সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের ঘনিষ্ঠ সাবেক দুই সহচর – সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কামাল হাসান এবং কোটিপতি চাচাতো ভাই রামি মাখলুফ – এখন রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে নতুন করে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছেন। কোটি কোটি ডলার ঢালছেন আলাওয়ি সম্প্রদায়ের দশ–বিশ হাজার সম্ভাব্য যোদ্ধার পেছনে, লক্ষ্য শুধু একটি – উপকূলীয় এলাকায় নতুন উত্থান ঘটিয়ে প্রভাব ফিরিয়ে আনা এবং আলাওয়ি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ দখল করা। একই সঙ্গে তারা আসাদ শাসনের শেষ দিকে তৈরি করা উপকূলজুড়ে ১৪টি ভূগর্ভস্থ কমান্ড সেন্টার ও অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। নতুন সিরীয় সরকারও তাই তাদের ঠেকাতে মাঠে নামিয়েছে আরেক সাবেক আসাদ-ঘনিষ্ঠকে, যিনি এখন নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ঠেকানো দায়িত্বে নিয়োজিত মুখ।
শিরোনাম–সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, এই দ্বন্দ্ব এখন আর আসাদকে খুশি করা নিয়ে নয়; বরং কে তাঁকে প্রতিস্থাপন করবে এবং আলাওয়ি সমাজের নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে থাকবে, সেই লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।
নির্বাসনে আসাদ পরিবার আর ভাঙন
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাশার আল–আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। পরিবারের ঘনিষ্ঠ চারজনের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি এখন মূলত মস্কোয় দীর্ঘ নির্বাসন মেনে নিয়েছেন। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের অন্য শীর্ষ ব্যক্তিরা, বিশেষ করে ভাই মাহের আল–আসাদ, এই পরাজয় ও প্রভাব হারানো মেনে নিতে পারেননি।
সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল কামাল হাসান এবং কোটিপতি ব্যবসায়ী রামি মাখলুফ – দুজনই বছর ধরে আসাদের সবচেয়ে বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এখন তাঁরা উপকূলীয় সিরিয়া ও প্রতিবেশী লেবাননে আলাওয়ি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে আলাদা আলাদা সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তুলছেন। বিভিন্ন শাখা ও গোষ্ঠী মিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি সম্ভাব্য যোদ্ধার পেছনে অর্থ যাচ্ছে, যাতে তারা ভবিষ্যৎ ক্ষমতার সমীকরণে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়।
বাশারের ভাই মাহেরও মস্কোয় আছেন এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণে এখনো হাজার হাজার সাবেক সৈন্য আছে বলে মনে করা হয়। তবে তিনি এখনো অর্থ দেননি, কোনো সরাসরি নির্দেশও দেননি বলে আসাদ পরিবারের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছে।
উপকূলে গোপন কমান্ড রুম আর অস্ত্রভাণ্ডারের লড়াই
হাসান ও মাখলুফের অন্যতম বড় লক্ষ্য হচ্ছে উপকূলীয় সিরিয়ায় আলাওয়ি অধ্যুষিত এলাকায় আসাদ শাসনের শেষ দিকে গড়ে তোলা ১৪টি ভূগর্ভস্থ কমান্ড রুম এবং সেখানে রাখা অস্ত্র–গোলাবারুদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। দুজন সেনা কর্মকর্তা এবং এক আঞ্চলিক গভর্নর নিশ্চিত করেছেন, এসব গোপন ঘাঁটি বাস্তবেই আছে; রয়টার্স যে ছবিগুলো দেখেছে, তাতে সেগুলোর ভেতরের দৃশ্যও ধরা পড়েছে।
লাতাকিয়া প্রদেশের পাহাড়ি এলাকা ও উপকূলজুড়ে গড়ে ওঠা এই নেটওয়ার্ককে এক কমান্ডার তুলনা করেন “ট্রেজার আইল্যান্ডের” সঙ্গে – যেখানে পৌঁছানোর জন্য সব পক্ষই নৌকা হয়ে ছুটছে।
তারতুসের গভর্নর আহমেদ আল–শামি বলেন, নেটওয়ার্কটি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং বর্তমানে তা থেকে বড় কোনো হুমকি নেই। তাঁর দাবি, “মুক্তির পর থেকে এসব কেন্দ্র অনেকটাই অক্ষম হয়ে গেছে, এগুলো নিয়ে তেমন উদ্বেগের কারণ নেই।”

আলাওয়ি সমাজের নিয়ন্ত্রণের নতুন ক্ষমতার লড়াই
রাজনৈতিক গবেষক আনসার শাহহৌদ একে ব্যাখ্যা করেছেন পুরনো আসাদ শাসনের ক্ষমতার লড়াইয়ের নতুন অধ্যায় হিসেবে। তাঁর মতে, আগে যেখানে লক্ষ্য ছিল বাশারকে খুশি করা, সেখানে এখন লক্ষ্য – কে তাঁকে প্রতিস্থাপন করবে এবং আলাওয়ি সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কাদের হাতে থাকবে।
হাসান, যিনি একসময় বাশারের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন, দেশের ভেতরের কমান্ডার ও উপদেষ্টাদের কাছে নিরন্তর ফোন করছেন ও ভয়েস মেসেজ পাঠাচ্ছেন। এসব বার্তায় তিনি প্রভাব হারানোর ক্ষোভ ঝেড়ে, উপকূলীয় সিরিয়া – যেখানে আলাওয়িদের বড় অংশ এবং আসাদের পুরনো ক্ষমতাকেন্দ্র – সেখানে নিজস্ব শাসনব্যবস্থার মহাপরিকল্পনা তুলে ধরছেন।
অন্যদিকে আসাদের চাচাতো ভাই রামি মাখলুফ – যাঁর ব্যবসা সাম্রাজ্য একসময় গৃহযুদ্ধকালে আসাদ বাহিনীকে অর্থ জুগিয়েছিল – ক্ষমতার শেষ দিকে আত্মীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গৃহবন্দী হন। এখন মাখলুফ নিজেকে ধর্মীয়–মেসিয়াহসুলভ চরিত্র হিসেবে তুলে ধরছেন; তাঁর ভাষ্য, তিনি নাকি এক মহাপ্রলয়ের যুদ্ধের পর আবার ক্ষমতায় ফিরবেন।
মস্কোয় বসে ভাঙা সিরিয়া নিয়ে নতুন ছক
মস্কোয় নির্বাসিত অবস্থান থেকেই হাসান ও মাখলুফ দুজনেই কল্পনা করছেন ভাঙা–টুকরো সিরিয়ার ভবিষ্যৎ মানচিত্র। দুজনেরই চোখ আলাওয়ি-অধ্যুষিত এলাকা দখলের দিকে। তাঁদের ঘনিষ্ঠ ডেপুটিরা রাশিয়া, লেবানন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঘাঁটি বানিয়ে অর্থ ও সমর্থন জোগাড়ের কাজ করছেন।
এই দুজনকে ঠেকাতে সিরিয়ার নতুন সরকার নামিয়েছে একসময়কার আরেক আসাদঘনিষ্ঠকে – আহমেদ আল–শারার শৈশব–বন্ধু খালেদ আল–আহমাদকে। একসময় তিনি আসাদের হয়ে বড় একটি আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন, পরে গৃহযুদ্ধের মাঝপথে আসাদের বিরুদ্ধে চলে গিয়ে শারার শিবিরে যোগ দেন। এখন তাঁর দায়িত্ব – সাবেক আলাওয়ি সৈন্য ও সাধারণ মানুষকে বোঝানো যে তাদের ভবিষ্যৎ এই নতুন সিরিয়ার সঙ্গেই জড়ানো, মস্কোয় থাকা পুরনো শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নয়।
রয়টার্সের অনুসন্ধান বলছে, এ নিয়ে সরাসরি তথ্য থাকা ৪৮ জনের সাক্ষ্য, আর্থিক নথি, পরিকল্পনামূলক ডকুমেন্ট এবং ভয়েস ও টেক্সট বার্তার আদান–প্রদানের ওপর ভিত্তি করে পুরো চিত্রটি আঁকা হয়েছে। সবাই নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
নতুন সরকারের উদ্বেগ ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন
তারতুসের গভর্নর আল–শামি জানাচ্ছেন, সরকারের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিদ্রোহের এই পরিকল্পনার সারাংশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তা ঠেকানোর মতো প্রস্তুতি আছে। যদিও তিনি কমান্ড রুম নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেই দাবি করেছেন, এটি এখন আগের মতো শক্তিশালী নয়।
লেবাননের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের দেশ কোনো ধরনের অবৈধ অর্থ প্রবাহের জন্য ভূখণ্ড ব্যবহার হতে দেবে না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো বর্তমানে সমর্থন দিচ্ছে নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারাকে – যিনি একসময় আল–কায়েদার কমান্ডার ছিলেন এবং প্রায় ১৪ বছরের রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পর গত বছর বাশারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় এসেছেন। ফলে উপকূলে নতুন কোনো বিদ্রোহ শুরু হলে তা শুধু নতুন সরকারকে অস্থিতিশীল করবে না, বরং আবারও ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা জ্বালিয়ে দিতে পারে।

তবে বাস্তবে এখনই বড় ধরনের সফল বিদ্রোহের সম্ভাবনা খুব কম বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। প্রধান দুই ষড়যন্ত্রকারী হাসান ও মাখলুফ পরস্পরের সঙ্গে তীব্র বিরোধে জড়ানো; রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ার আশা ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে; সিরিয়ার ভেতরে বহু আলাওয়ি, যারা আসাদ শাসনের সময়ও বিপুল দুঃখ–কষ্ট ভোগ করেছেন, তাঁরা দুজনের ওপরই ভরসা করছেন না; আর নতুন সরকারও তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে সচেষ্ট।
সরকারের পক্ষ থেকে আলাওয়ি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগে দায়িত্বপ্রাপ্ত খালেদ আল–আহমাদ সংক্ষিপ্ত এক বিবৃতিতে বলেছেন, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উপড়ে ফেলা এবং নিহতদের যথাযথ সম্মান জানিয়ে “আরেকটি এমন সিরিয়া তৈরি করা, যে নিজের সঙ্গে আবার সহাবস্থান করতে পারবে” – শুধু এ পথই দেশের সামনে খোলা।
সংখ্যার খেলায় হাসান ও মাখলুফ
আভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, কামাল হাসানের দাবি তাঁর নিয়ন্ত্রণে ১২ হাজার যোদ্ধা রয়েছে; অন্যদিকে রামি মাখলুফের শিবির দাবি করছে, অন্তত ৫৪ হাজার যোদ্ধা তাদের সঙ্গে আছে। মাঠপর্যায়ের কমান্ডাররা বলছেন, বাস্তবে যোদ্ধারা খুব কম অর্থ পাচ্ছেন এবং অনেকে দুই পক্ষের কাছ থেকেই টাকা নিচ্ছেন।
এখন পর্যন্ত এই নির্বাসিত গোষ্ঠীগুলো তাদের যোদ্ধাদের কোনো সরাসরি সামরিক অভিযানে নামাননি। রয়টার্স যোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা বা নির্দিষ্ট সামরিক পরিকল্পনা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। তারতুসের গভর্নর আল–শামির ধারণা, সম্ভাব্য যোদ্ধার সংখ্যা কয়েক দশক হাজারের মধ্যে।
যারা পরিকল্পনার কাছাকাছি আছেন, তাঁদের কথায় জানা যায় – সবাই বুঝেছেন, যদি তারা নতুন সুন্নি–প্রধান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংঘাতে নামে, তাহলে লাখো সিরীয় আলাওয়ি ভয়াবহ প্রতিশোধের মুখে পড়তে পারেন। গৃহযুদ্ধ–পরবর্তী এই নতুন সরকার এক বছর আগে ক্ষমতায় এসেছে, দীর্ঘ ১৪ বছরের সংঘাতে দেশ জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি হয়েছে, তার ক্ষত এখনো সেরে ওঠেনি।
মার্চের গণহত্যা ও আলাওয়িদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ
২০২৫ সালের মার্চে উপকূলীয় আলাওয়ি অধ্যুষিত এক শহরে ব্যর্থ এক বিদ্রোহের পর সরকারপন্থী বাহিনীর অভিযানে প্রায় এক হাজার পাঁচশো সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন ছোট–বড় হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে উপকূলীয় এলাকায়। হাসান এবং মাখলুফ দুজনেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁরা নাকি এই অনিরাপত্তা থেকে আলাওয়িদের রক্ষা করবেন।
২৫ নভেম্বর, হোমস ও উপকূলীয় কয়েকটি শহরে হাজারো আলাওয়ি রাস্তায় নেমে আসে। তাঁরা অধিক স্বায়ত্তশাসন, আটক ব্যক্তিদের মুক্তি এবং অপহৃত নারীদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। আসাদ পতনের পর সিরিয়ায় এটিই ছিল প্রথম বড় আকারের জনসমাবেশ।
এই বিক্ষোভের পেছনে ছিলেন না মাখলুফ বা হাসান; ঘটনাটির নেতৃত্ব দেন এক আলেম, যিনি দুজনের বিরোধী এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আহ্বান জানান। পরদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাখলুফ ওই আলেমকে আক্রমণ করে পোস্ট লেখেন – “এ সব আন্দোলন এখন শুধু বিপর্যয় ডেকে আনবে, সময় এখনো আসেনি।”
হাসানের শীর্ষ সামরিক সমন্বয়কদের একজন রয়টার্সকে বলেন, “যুদ্ধ ছাড়া আমাদের মর্যাদা ফেরানো যাবে না।” তাঁর ভাষায়, “এখনো আমাদের জাতি থেকে যত লোক মারা গেছে, সেটাই সৌভাগ্য। হয়তো আরও হাজারো মানুষ মরবে, কিন্তু আলাওয়ি সমাজকে নিজেদের রক্ষায় ‘কোরবানি’ দিতে হবে।”
ভূগর্ভস্থ কমান্ড রুম: ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’
২০২৫ সালের জানুয়ারির নথি অনুযায়ী, তখনো আসাদপন্থী বাহিনী ৫ হাজার ৭৮০ জনকে নিয়ে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করেছিল, যাদের সরঞ্জাম ও অস্ত্র এসব ভূগর্ভস্থ কমান্ড রুম থেকে সরবরাহ করার কথা ছিল। বড় বড় স্টোররুমের মতো এসব জায়গায় রয়েছে অস্ত্রভাণ্ডার, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা, ইন্টারনেট সংযোগ, জিপিএস ডিভাইস ও ওয়াকি–টকি।
পরিকল্পনাটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি, আর উপকূলজুড়ে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়ানো কমান্ড রুমগুলো এখনো কার্যক্ষম থাকলেও মূলত নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে বলে দুই প্রত্যক্ষদর্শী এবং ছবিতে দেখা তথ্য থেকে ধারণা পাওয়া যায়।
একটি ছবিতে দেখা যায়, পাঁচটি কাঠের বাক্স স্তূপ করে রাখা; তিনটি খোলা, ভেতরে একেএ–৪৭ রাইফেল, গুলি ও হাতবোমা। ঘরে আরও আছে তিনটি ডেস্কটপ কম্পিউটার, দুটি ট্যাবলেট, কয়েকটি ওয়াকি–টকি ও একটি বড় পাওয়ার ব্যাংক; মাঝখানে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখা বড় মানচিত্র।
কমান্ড রুমগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করেও গভর্নর আল–শামি বলেন, মুক্তির পর এসব অনেক দুর্বল হয়ে গেছে এবং এখন এ থেকে বড় কোনো হুমকি তিনি দেখছেন না।
মার্চের বিদ্রোহ: টার্নিং পয়েন্ট
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশারের পতনের সময় বহু জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ও উচ্চপদস্থ আমলা বিদেশে পালিয়ে যান। কিন্তু অনেক মাঝারি পর্যায়ের কমান্ডার সিরিয়াতেই থেকে উপকূলীয় আলাওয়ি অধ্যুষিত এলাকায় আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁরা নতুন করে যোদ্ধা সংগ্রহে নামেন।
এক অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডারের ভাষায়, “সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র ছিল সেনাবাহিনী। হাজার হাজার আলাওয়ি তরুণ জোর করে সেনাবাহিনীতে টেনে নেওয়া হয়েছিল; ডিসেম্বরের পর সেই বাহিনী ভেঙে যায়, আর তারা হঠাৎ নিজেকে উন্মুক্ত ও অসহায় অবস্থায় দেখতে পায়।”
তারপর আসে ৬ মার্চের ব্যর্থ বিদ্রোহ। নতুন সিরীয় সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর লাতাকিয়ার গ্রামাঞ্চলে এক আলাওয়ি ইউনিট আকস্মিক হামলা চালায়; এতে ১২ জন নিহত হয়, ১৫০–এর বেশি সদস্যকে আটক করা হয়। পরের সংঘর্ষে সরকারি পক্ষের শত শত সদস্য নিহত হয় বলে নতুন সরকার দাবি করে – যা প্রো–আসাদ যোদ্ধারাও মোটামুটি মেনে নেয়। সংশ্লিষ্ট এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের হিসাব, ওই বিদ্রোহে ১২৮ জন আসাদপন্থী যোদ্ধা মারা যায়। প্রতিশোধমূলক অভিযানে নিহত হয় প্রায় এক হাজার পাঁচশো আলাওয়ি।
অফিসারদের ভাষ্যে, এই বিদ্রোহ সরাসরি নেতৃত্ব দেননি কামাল হাসান বা রামি মাখলুফ; কিন্তু সেই কয়েক দিনই ছিল তাঁদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। এরপর থেকেই তাঁরা সংগঠিত হওয়ার কাজটা গতি দেন।
রামি মাখলুফ: ‘কোস্ট বয়’ ও কিয়ামতের ভবিষ্যদ্বাণী
৯ মার্চ মাখলুফ নিজেকে “কোস্ট বয়” বা উপকূলের ছেলে বলে পরিচিত করে এক বিবৃতি দেন; দাবি করেন, আলাওয়িদের সাহায্য করার জন্য ঈশ্বর তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি ফিরে এসেছি, আর এই ফিরে আসা বরকতময়।” কোথাও উল্লেখ করেননি, তিনি আসলে মস্কোয় নির্বাসনে।
দুই দশকের বেশি সময় সিরিয়ার অর্থনীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছেন মাখলুফ। ব্রিটিশ সরকারের অনুমান অনুযায়ী, টেলিযোগাযোগ, নির্মাণ, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তিনি ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের পুরো সময় সিরীয় সেনা ও মিত্র মিলিশিয়াদের বড় অর্থজোগানদাতা ছিলেন।
২০১৯ সালের দিকে যুদ্ধজয়ে আসাদ প্রায় নিশ্চিত বলে মনে হলে মাখলুফ প্রকাশ্যে সেই কৃতিত্বের বড় অংশ নিজে দাবি করেন। এর পরপরই আসাদ তাঁর ব্যবসা সাম্রাজ্য বাজেয়াপ্ত করে, রাষ্ট্রের কাছে দেনা আছে এই অভিযোগে, এবং তাকে দীর্ঘ সময় গৃহবন্দী রাখে।
২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর, দামেস্ক পতনের রাতে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে করে লেবাননে পালিয়ে যান। তাঁর ভাই এহাব একই রাতে মাসেরাতি গাড়িতে পালাতে গিয়ে সীমান্তের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং সঙ্গে থাকা মিলিয়ন ডলার নগদ ছিনতাই হয় – পরিবারের ঘনিষ্ঠ চারজন ও এক কাস্টমস কর্মকর্তার কথায় এমন বর্ণনা মিললেও, স্বাধীনভাবে তা যাচাই করা যায়নি।
বর্তমানে মাখলুফ মস্কোর এক বিলাসবহুল র্যাডিসন হোটেলের একটি পুরো ফ্লোর দখল করে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে থাকেন। ঘনিষ্ঠদের মতে, গৃহবন্দিত্বের সময় তিনি গভীরভাবে ধর্মমুখী হয়ে ওঠেন; সেই সময়েই ইসলামি কাহিনি ও ব্যাখ্যা নিয়ে তিন খন্ডের একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
ফেসবুক পোস্ট ও হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় মাখলুফ নিজেকে এক শিয়া কিয়ামতের ভবিষ্যদ্বাণীর “মেসিয়াহ–সদৃশ” চরিত্র হিসেবে দেখান – যে নাকি দামেস্কের এক মহাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে। তাঁর নিজের ব্যাখ্যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই নাকি সেই মহাপ্রলয় আসবে। নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারাকে তিনি প্রকাশ্যে বলেন “আল সুলফিয়ানি” – সে–ই নাকি ওই ভবিষ্যদ্বাণীর প্রধান খলনায়ক, যার সেনাবাহিনীকে শেষ পর্যন্ত পৃথিবী গিলে খাবে।
লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও রাশিয়ায় থাকা বিশ্বস্ত ব্যবসা–সহযোগীদের মাধ্যমে মাখলুফ আলাওয়ি অফিসারদের কাছে বেতন ও সরঞ্জাম কেনার জন্য অর্থ পাঠাচ্ছেন বলে আর্থিক নথি ও বেতনের তালিকায় দেখা যায়।
মস্কোয় তাঁর পাশে ফিরে গেছেন সিরীয় সেনাবাহিনীর দুই সাবেক মেজর জেনারেল – সুহায়েল হাসান ও কাহতান খলিল। তাদের মাধ্যমে মাখলুফ দাবি করছেন, ৮০টি ব্যাটালিয়ন ও বিভিন্ন গ্রুপ মিলিয়ে ৫৪ হাজার ৫৩ জন যোদ্ধা তাঁর ডাকে প্রস্তুত; এর মধ্যে ১৮ হাজারই অফিসার। হোমস, হামা, তারতুস ও লাতাকিয়া শহর–এলাকাজুড়ে এই নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। তবে আসাদ সরকারের পতনের পর বহু সাধারণ সৈন্যই অস্ত্র নামিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
মাখলুফের এক আর্থিক ব্যবস্থাপকের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অন্তত ৬ মিলিয়ন ডলার তিনি বেতনে খরচ করেছেন। শুধুমাত্র মে মাসেই প্রায় ৯ লাখ ৭৬ হাজার ডলার বিভিন্ন ইউনিটে গেছে, আর আগস্টে ৫ হাজার যোদ্ধার একটি গ্রুপ পেয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
মাঠের পাঁচ কমান্ডার জানিয়েছেন, তাঁরা মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার যোদ্ধার নেতৃত্ব দিচ্ছেন; তবে যোদ্ধাদের হাতে মাসে যা যাচ্ছে, তা মাত্র ২০–৩০ ডলারের মতো। তাঁদের ভাষায়, “মাখলুফ টুকরো টাকায় আনুগত্য কিনতে চাইছেন।” একই সঙ্গে তারা স্বীকার করেছেন, মাখলুফ এবং কামাল হাসান – দুজনের কাছ থেকেই তারা অর্থ নিচ্ছেন, এতে নৈতিক কোনো সমস্যা দেখছেন না।
এক স্থানীয় কমান্ডারের মন্তব্য, “বছরের পর বছর এরা আমাদের রক্ত চুষে খেয়েছে। এখন তাদের টাকা থেকে একটু ফেরত নিলে সমস্যা কোথায়?”
কামাল হাসান: কারাগার, কবরগোপন আর সাইবার হামলা
জাতিসংঘের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আসাদ শাসনের কুখ্যাত সামরিক কারাগার ব্যবস্থার প্রধান ছিলেন কামাল হাসান – যেখানে বন্দিদের পরিবার থেকে বৃহৎ পরিসরে চাঁদা আদায় করা হতো। রয়টার্সের আগের এক অনুসন্ধানে বের হয়, ২০১৮ সালে হাজার হাজার লাশের একটি গণকবর সরিয়ে দামেস্কের বাইরে দুহুমাইর মরুভূমিতে লুকিয়ে রাখার প্রস্তাবও তিনিই দিয়েছিলেন, যাতে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ গোপন থাকে।
আসাদের বাহিনী ভেঙে পড়ার পর প্রথমে তিনি আশ্রয় নেন দামেস্কে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাসে, তারপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রায় দুই সপ্তাহ রুশ দূতাবাসে থাকেন। ঘনিষ্ঠদের মতে, ছোট একটি কক্ষে মাত্র একটি শক্ত কাঠের চেয়ারে বসে থাকতে হওয়ায় তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। এক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় হাসান রসিকতা–মেশানো ক্ষোভে বলেন, “কামাল হাসান কাঠের চেয়ারে বসে দিন কাটানোর লোক নন!”
অবশেষে তিনি মস্কোর উপকণ্ঠে তিনতলা একটি ভিলায় স্থায়ীভাবে উঠে যান। সেখানে গ্রীষ্মে গিয়ে দেখা এক অফিসারের ভাষায়, তিনি এখনো বাশারের ভাই মাহেরের সঙ্গে দেখা করেন, আর রুশ নিরাপত্তা মহলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগযোগ আছে।
লেবাননে থাকা তাঁর অপারেশন সমন্বয়কের হিসেবে, মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার যোদ্ধার পেছনে তিনি খরচ করেছেন ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে শুধু লেবাননে থাকা ৮০ অফিসারের কাছে ২ লাখ ডলার নগদ পাঠানো হয়।
এ বছর মাঝামাঝি “ডেভেলপমেন্ট অব ওয়েস্টার্ন সিরিয়া” নামের একটি সংগঠন ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে জানান দেয়, তারা পশ্চিম সিরিয়ায় মানবিক সহায়তা দেবে; অর্থ এসেছে “সিরীয় নাগরিক মেজর জেনারেল কামাল হাসানের” কাছ থেকে। তিন অফিসার ও এক ব্যবস্থাপক জানান, এটি আসলে আলাওয়ি সমাজে প্রভাব গড়ার আড়াল – মানবিক কাজের মোড়কে অর্থ বিলিয়ে আনুগত্য তৈরি করা।
আগস্টে সংগঠনটি ৪০ আলাওয়ি পরিবারকে আশ্রয় দিতে ৮০ হাজার ডলার ব্যয় করেছে বলে ঘোষণা দেয়।
একই সঙ্গে গ্রীষ্মে তিনি তাঁর পুরনো সামরিক গোয়েন্দা ইউনিটের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩০ জন হ্যাকারকে আবার জড়ো করেন। লক্ষ্য – নতুন সরকারের কম্পিউটার সিস্টেমে সাইবার হামলা, ম্যালওয়্যার বসানো এবং সংবেদনশীল ডাটাবেজ চুরি।
এক কম্পিউটার প্রকৌশলীর বর্ণনায়, সেপ্টেম্বরে এসে যোগাযোগ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি সরকারি ডাটাবেজ অন্ধকার ওয়েবে ১৫০ থেকে ৫০০ ডলারের বিনিময়ে বিক্রির জন্য দেখা গেছে। তাঁর দাবি, “মেজর জেনারেল কামাল বুঝেন, যুদ্ধ শুধু মাটিতে হয় না; সব ফ্রন্টেই লড়াই চালাতে হয়।”
হোয়াটসঅ্যাপে কমান্ডারদের দেওয়া এক বার্তায় হাসানের আহ্বান – “ধৈর্য ধরো আমার লোকজন, অস্ত্র জমা দিও না। আমি সেই মানুষ, যে তোমাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবে।”
অন্য আসাদ: মাহের আল–আসাদ
সম্ভাব্য বিদ্রোহে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন বাশারের ছোট ভাই মাহের আল–আসাদ। তাঁর নিয়ন্ত্রণেই ছিল সিরীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ইউনিট, চতুর্থ সাঁজোয়া ডিভিশন, এবং বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য। মার্কিন থিঙ্ক–ট্যাঙ্ক নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষণে, এই ডিভিশন এতটাই প্রভাবশালী ও আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, তা একপ্রকার রাষ্ট্র–সত্তায় পরিণত হয়; যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলাদাভাবে এই ডিভিশনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ডিভিশনের এক সিনিয়র কমান্ডারের মতে, মাহেরের আর্থিক নেটওয়ার্ক এখনো অনেকটাই অক্ষত, কেবল অবৈধ ক্যাপ্টাগন ট্যাবলেট বেচাকেনার অংশটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি বলেন, সম্পদগুলো সম্ভবত সিরিয়ার ভেতর–বাইরের বিভিন্ন শেল কোম্পানির নামে লুকানো আছে।
কমান্ডারের ভাষায়, “বাশার এখন মূলত ব্যক্তিগত জীবন আর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু মাহের এখনো সিরিয়ায় প্রভাব রাখতে চান। তাদের দৃষ্টিতে হাজ ফিজ আল–আসাদ একপ্রকার দেবতার মতো; তাই তাঁর সন্তানরা কীভাবে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত হবে, মাহের সেটা মানতে পারছেন না।”
ডিভিশনের দুজন কর্মকর্তা জানান, ভেতরে–বাইরে মিলিয়ে ডিভিশনের প্রায় ২৫ হাজার যোদ্ধা এখনো মাহের আল–আসাদকে নিজেদের কমান্ডার মনে করেন; তিনি চাইলে তাদের ডেকে নিতে পারবেন।
রামি মাখলুফ প্রকাশ্যে আসাদ ভাইদের “পলাতক” বলে ব্যঙ্গ করেছেন; তাঁদের সমর্থন তিনি চান না। তবে কামাল হাসান পুরনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের জোরে মাহেরের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে দুই শিবিরের তিন জ্যেষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে।
রাশিয়ার হিসাব–নিকাশ
রাশিয়া এখন পর্যন্ত হাসান ও মাখলুফ – কারও পক্ষেই প্রকাশ্যে দাঁড়ায়নি। ছয়টি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ক্রেমলিনের প্রধান লক্ষ্য এখন উপকূলীয় সিরিয়ায় তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর অব্যাহত নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন আগেই রুশ নাগরিকত্ব পাওয়া এক সিরীয় অফিসার আহমেদ আল–মাল্লা মার্চ থেকে মস্কোয় রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাসান ও মাখলুফ শিবিরের ডেপুটিদের আলাদা আলাদা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন। এসব বৈঠকের হাতে লেখা নোটে দেখা যায়, রুশ কর্মকর্তারা নির্বাসিতদের বলেছেন – আগে নিজেদের সংগঠন শক্ত করো, পরিকল্পনা দেখাও, তারপর দেখা যাবে।
অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারার ক্রেমলিন সফরের পর থেকে এসব বৈঠক বন্ধ হয়ে গেছে বলে দুই সূত্র জানায়। আল–শামি বলেন, ওই সফরে শারা রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় কামাল হাসান ও রামি মাখলুফের বিষয়টি তুলেছেন এবং রাশিয়া ও আলাদা ভাবে লেবানন জানিয়েছে, তারা নিজেদের ভূখণ্ডে এদের কোনো তৎপরতা চলতে দিতে চায় না।
এক কূটনীতিকের কথায়, শারার ক্রেমলিন সফর “আলাওয়ি বিদ্রোহীদের কাছে স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে – বিদেশে তাদের বাঁচাতে কেউ নেই।”
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় ব্যবসা হিসাব জমে যাওয়ায় মাখলুফের নগদ সংকটও দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে; অক্টোবরের বেতন এখনো পুরোপুরি পৌঁছায়নি বলে তিনজন বলেছেন।
খালেদ আল–আহমাদ: নতুন সরকারের ভরসাস্থল
মার্চের গণহত্যার পর থেকে সিরীয় সরকার যে মানুষটির ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে উপকূলের উত্তেজনা সামাল দিতে, তিনি হলেন খালেদ আল–আহমাদ – প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল–শারার শৈশব–বন্ধু এবং আলাওয়ি সম্প্রদায়েরই সন্তান।
একসময় তিনি আসাদ শিবিরের ছায়া কূটনীতিক ও সর্ববৃহৎ আধাসামরিক গোষ্ঠী ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। নিজের প্রভাবের জোরে তিনি বিশ্বাস করতেন, আসাদকে গৃহযুদ্ধে বিজয়ী করার পেছনে বড় ভূমিকা তাঁরই। কিন্তু শেষ দিকে আসাদ তাঁর ক্ষমতা খর্ব করেন, সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক দায়িত্বে পাঠাতে চান – তখন ক্ষুব্ধ হয়ে আল–আহমাদ সাইপ্রাসে পালিয়ে যান।
২০২১ সালে তিনি সিরিয়ার উত্তর–পশ্চিমে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিবে গিয়ে পুরনো বন্ধু আহমেদ আল–শারার সঙ্গে দেখা করেন। তিনজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বর্ণনায়, সেখানেই তাঁরা আসাদকে উৎখাতের পরিকল্পনা পাকাপাকি করেন – যা বাস্তবায়িত হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে।
সেই সময়ের একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় দেখা যায়, আল–আহমাদ সামরিক কর্মকর্তাদের বলছেন – হেরে যাওয়া আসাদের সঙ্গে থেকে লাভ নেই; তাঁর ডাকে সাড়া দিলে রক্তপাত কম হবে এবং ক্ষমতা পাল্টালেও তাদের জন্য ক্ষমামুক্তির ব্যবস্থা হবে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আল–আহমাদ বলেছেন, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল গৃহযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে আরও বড় রক্তপাত ঠেকানো; যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, “সিরীয়দের পুরোপুরি বাঁচাতে পারিনি, সাম্প্রদায়িক ছায়া এখনো আমাদের সমাজকে অন্ধকার করে রেখেছে।”

আজকের দিনে তিনি সিরিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী আলাওয়ি; কখনো বৈরুতের সমুদ্র–তাকানো পেন্টহাউসে, কখনো দামেস্কের সুরক্ষিত ভিলায় সময় কাটান।
তারতুসের গভর্নর আল–শামির ভাষায়, “আলাওয়ি সমাজ ও নতুন সরকারের মধ্যে আস্থার সেতু গড়তে তাঁর ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়।”
চারজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী জানান, আল–আহমাদ মনে করেন, উপকূলে বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক হতাশাই অস্থিরতার মূল কারণ। তাই তিনি চাকরি সৃষ্টি, উন্নয়ন প্রকল্প আর স্থানীয় বিনিয়োগে জোর দিচ্ছেন, যাতে যুবকদের সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যাওয়ার আগ্রহ কমে।
অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, উপকূলে মাখলুফের অর্থায়নে কাজ করা একটি গোপন সেল ধরা পড়েছে – যারা সাংবাদিক ও কর্মীদের হত্যার পরিকল্পনা করছিল। তারতুসের গভর্নরের হিসাব, এখন পর্যন্ত মাখলুফ ও হাসানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে কয়েক ডজন লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
উপকূলের কোথাও কোথাও আজও সেই গোপন ভূগর্ভস্থ কমান্ড রুমে ধুলোমাখা সরঞ্জাম পড়ে আছে। যিনি কয়েকটি ঘাঁটি ব্যক্তিগতভাবে পাহারা দেন, সেই কমান্ডারের কথায়, “যদি কখনো ডাক পড়ে, এগুলো আবার সচল করা যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি কোনো পক্ষকেই সমর্থন করার মতো যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে করি না।”
ফেরাস দালাতেয়, তিমুর আজহারি 


















