ইন্দো-প্যাসিফিক উত্তেজনা ও রাডার লকের ঝুঁকি
জাপান জানিয়েছে, দক্ষিণ দ্বীপ ওকিনাওয়ার নিকটবর্তী আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় চীনা নৌবাহিনীর একটি জে–১৫ যুদ্ধবিমান তাদের এফ–১৫ ফাইটার জেটের ওপর বারবার ফায়ার-কন্ট্রোল রাডার লক করেছে। চীনা বিমানটি বিমানবাহী রণতরী ‘লিয়াওনিং’ থেকে উড্ডয়ন করে শনিবার আলাদা দুই সময়ে জাপানি জেটগুলোর ওপর মোট প্রায় ৩৩ মিনিট রাডার ধরে রাখে বলে টোকিওর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি ঘটনাটিকে “চরম দুঃখজনক ও বিপজ্জনক আচরণ” আখ্যা দিয়ে বলেন, ফায়ার-কন্ট্রোল রাডার লক মানে সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রস্তুতি, যা লক্ষ্যবস্তু বিমানের জন্য সরাসরি হুমকি এবং ঝুঁকিপূর্ণ কৌশলগত বার্তা। জাপান চীনের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি করেছে, যদিও কোনো আকাশসীমা লঙ্ঘন বা শারীরিক ক্ষতির কথা তারা নিশ্চিত করেনি।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড মার্লেস টোকিও সফরে এসে জাপানের পাশে দাঁড়িয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ইনডো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যে কোনো সামরিক মুখোমুখি পরিস্থিতি পেশাদার ও নিরাপদ হতে হবে, নইলে ভুল বোঝাবুঝি থেকে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ে। এরই মধ্যে টোকিও–বেইজিং সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে, কারণ জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাইওয়ানের ওপর চীনা হামলা হলে জাপান সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে। চীনের কাছে এটি সরাসরি হুমকি হিসেবে ধরা পড়েছে, আর জাপানের জন্য এটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তা—তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। রাডার লক–ঘটনা সেই উত্তেজনাপূর্ণ প্রেক্ষাপটেই ঘটেছে, যা দুই দেশের সামরিক বাহিনীকে আরও স্নায়ুচাপে ঠেলে দিচ্ছে।
রাডার লককে ঘিরে বয়ান তৈরিতেও দুই দেশ ভিন্ন ছবি আঁকছে। জাপান বিস্তারিত সময়সূচি ও অবস্থান প্রকাশ করে দেখাচ্ছে, তাদের বিমানেরা নিরাপদ দূরত্ব থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল এবং কোনো উসকানিমূলক কৌশল নেয়নি। বিপরীতে, চীনা নৌবাহিনীর মুখপাত্র দাবি করেছেন, ঘোষিত প্রশিক্ষণের মাঝখানে জাপানি আত্মরক্ষা-বাহিনীর বিমানগুলো পরপর কাছে এসে “হয়রানি” করেছে এবং চীনের বৈধ মহড়াকে “কলঙ্কিত” করছে। বয়ানে এই ফারাকই প্রমাণ করে, দুই রাজধানীতে একই ঘটনার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন; প্রতিটি পক্ষ নিজের জনমত ও মিত্রদের সামনে শক্ত অবস্থান দেখাতে বাধ্য বোধ করছে। ফলে ভবিষ্যতে যদি আরও কাছে বা খারাপ আবহাওয়ায় একই ধরনের রাডার লক ঘটে, তখন ভুল হিসাবের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে—এটা নিয়েই বিশ্লেষকদের দুশ্চিন্তা।
জাপান ও অস্ট্রেলিয়া এই ঘটনাকে কেবল নিন্দা নয়, তাদের নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব গভীর করার একটি উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করছে। টোকিওতে বৈঠকে দুই মন্ত্রী একটি “কৌশলগত প্রতিরক্ষা সমন্বয় কাঠামো” তৈরির বিষয়ে একমত হন, যার আওতায় যৌথ মহড়া, সামুদ্রিক নজরদারি ও প্রযুক্তি সহযোগিতা আরও ঘনিষ্ঠ হবে। জাপান ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর অস্ট্রেলিয়াকে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে এবং দক্ষিণ–পশ্চিম দ্বীপমালায় সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, দুই দেশই আবার চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব থেকে সরে যেতে চায় না; তাই প্রতিটি কঠোর বিবৃতির পাশে “স্থিতিশীল সম্পর্ক” শব্দগুচ্ছ বারবার জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন নজর থাকবে, টোকিও ও বেইজিং কি কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে আকাশে আচরণবিধি নিয়ে নতুন করে কথা বলে, নাকি এই ধরনের রাডার লক–ঘটনাই ইন্দো-প্যাসিফিকের নতুন বাস্তবতায় পরিণত হয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















