সারাক্ষণ রিপোর্ট
মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের কাছাকাছি একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হানার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মাথায় সামরিক পরিচালিত স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য আবেদন জানায়। সাধারণত ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সামরিক সরকার এই ধরনের পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করলেও, এবার সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোকে সহায়তা করার আহ্বান জানান।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন, এবং মান্দালয়ের বিভিন্ন ভবন আংশিক বা পুরোপুরি ধসে পড়েছে। সামরিক সরকার কীভাবে এই বিপর্যয় সামাল দেবে এবং বিরোধী শিবিরের ভূমিকা কী হবে, সে নিয়েই এখন ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান
ভূমিকম্পের পরপরই সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন জানায়। তবে এখনো পর্যন্ত সংঘাত বন্ধে কোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়া হয়নি, যদিও সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।
পূর্বের সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা
২০০৮ সালে সাইক্লোন নার্গিসে প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সেই সময় সামরিক সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্য নিতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানায় এবং প্রতিবেশী দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সহায়তার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে। তাই অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, সামরিক সরকারগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে চায়।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য
এবারের ভূমিকম্পের ঠিক পরপরই মান্দালয়ের নিকটবর্তী সাগাইং অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে বিশ্বের যেকোনো দেশ ও সংস্থাকে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে বলেন। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পেলে সামরিক সরকার এই সহায়তাকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি অর্জনের একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
মানবিক সহায়তার চ্যালেঞ্জ
ভারত, চীন এবং জাতিসংঘ ইতোমধ্যে মিয়ানমারে সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই সাহায্য সাধারণ মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাবে কিনা। সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এখন দেশের অর্ধেকেরও কম অঞ্চলে দৃঢ়ভাবে রয়েছে, আর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলে।
বিরোধী শক্তি ও নাগরিক সুরক্ষা
২০২১ সালে ক্ষমতাচ্যুত সংসদ সদস্যদের দ্বারা গঠিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) দাবি করছে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ অঞ্চলই তাদের প্রভাবাধীন। এনইউজির প্রধানমন্ত্রী মান উইন খাইং থেট এক বার্তায় উল্লেখ করেন যে, ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণকে ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী বা বিশ্বাস নির্বিশেষে সাহায্য করা হবে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বা যৌথভাবে ত্রাণ বিতরণ করার মতো কোনো স্পষ্ট প্রস্তাব আসেনি।
পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ করণীয়
কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, সামরিক বাহিনীর ত্রাণ কার্যক্রমের বাইরে স্থানীয় গোষ্ঠী ও জনবাহিনীগুলোকে কাজ করার সুযোগ দিলে তবেই প্রকৃত সহায়তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে। অন্যথায় সামরিক সরকার এই পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা চালাতে পারে।
অন্যদিকে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত শুধু সরকারি নির্দেশ মেনে ত্রাণ বিতরণ না করে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সত্যিকারের মানুষের কাছে পৌঁছানোর নতুন পথ খোঁজা। ভৌগোলিক ও সামরিকভাবে দেশটি বিভক্ত থাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা অনেককে বঞ্চিত করতে পারে এবং সামরিক সরকারের ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উপসংহার
মিয়ানমারে সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্প মানবিক সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। সামরিক সরকার ও বিরোধী পক্ষ দুই পক্ষই আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইলেও বাস্তব শান্তি ও আস্থার কোনো দৃঢ় উদ্যোগ এখনো সামনে আসেনি। যথাযথভাবে ত্রাণ বিতরণ এবং সামরিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার মাধ্যমেই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা সম্ভব। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে বিরোধী পক্ষ ও সামরিক বাহিনী মিলিতভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে পারলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ অনেকাংশে কমতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।