেন বলে ভিডিয়ো ভাইরাল হয়, যার সত্যতা যাচাই করেনি ডিডাব্লিউ। রবীন্দ্রনাথের এই গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। অসম সরকারের বক্তব্য, বিদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়েছে। ভারতের মাটিতে এটা এক ধরনের দেশবিরোধী কাজ।
সঙ্গীত নিয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসুক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এটা অনেক শিক্ষক চাইছেন না।
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক, শিক্ষক কিঙ্কর অধিকারী ডিডাব্লিউকে বলেন, “অনুপ্রেরণাদায়ী গান অনেক রয়েছে। সব গানকে তো আমরা প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে জায়গা দিতে পারি না। আমাদের একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। গান গাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। একটা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে, তারপর আবার একটা রাজ্য সঙ্গীত গাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এই যে নিয়ম বেঁধে দেওয়া, এর মাধ্যমে একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ একটি গানের মাধ্যমে একটি বিশেষ চিন্তাধারা আরোপ করার চেষ্টা।”
কোনো ইতিবাচক বিষয়কে নিয়মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়? বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা চলার সময়ে এর প্রয়োজন আছে বলেও অনেকে মনে করছেন।
অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, “আমরা চাই কোনো বিভেদ রাজ্যে না থাকুক। রবীন্দ্রনাথ এটাকেই তার ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানে তুলে ধরেছিলেন। এই গানের কোনো শব্দ পরিবর্তন করা হলে, আমি তার তীব্র বিরোধিতা করব। কিন্তু সেটাকে অপরিবর্তিত রেখে যদি গাওয়া হয়, তার প্রতি আমার সমর্থন আছে।”
প্রবীণ শিল্পী ও সঙ্গীতের শিক্ষক শুভেন্দু মাইতি ডিডাব্লিউকে বলেন, “যে গানই গাওয়া হোক না কেন, সেটা ঠিকঠাক গাইতে হবে। নানা রকম কথাবার্তার মধ্যে এই ব্যাপারটি হারিয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ সুরে ও উচ্চারণে এই গান গাওয়ার শিক্ষা দিতে হবে স্কুলের ছেলেমেয়েদের।”
চাপিয়ে দেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গানকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা যদি কেউ বলেন, তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। যাতে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভালো হয়, সেটা চাপিয়ে দেয়াই হোক। এই গানটার মাধ্যমে তাদের জানানো হোক যে, ভারতে এমন একটা দিন এসেছিল এবং তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করেছিলেন। ভালো জিনিস যদি চাপিয়ে দেয়া হয়, আমরা সেই চাপিয়ে দেয়াকে সমর্থন করব।”
বিশেষ নিবিড় সমীক্ষার আবহে এই গানের গুরুত্ব বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, “এসআইআর-এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় ভেদাভেদের একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কোনো অধিকার নেই। তারা শুধু বৈধ নাগরিকদের ভোটার তালিকায় রাখতে পারে। কিন্তু বিষয়টা এমন জায়গায় চলে গিয়েছে যে, ধরেই নেয়া হচ্ছে যে, একটি ধর্মের কিছু মানুষ অবৈধভাবে বাস করছেন। এজন্য মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি হচ্ছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে যখন এই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথের গান হাতিয়ার হতে পারে।”
বিবিধের মধ্যে মিলনের যে আদর্শ ভারতে রয়েছে, তাকে রক্ষার জন্য জাতীয় সঙ্গীত সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী অস্ত্র বলে মনে করেন শিক্ষকদের একাংশ।
মিত্র ইনস্টিটিউশন মেইনের প্রধান শিক্ষক সায়ন্তন দাস ডিডাব্লিউকে বলেন, “একটা স্কুলে প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে কী গাওয়া হবে, সেটা রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে দিতে পারে। এটা তাদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এটার পিছনে যদি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে বিষয়টা অন্য দিকে চলে যাবে। প্রত্যেক স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। আমার প্রশ্ন, এই সঙ্গীতের মাধ্যমে কি দেশপ্রেম বা একাত্মবোধ গড়ে তোলা যাচ্ছে না? জাতীয়তাবোধের কথা মনে করতেই প্রতিদিন আমরা এই সঙ্গীত গাই। তাহলে জাতীয়তার বদলে কোনো একটা আঞ্চলিক বোধ জাগানোর দরকার আছে কি? জাতীয়তাবোধ আমাদের দেশকে এক রাখবে। এই ভাবনা জাগানোর জন্য শুধু আমাদের দেশ নয়, যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীতের বিকল্প নেই।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















