আফ্রিকার উপকূলীয় দেশগুলো বহু দশক ধরে মৎস্যসম্পদ রক্ষা ও উন্নয়নে মনোযোগ দেয়নি। তবে ‘নীল অর্থনীতি’ ধারণা স্পষ্ট হওয়ায় এখন নীতি-নির্ধারকেরা উৎপাদনশীলতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছেন। সমৃদ্ধ সামুদ্রিক পরিবেশকে কেন্দ্র করে আফ্রিকা নতুন এক অর্থনৈতিক যুগে প্রবেশ করছে।
উপকূলীয় সম্পদ: অবহেলা থেকে উদ্যোগে
আফ্রিকার উপকূলীয় জলসীমা মানুষকে হাজার বছর ধরে জীবিকা দিয়েছে; তবুও ছোট মৎস্যজীবীদের কাজকে গুরুত্ব দেয়নি বেশিরভাগ সরকার। কর-সংগ্রহ কঠিন হওয়ায় এসব পেশাজীবীর উন্নয়নও ছিল পিছিয়ে।
তবে এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সমুদ্র সুরক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে, আর আফ্রিকান ইউনিয়ন (এউ) ইতিমধ্যে ৩০টির বেশি দেশকে নীল অর্থনীতি কৌশল বানাতে সহায়তা করেছে।
নীল অর্থনীতি—সম্ভাবনার বিস্তার
নীল অর্থনীতি শুধু মাছ ধরা নয়; এতে পর্যটন, নদী-হ্রদের সম্পদ, সামুদ্রিক শক্তি, কার্বন সংরক্ষণ থেকে শুরু করে বায়োটেকনোলজি পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত। এউ এবং ইউএনডিপি যৌথ কর্মসূচিতে আগামী চার বছরে ৪০৫ বিলিয়ন ডলার আয় ও ৫৭ মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরি করার লক্ষ্য রয়েছে।
অসংখ্য নীতি থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকার বহু দেশ নিজেদের সমুদ্রসীমার ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখে না।
২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে আসে—বিশ্বে অবৈধ বা অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরায় অভিযুক্ত শিল্পোৎপাদনকারী জাহাজের অর্ধেকই থাকে আফ্রিকার জলে। বিদেশি কোম্পানিগুলো স্থানীয় পতাকা ব্যবহার করে বা যৌথ প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যক্রম চালিয়ে সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে যায়।
অতিরিক্ত মাছ ধরার ভয়াবহ প্রভাব
পশ্চিম আফ্রিকায় ছোট পেলাজিক মাছ অতিরিক্ত আহরণের ফলে স্থানীয় মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। ট্রলারগুলো বিশাল ঝাঁক ধরে ফেলায় স্থানীয় জেলেদের জালে আর বড় মাছ ধরা পড়ে না। প্রকৃতি পুনরুৎপাদনের সুযোগ না পেলে সামুদ্রিক সম্পদ দীর্ঘমেয়াদে হারিয়ে যাবে।
হাই সিজ চুক্তি: নতুন আশার দিগন্ত
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কার্যকর হতে যাওয়া হাই সিজ ট্রিটি (BBNJ) আফ্রিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তি আন্তর্জাতিক জলসীমায় সংরক্ষিত এলাকা গঠনের পথ সহজ করবে। এভাবে উচ্চ সমুদ্রের মাছ টেকসইভাবে বাড়বে এবং উপকূলবর্তী এলাকায় তা পৌঁছে স্থানীয় জেলেদের লাভ দেবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ‘আবালোবি’ দেখিয়েছে—ডেটা-ভিত্তিক পদ্ধতিতে ছোট জেলেদেরও টেকসই ও লাভজনক ব্যবসা সম্ভব। তারা ধরা মাছ, খরচ, আয়সহ সব তথ্য নথিবদ্ধ করে বাজারে ভালো দামে বিক্রি করতে পারছে।
এ প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ১০টির বেশি দেশে বিস্তৃত হয়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তায় মাছের গুরুত্ব
২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২.৫ বিলিয়নে। কেনিয়ার স্টার্ট-আপ ‘সামাকিং’ বলছে—মাছকে প্রধান প্রোটিনে পরিণত করাই ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায়।
স্থানীয় চাষে উৎপাদন বাড়লেও ঠান্ডা শৃঙ্খল (কোল্ড চেইন) ও অর্থায়নের সমস্যা বড় বাধা। ছয় মাসের চাষ-চক্র চালাতে অনেক কৃষকেরই টাকা নেই।
‘ওয়াভু’ নামের আরেক স্টার্ট-আপ সাধারণ হোয়াটসঅ্যাপ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষকদের প্রয়োজনীয় ইনপুট কম দামে দেয়। এআই-চালিত চ্যাটবট পরামর্শও দেয়।
স্ট্যানফোর্ড বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—অতিরিক্ত ঘনত্বে মাছ চাষে রোগ ছড়াতে পারে, তাই শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
উন্নত প্রজাতি ও কম পরিবেশগত প্রভাব
‘ওয়ার্ল্ডফিশ’ বহু বছর ধরে জেনেটিক উন্নয়নে কাজ করছে। তাদের তৈরি গিফট তেলাপিয়া প্রতিটি প্রজন্মে ১০% দ্রুত বাড়ে এবং কম খাদ্য লাগে।
মিশরের বাজারের জন্য তৈরি ‘আবাসা তেলাপিয়া’র পরিবেশগত প্রভাব প্রাকৃতিক জাতের তুলনায় ৩৬% কম।
অ্যাকুয়াকালচারে প্রতিবছরই আফ্রিকার অতিরিক্ত ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। ২০১৮ সালে সেশেলস প্রথম নীল বন্ড ইস্যু করলেও পুরো মহাদেশে টেকসই বিনিয়োগ এখনো কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সম্ভাবনা বিরাট, কিন্তু সচেতনতার অভাব ও নীতি দুর্বল হওয়ায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আসছে না।
সংরক্ষণ, কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আফ্রিকার নীল অর্থনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীতি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ হলেও পরিবর্তনের গতি স্পষ্ট—আর এই পরিবর্তন উপকূলীয় দেশগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
#আফ্রিকারনীলঅর্থনীতি #টেকসইমৎস্য #অ্যাকুয়াকালচার #সমুদ্রসম্পদ #খাদ্যনিরাপত্তা #আবালোবি #সামাকিং #ওয়ার্ল্ডফিশ #হাইসিজচুক্তি #মৎস্যখাতউন্নয়ন #নীলঅর্থনীতি #আফ্রিকাব্যবসা #পরিবেশসংরক্ষণ #জলবায়ুপদক্ষেপ #টেকসইউন্নয়ন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















