০৬:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বন্ধ দরজা: উচ্চ পর্যায়ের ছবি তোলার সময় এখনো আসেনি

লন্ডনের নৈবেদ্য-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে পৌঁছেছিলেন—কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের কাছে সময় মিলল না। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, স্টারমার ‘রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও সূচি-সংকট’ দেখিয়ে বৈঠকে এগোতেই চাননি; সরকারি মুখপাত্র যোগ করেন, ‘এই মুহূর্তে আলোচনার পরিকল্পনা নেই’। দৃশ্যপটটি যতটা ব্যক্তিক, তার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ব্রিটেনের নীতিগত সিদ্ধান্ত—নির্বাচনসঞ্জাত, পূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত রাখবে।

এই অবস্থান ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সঙ্গতিপূর্ণ। ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)-এর ‘ওপেন পলিটিক্স বাংলাদেশ’ কর্মসূচির নথিতেই লেখা আছে—‘উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ করা এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনা’। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে দেওয়া যুক্তরাজ্যের ভাষণেও জোর দেওয়া হয়েছিল স্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার উপর। সোজা ভাষায় বললে, ব্রিটেন চাইছে—ভোটার-স্বীকৃত সরকার না এলে উচ্চ পর্যায়ের করমর্দনের ছবি তোলার সময় আসেনি।

বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আরেক দগদগে রাজনীতি। লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজি—সম্পর্কে বাংলাদেশের দুর্নীতি-তদন্তের খবরে আগে থেকেই দল-মহলে বিব্রতকর চাপ ছিল। দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিদ্দিক নিজেই যুক্তরাজ্যে ‘ভুল-বোঝাবুঝি’ মেটাতে ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী; অভিযোগগুলোকে তিনি রাজনৈতিক অপপ্রচার বলে উল্লেখ করেছেন। এমন সমীকরণে স্টারমারের পক্ষে প্রকাশ্য সাক্ষাৎ মানে হতো লেবার পার্টির ভেতরের বিভাজনে ঘি ঢালা।

তারও ওপরে আছে নিরাপত্তা-সমীকরণ। যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক ভ্রমণ-উপদেশে স্পষ্ট সতর্কবার্তা—বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি ‘সম্ভাব্য’; হামলা নির্দিষ্ট গন্তব্য চেনে না, যে-কোনো ভিড়ের জায়গায়ই হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়া-ভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলিও ২০২৫-এর প্রথম চার মাসে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে একাধিক সহিংস ঘটনার তথ্য যোগ করেছে, যা লন্ডনের কূটনীতি-নির্ধারকদের আরও সতর্ক করেছে।

এত সব কারণ মিলিয়ে যুক্তরাজ্যের কৌশল এখন ‘কারিগরি সম্পৃক্ততা’—অর্থাৎ আইনি-আর্থিক সহযোগিতা থাকবে, বিশেষ করে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার তদন্তে; কিন্তু সেই সহযোগিতা থাকবে আলো-ঝলমলে ক্যামেরার বাইরে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, তারা গণতন্ত্রের পুরোনো ধারার দেশ—অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রত্যেক ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচনই তাদের প্রকৃত মানদণ্ড।

ড. ইউনূস অবশ্য আজ বিকেলে বাকিংহাম প্যালেসে ‘কিং হারমনি পুরস্কার’ গ্রহণ করছেন; রাজকীয় এই আনুষ্ঠানিকতা তাঁকে আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা মর্যাদা এনে দিলেও, ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বন্ধ দরজা স্পষ্ট করে দিয়েছে—ব্রিটেনের স্বীকৃতি পেতে ঢাকার রাজপথেই আগে খুলতে হবে গণতান্ত্রিক দ্বার। আর ততক্ষণ পর্যন্ত লন্ডনের বিদ্রূপ-শীতল বাতাসে ভেসে থাকবে একটি অনুচ্চারিত বাক্য: ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই প্রমাণ করবে কার হাতে হাত মেলানো যায়।’

১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বন্ধ দরজা: উচ্চ পর্যায়ের ছবি তোলার সময় এখনো আসেনি

১২:২৪:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫

লন্ডনের নৈবেদ্য-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে পৌঁছেছিলেন—কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের কাছে সময় মিলল না। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, স্টারমার ‘রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও সূচি-সংকট’ দেখিয়ে বৈঠকে এগোতেই চাননি; সরকারি মুখপাত্র যোগ করেন, ‘এই মুহূর্তে আলোচনার পরিকল্পনা নেই’। দৃশ্যপটটি যতটা ব্যক্তিক, তার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ব্রিটেনের নীতিগত সিদ্ধান্ত—নির্বাচনসঞ্জাত, পূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত রাখবে।

এই অবস্থান ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সঙ্গতিপূর্ণ। ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)-এর ‘ওপেন পলিটিক্স বাংলাদেশ’ কর্মসূচির নথিতেই লেখা আছে—‘উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ করা এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনা’। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে দেওয়া যুক্তরাজ্যের ভাষণেও জোর দেওয়া হয়েছিল স্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার উপর। সোজা ভাষায় বললে, ব্রিটেন চাইছে—ভোটার-স্বীকৃত সরকার না এলে উচ্চ পর্যায়ের করমর্দনের ছবি তোলার সময় আসেনি।

বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আরেক দগদগে রাজনীতি। লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজি—সম্পর্কে বাংলাদেশের দুর্নীতি-তদন্তের খবরে আগে থেকেই দল-মহলে বিব্রতকর চাপ ছিল। দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিদ্দিক নিজেই যুক্তরাজ্যে ‘ভুল-বোঝাবুঝি’ মেটাতে ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী; অভিযোগগুলোকে তিনি রাজনৈতিক অপপ্রচার বলে উল্লেখ করেছেন। এমন সমীকরণে স্টারমারের পক্ষে প্রকাশ্য সাক্ষাৎ মানে হতো লেবার পার্টির ভেতরের বিভাজনে ঘি ঢালা।

তারও ওপরে আছে নিরাপত্তা-সমীকরণ। যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক ভ্রমণ-উপদেশে স্পষ্ট সতর্কবার্তা—বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি ‘সম্ভাব্য’; হামলা নির্দিষ্ট গন্তব্য চেনে না, যে-কোনো ভিড়ের জায়গায়ই হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়া-ভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলিও ২০২৫-এর প্রথম চার মাসে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে একাধিক সহিংস ঘটনার তথ্য যোগ করেছে, যা লন্ডনের কূটনীতি-নির্ধারকদের আরও সতর্ক করেছে।

এত সব কারণ মিলিয়ে যুক্তরাজ্যের কৌশল এখন ‘কারিগরি সম্পৃক্ততা’—অর্থাৎ আইনি-আর্থিক সহযোগিতা থাকবে, বিশেষ করে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার তদন্তে; কিন্তু সেই সহযোগিতা থাকবে আলো-ঝলমলে ক্যামেরার বাইরে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, তারা গণতন্ত্রের পুরোনো ধারার দেশ—অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রত্যেক ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচনই তাদের প্রকৃত মানদণ্ড।

ড. ইউনূস অবশ্য আজ বিকেলে বাকিংহাম প্যালেসে ‘কিং হারমনি পুরস্কার’ গ্রহণ করছেন; রাজকীয় এই আনুষ্ঠানিকতা তাঁকে আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা মর্যাদা এনে দিলেও, ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বন্ধ দরজা স্পষ্ট করে দিয়েছে—ব্রিটেনের স্বীকৃতি পেতে ঢাকার রাজপথেই আগে খুলতে হবে গণতান্ত্রিক দ্বার। আর ততক্ষণ পর্যন্ত লন্ডনের বিদ্রূপ-শীতল বাতাসে ভেসে থাকবে একটি অনুচ্চারিত বাক্য: ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই প্রমাণ করবে কার হাতে হাত মেলানো যায়।’