উত্তর-পশ্চিম মায়ানমারের সাগাইং শহরের কাছে ২৮ মার্চ দুপুর নাগাদ ৭.৭ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। কম গভীরতায় এই কম্পন হওয়ায় ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা ছিল ব্যাপক। পরে ৬.৪ মাত্রার একটি আফটারশক একই স্থানে আঘাত হানে। ভূমিকম্পের কম্পন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন, ভারত, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ায় পর্যন্ত অনুভূত হয়।
সরকারি হিসাবে এখনো চূড়ান্ত তথ্য জানা না গেলেও, সামরিক শাসক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য দ্রুত আহ্বান জানিয়েছেন। চার বছর ধরে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধের কারণে মায়ানমারের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত, যা এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২৯ মার্চ যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, তারা সমন্বিতভাবে ত্রাণকার্যক্রম ও মানবিক সহায়তা প্রদান করবে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে কাজ করবে।
মালয়েশিয়া একটি উদ্ধারকারী দল পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। ১ জন কমান্ডার ও ৪৯ জন উদ্ধারকর্মীর এই দলটি মায়ানমারে গিয়ে মানবিক ও দুর্যোগ-ত্রাণ কার্যক্রমে সহায়তা করবে।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাব সুবিয়ান্তো এক্স-এ (পূর্বের টুইটার) লিখেছেন যে, ইন্দোনেশিয়া প্রয়োজনে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “আমরা সহায়তা করব। এটি খুবই ভয়াবহ… আমরা ইতোমধ্যে ওদের সঙ্গে কথা বলেছি।” তবে তার প্রশাসনের ইউএসএআইডি (USAID) ও স্টেট ডিপার্টমেন্টে বৈদেশিক সহায়তার ব্যাপক কাটছাঁটের ফলে দুর্যোগ মোকাবিলায় সামর্থ্য কতটা প্রভাবিত হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সাবেক শীর্ষ ইউএসএআইডি কর্মকর্তা সারাহ চার্লস, যিনি আগের প্রশাসনের অধীনে দুর্যোগ-প্রতিক্রিয়া ও মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন, বলছেন যে বর্তমান ব্যবস্থাপনা “অগোছালো অবস্থায়” আছে। যথেষ্ট জনবল ও সম্পদের অভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষ উদ্ধারের মতো জরুরি কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
সহায়তা ও প্রার্থনা
জাতিসংঘ (ইউএন) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)—যাদের বাজেট ইতিমধ্যে মার্কিন সহায়তা হ্রাসের কারণে চাপে—মায়ানমার, থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশগুলোকে সাহায্য করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন যে, মায়ানমারে তাদের স্থানীয় দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং অঞ্চলে সবধরনের সংস্থান জড়ো করা হচ্ছে।
ডব্লিউএইচও দুবাইয়ে তাদের লজিস্টিকস হাব থেকে জরুরি চিকিৎসা ও ট্রমা সাপ্লাই পাঠাতে প্রস্তুত হচ্ছে। সংস্থাটির মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস জানিয়েছেন, “আমরা যেহেতু ঘটনাটিকে বিশাল আকারের বলে মনে করছি, সেহেতু এটি স্পষ্টতই জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বড় কারণ। আমরা বহিরাগত চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ট্রমা কিট পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছি, কারণ অনেক মানুষ আহত হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।”
চীনের সহায়তা
মায়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা চীন ৮২ সদস্যের একটি উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে। ইউনানের আরেকটি দল ২৯ মার্চ ইয়াঙ্গনে পৌঁছেছে। বেইজিং ১০ কোটি ইউয়ান জরুরি সাহায্য হিসেবে দিচ্ছে, যার মধ্যে তাঁবু, চিকিৎসা উপকরণ ও খাদ্যসামগ্রী রয়েছে। এর প্রথম চালান ৩১ মার্চের মধ্যে পৌঁছাবে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে পাঠানো বার্তায় শোক জানিয়ে বলেছেন যে, চীন মায়ানমারের পাশে আছে।
ভারতের সহায়তা
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর জানিয়েছেন যে, একটি সি-১৩০ সামরিক পরিবহন বিমান ইতোমধ্যে জরুরি পণ্য নিয়ে মায়ানমারের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তার সঙ্গে অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল এবং একটি চিকিৎসা দলও গিয়েছে। তিনি বলেন, “ঘটনার অগ্রগতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি এবং প্রয়োজনে আরও সহায়তা পাঠানো হবে।”
জাপান ও অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা জানিয়েছেন, এই বিধ্বংসী পরিস্থিতিতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত। “আশা করি ক্ষতিগ্রস্তরা দ্রুত সেরে উঠবে এবং বিধ্বস্ত এলাকাগুলোও দ্রুত পুনর্গঠন হবে। এই কঠিন সময়ে আমরা মায়ানমারের পাশে আছি,” তিনি যোগ করেন।
দক্ষিণ কোরিয়া ২৯ মার্চ মায়ানমারের জন্য ২০ লাখ মার্কিন ডলার মানবিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে।
ভ্যাটিকানের দেওয়া এক বার্তায় পোপ ফ্রান্সিস জানিয়েছেন, তিনি প্রাণহানি ও বিধ্বস্ত অবস্থায় গভীরভাবে শোকাহত। তিনি নিহতদের জন্য এবং যারা উদ্ধারকাজ করছেন, তাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন।