১০:৪২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চীনের গবি মরুভূমিতে রাজ কাপুর-এর গান পাসপোর্টের থেকে বেশি কাজে লেগেছিলো

  • Sarakhon Report
  • ১২:৩০:৫৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 50

সারাক্ষণ ডেস্ক

১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের নঁতে শহরে আয়োজিত ফেস্টিভ্যাল অব থ্রি কন্টিনেন্টস’-এ আমার প্রথমবার রাজ কাপুরের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তার কর্মজীবনের প্রথম দিককার কাজের প্রদর্শনীতে অংশ নিতে এসেছিলেন। তখন আমি লিবারেশনের এক তরুণ সাংবাদিকরাজ কাপুরের ওপর একটি প্রতিবেদন লিখতে গিয়েছিলাম। যদিও আওয়ারা’ (১৯৫১) ১৯৫৩ সালে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতায় দেখানো হয়েছিলতবু ফ্রান্সে কেউ রাজ কাপুরের নাম শোনেনি। এক ফরাসি সহকর্মীর সঙ্গে তার নাম উল্লেখ করলে তিনি বলেছিলেন, “উনি কেআমি তার নাম কখনো শুনিনি।

সেদিন সন্ধ্যার দিকেটানা তিনটি সিনেমা দেখে ক্লান্ত হয়ে আমি হোটেল রুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাইরে থেকে একটি গর্জন আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল। প্রথমে আমি অগ্রাহ্য করেছিলামকিন্তু শব্দ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় আমি বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি একটি দম্পতি ভারী ব্যাগ টেনে নিচ্ছেন। পুরুষটি বললেন, “কৃষ্ণাজিএসব কি তুমি এনেছপাথর?” মহিলা মৃদু সুরে উত্তর দিলেন, “শুধু কিছু জামাকাপড় আর জুতা।

তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে পুরুষটি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, “হ্যালোআমাকে রাজ কাপুর বলে ডাকে।

পরের দিন আমরা একসঙ্গে আওয়ারা’ দেখেছিলাম। ছবিটি চলাকালীন মাঝে মাঝে রাজ কাপুর কিছু ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করছিলেন। যেমনএকটি দৃশ্য যেখানে কাপুর পরিবারের তিন প্রজন্মের অভিনেতাকে একসঙ্গে দেখা যায়। যখন ছবিটি শেষ হলতিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমার মনে হয় ভালোবাসার ব্যথা সহ্য করার অভিজ্ঞতা আছে। চলোএকটা পানীয় খাই।

আমরা সামনের ব্রাসেরি লা সিগালে-তে গিয়েছিলাম। যেহেতু রাজ এবং কৃষ্ণাজি ফরাসি বলতে পারতেন নাআমি তাদের জন্য মেনু পড়ে শুনিয়েছিলাম। কিন্তু রাজ কাপুর নিজে ওয়েটারকে দিয়ে অর্ডার করলেন। তিনি এক অভিনয়ধর্মী ভঙ্গিমায় বললেন, “শ্যাম্পেনশ্যাম্পেন।” তিনি মঐত অ্যান্ড শঁদঁ অর্ডার করলেন। ভাষার প্রয়োজন ছাড়াই তিনি সবার মন জয় করেছিলেন।

শ্যাম্পেন আমাদের আলাপচারিতাকে আরও গভীর করল। আমরা আওয়ারা’ এবং বিশেষ করে ছবির নায়িকা নার্গিস সম্পর্কে কথা বললাম। এক পর্যায়েআমি তাকে আন্দ্রে ব্রেতনের দুটি লাইন শুনিয়েছিলাম: আমি তোমাকে ভালোবাসার রহস্য আবিষ্কার করেছিপ্রতিবার প্রথমবারের মতো।” তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তার জীবনের ভালোবাসার গল্প আর ভাগ্য নিয়ে কথা বললেন।

কিছুদিন পরে১৯৮৬ সালে আমি বোম্বেতে ছিলাম। সাহস করে রাজ কাপুরকে ফোন করেছিলাম। তিনি আমাকে তার বাড়িতে থাকতে আমন্ত্রণ জানালেন। ডেওনার কটেজে আমার জন্য একটি বিলাসবহুল কক্ষ বরাদ্দ করলেন এবং বললেন, “যখনই তুমি এখানে আসবেতুমি এখানে থাকবে।

তার আতিথেয়তা অতুলনীয় ছিল। তিনি আমাকে তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং একটি গাড়ি ব্যবহারের জন্য দিলেন। এমনকি আমাকে বললেনআমার বন্ধুদের নিয়ে আসতে। তার উপস্থিতি ছিল বড় এক বৃক্ষের মতোযার ছায়ায় সবাই নিরাপদ বোধ করত।

এক রাতেপ্রায় ১টা বেজেতিনি আমাকে তার ঘরে ডাকলেন। তিনি তার নিজের চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখছিলেন। তার কাছে বসে আমরা কিছু দৃশ্য দেখলাম। আমি তাকে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, “উনি দারুণ নির্মাতাকিন্তু তাকে কেবল বাংলায় দেখা হয়।” তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে আর্ট ফিল্মের চেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণ বেশি কঠিন। তিনি বিশ্বাস করতেনসিনেমা হলো মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এবং ইতিহাসের ভুলগুলো সংশোধন করার মাধ্যম।

রাজ কাপুরযাকে ভারতীয় সিনেমার গ্রেটেস্ট শোম্যান’ বলা হয়তার ব্যক্তিত্ব ছিল উদারস্বাভাবিক এবং আবেগপ্রবণ।

১৯৮৫ সালে দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছিল। আমি তাকে তার পরিবারের সঙ্গে এক বিশাল শোভাযাত্রায় আসতে দেখলাম। এটি ছিল যেন রাষ্ট্রপ্রধানের কনভয়।

১৯৯১ সালেএকটি দীর্ঘ ভ্রমণে আমি চীনের গবি মরুভূমিতে গিয়েছিলাম। সেখানে ভাষার সমস্যা হচ্ছিল। আমি আওয়ারা হুঁ’ গানটি গাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে একজন চীনা মহিলা বললেন, “ইন্দুইন্দু!” রাজ কাপুরের গান আমার পাসপোর্টের চেয়েও বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।

চীনের গবি মরুভূমিতে রাজ কাপুর-এর গান পাসপোর্টের থেকে বেশি কাজে লেগেছিলো

১২:৩০:৫৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪

সারাক্ষণ ডেস্ক

১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের নঁতে শহরে আয়োজিত ফেস্টিভ্যাল অব থ্রি কন্টিনেন্টস’-এ আমার প্রথমবার রাজ কাপুরের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তার কর্মজীবনের প্রথম দিককার কাজের প্রদর্শনীতে অংশ নিতে এসেছিলেন। তখন আমি লিবারেশনের এক তরুণ সাংবাদিকরাজ কাপুরের ওপর একটি প্রতিবেদন লিখতে গিয়েছিলাম। যদিও আওয়ারা’ (১৯৫১) ১৯৫৩ সালে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতায় দেখানো হয়েছিলতবু ফ্রান্সে কেউ রাজ কাপুরের নাম শোনেনি। এক ফরাসি সহকর্মীর সঙ্গে তার নাম উল্লেখ করলে তিনি বলেছিলেন, “উনি কেআমি তার নাম কখনো শুনিনি।

সেদিন সন্ধ্যার দিকেটানা তিনটি সিনেমা দেখে ক্লান্ত হয়ে আমি হোটেল রুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাইরে থেকে একটি গর্জন আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল। প্রথমে আমি অগ্রাহ্য করেছিলামকিন্তু শব্দ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় আমি বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি একটি দম্পতি ভারী ব্যাগ টেনে নিচ্ছেন। পুরুষটি বললেন, “কৃষ্ণাজিএসব কি তুমি এনেছপাথর?” মহিলা মৃদু সুরে উত্তর দিলেন, “শুধু কিছু জামাকাপড় আর জুতা।

তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে পুরুষটি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, “হ্যালোআমাকে রাজ কাপুর বলে ডাকে।

পরের দিন আমরা একসঙ্গে আওয়ারা’ দেখেছিলাম। ছবিটি চলাকালীন মাঝে মাঝে রাজ কাপুর কিছু ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করছিলেন। যেমনএকটি দৃশ্য যেখানে কাপুর পরিবারের তিন প্রজন্মের অভিনেতাকে একসঙ্গে দেখা যায়। যখন ছবিটি শেষ হলতিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমার মনে হয় ভালোবাসার ব্যথা সহ্য করার অভিজ্ঞতা আছে। চলোএকটা পানীয় খাই।

আমরা সামনের ব্রাসেরি লা সিগালে-তে গিয়েছিলাম। যেহেতু রাজ এবং কৃষ্ণাজি ফরাসি বলতে পারতেন নাআমি তাদের জন্য মেনু পড়ে শুনিয়েছিলাম। কিন্তু রাজ কাপুর নিজে ওয়েটারকে দিয়ে অর্ডার করলেন। তিনি এক অভিনয়ধর্মী ভঙ্গিমায় বললেন, “শ্যাম্পেনশ্যাম্পেন।” তিনি মঐত অ্যান্ড শঁদঁ অর্ডার করলেন। ভাষার প্রয়োজন ছাড়াই তিনি সবার মন জয় করেছিলেন।

শ্যাম্পেন আমাদের আলাপচারিতাকে আরও গভীর করল। আমরা আওয়ারা’ এবং বিশেষ করে ছবির নায়িকা নার্গিস সম্পর্কে কথা বললাম। এক পর্যায়েআমি তাকে আন্দ্রে ব্রেতনের দুটি লাইন শুনিয়েছিলাম: আমি তোমাকে ভালোবাসার রহস্য আবিষ্কার করেছিপ্রতিবার প্রথমবারের মতো।” তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তার জীবনের ভালোবাসার গল্প আর ভাগ্য নিয়ে কথা বললেন।

কিছুদিন পরে১৯৮৬ সালে আমি বোম্বেতে ছিলাম। সাহস করে রাজ কাপুরকে ফোন করেছিলাম। তিনি আমাকে তার বাড়িতে থাকতে আমন্ত্রণ জানালেন। ডেওনার কটেজে আমার জন্য একটি বিলাসবহুল কক্ষ বরাদ্দ করলেন এবং বললেন, “যখনই তুমি এখানে আসবেতুমি এখানে থাকবে।

তার আতিথেয়তা অতুলনীয় ছিল। তিনি আমাকে তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং একটি গাড়ি ব্যবহারের জন্য দিলেন। এমনকি আমাকে বললেনআমার বন্ধুদের নিয়ে আসতে। তার উপস্থিতি ছিল বড় এক বৃক্ষের মতোযার ছায়ায় সবাই নিরাপদ বোধ করত।

এক রাতেপ্রায় ১টা বেজেতিনি আমাকে তার ঘরে ডাকলেন। তিনি তার নিজের চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখছিলেন। তার কাছে বসে আমরা কিছু দৃশ্য দেখলাম। আমি তাকে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, “উনি দারুণ নির্মাতাকিন্তু তাকে কেবল বাংলায় দেখা হয়।” তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে আর্ট ফিল্মের চেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণ বেশি কঠিন। তিনি বিশ্বাস করতেনসিনেমা হলো মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এবং ইতিহাসের ভুলগুলো সংশোধন করার মাধ্যম।

রাজ কাপুরযাকে ভারতীয় সিনেমার গ্রেটেস্ট শোম্যান’ বলা হয়তার ব্যক্তিত্ব ছিল উদারস্বাভাবিক এবং আবেগপ্রবণ।

১৯৮৫ সালে দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছিল। আমি তাকে তার পরিবারের সঙ্গে এক বিশাল শোভাযাত্রায় আসতে দেখলাম। এটি ছিল যেন রাষ্ট্রপ্রধানের কনভয়।

১৯৯১ সালেএকটি দীর্ঘ ভ্রমণে আমি চীনের গবি মরুভূমিতে গিয়েছিলাম। সেখানে ভাষার সমস্যা হচ্ছিল। আমি আওয়ারা হুঁ’ গানটি গাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে একজন চীনা মহিলা বললেন, “ইন্দুইন্দু!” রাজ কাপুরের গান আমার পাসপোর্টের চেয়েও বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।