প্রথম দৃশ্যপট
গত ১০ মার্চ বিকেলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৩১ সদস্যের একটি দল কুনমিংয়ের পথে রওনা দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন ১৪ জন বাংলাদেশি রোগী, ছয়জন স্বজন, পাঁচজন চিকিৎসক, পাঁচজন ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিনিধি ও একজন সাংবাদিক। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকারি সমন্বয়ে সংগঠিত প্রথম “চিকিৎসা-ভ্রমণ” দল, যার সদস্যরা চীনের চারটি নির্ধারিত হাসপাতালে বিশেষায়িত সেবা নিতে গেছেন। হাসপাতালগুলোর তালিকায় রয়েছে ইউনান ফুওয়াই কার্ডিওভাসকুলার হাসপাতাল ও ইউনান ক্যানসার হাসপাতালসহ চারটি ‘ত্রিপল-এ’ মানের প্রতিষ্ঠান।
সংখ্যা কী বলে?
চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গত তিন মাসে (মার্চ-এপ্রিল-মে) চীনে যাওয়া রোগীর পূর্ণাঙ্গ ও আনুষ্ঠানিক হিসাব এখনো দূতাবাস প্রকাশ করেনি। সরকারিভাবে নিশ্চিত হওয়া একমাত্র দলটিই ১৪ জন রোগী নিয়ে গঠিত, অর্থাৎ এ সময়কালে ন্যূনতম নিশ্চিত সংখ্যা ১৪। যদিও যাত্রাপথে রোগীদের সঙ্গে থাকা স্বজন ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের ধরলে চীনে পা রেখেছে মোট ৩১ জন বাংলাদেশি নাগরিক।
কেন হঠাৎ চীনমুখী?
ভারত প্রতিবছর প্রায় ২৫ লক্ষ বাংলাদেশির জন্য ‘ল্যাবেরেটরির কাছে’ হয়ে উঠেছিল—মূলধারার চিকিৎসা, ভাষাগত সুবিধা আর নিকটবর্তী ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার অপসারিত হওয়ার পর ভারতের দূতাবাস দৈনিক ৭–৮ হাজারের পরিবর্তে হাজারখানেক মেডিকেল ভিসা দিচ্ছে মাত্র। এই ‘ভিসা-সংকোচ’ চিকিৎসা-নির্ভর হাজারো পরিবারকে অচলাবস্থায় ফেলেছে এবং সেই শূন্যস্থান পুষিয়ে নিতে কূটনৈতিকভাবে এগিয়ে এসেছে বেইজিং।
‘গ্রিন চ্যানেল’–এর সুড়ঙ্গ
বাংলাদেশি রোগীদের আকর্ষণের জন্য ৫ মে চীনা দূতাবাস ঢাকায় চালু করেছে ‘গ্রিন চ্যানেল’। জরুরি কেসে আবেদন-দাখিলের দিনই ভিসা পাওয়ার সুবিধা, ব্যাঙ্ক সলভেন্সি বা আত্মীয়তার প্রমাণের নথি ট্রাভেল এজেন্সির গ্যারান্টি-পত্রে চলবে—এসব ছাড় দিয়েই দ্রুত সেবার আশ্বাস দিয়েছে চীন। ভিসা সেন্টারের আলাদা কাউন্টার ও হটলাইন নম্বর চালুর ঘোষণা, অনলাইনে প্রায়ই মিনিটে-মিনিটে আপডেট—সব মিলিয়ে ভিসা-প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে এক ধরনের ‘ওয়ান-স্টপ সার্ভিস’।
রোগীর প্রোফাইল
প্রথম দলে তিনজন শিশু—যাদের জন্মগত হৃদ্রোগ (হোল ইন দ্য হার্ট)। এছাড়া ক্যানসার, জটিল হৃদ্রোগ, হেপাটোবিলিয়ারি সমস্যা এবং নাড়া-কমা অস্থিসন্ধির রোগীও আছেন। হাসপাতালগুলোতে বিশ্ব-মানের কার্ডিয়াক সার্জারি, কেমো-থেরাপি, মিনিমালি ইনভেসিভ অর্থোপেডিকস, জিন-থেরাপির মতো সুবিধা পাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করেছে ইউনান প্রদেশ কর্তৃপক্ষ।
খরচ ও লগিস্টিক
পাইলট প্রকল্পের রোগীদের চিকিৎসা-ব্যয়ের একটি বড় অংশ বহন করছে স্বাগতিক হাসপাতাল; বিমান পরিবহন ব্যয়ও আংশিকভাবে চীনা এয়ারলাইন্সের রেয়াতি ভাড়ায় সম্ভব হয়েছে। রোগীর পরিবার জানিয়েছে, ভারতের তুলনায় ১৫–২০ ভাগ কম খরচেই উন্নত প্রযুক্তি-নির্ভর সেবা পাওয়া যাচ্ছে, যদিও ভাষাগত-সংস্কৃতিক বাধা ও খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ভবিষ্যৎ প্রবণতা
বাংলাদেশে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে, গ্রিন চ্যানেল চালুর পর মাত্র এক মাসেই শতাধিক প্রাথমিক কনসালটেশন হয়েছে; তাঁদের ধারণা, জুন-আগস্ট সময়কালে মাসে গড়ে ৪০–৫০ জন রোগী কুনমিং যেতে পারেন—যদি ভিসা-প্রক্রিয়ার ঘাটতি না হয়। তবে এসব সংখ্যার কোনো সরকারি অনুমোদন নেই; দূতাবাসও আনুষ্ঠানিক মন্তব্যে ‘দ্রুত বেড়েই চলেছে’—এই ভাষ্য দিয়েই থেমেছে।
বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. সবুর খান মনে করেন, ‘ভারত-নির্ভর’ চিকিৎসা-পূর্বাভাস ভেঙে চীনে সরে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য লাভ-ক্ষতির মিশ্র সমীকরণ। উন্নত প্রযুক্তি ও তুলনামূলক কম খরচ যেমন ইতিবাচক, তেমনি চীনের হাসপাতালব্যবস্থায় বিদেশি রোগীর স্বাধীনতা সীমিত—ডাক্তার ও ওয়ার্ড বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি নিয়মকাঠামো মানতে হয়। ফলে “ভারত বনাম চীন” প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত রোগীর পকেট ও অভিজ্ঞতা—দুটিই নির্ধারণ করবে।
দেশীয় বদলের আলামত
আইনগত কাঠামো অনুযায়ী বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের উপর ‘এ-টু-এস সারচার্জ’ ফেরত পেতে করদাতাদের ঘোষণাপত্রে হাসপাতালের ট্যাক্স রসিদের প্রয়োজন হয়। চীনা হাসপাতালগুলো এখনই সে রসিদ দিচ্ছে কিনা—তা স্পষ্ট নয়। ফলে রোগীরা সম্পূরক খরচের ক্ষতিপূরণ পেতে সমস্যায় পড়তে পারেন। পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে একটি ‘বিদেশে চিকিৎসা-সহায়তা নীতিমালা’ হালনাগাদ করার কথা ভাবছে—এমনটাই মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
তিন মাসে ১৪ জন রোগী—শুধু সংখ্যার বিচারে সামান্য। কিন্তু সংকট-বদ্ধ ভারতীয় ভিসা-ব্যবস্থার ফাঁক গলে চীনা ‘গ্রিন চ্যানেল’ নতুন এক ট্রান্স-এশিয়া চিকিৎসা-রুটের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ফলে সামনে হয়তো দেখা যাবে, অ্যানজিওপ্লাস্টি কিংবা ক্যানসারের জন্য বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ভারত নয়, কুনমিং বা গুয়াংজ়ৌয়ের হসপিটালের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। এ পথ কতটা সুগম হবে, তা নির্ভর করবে ভিসা-জটের স্থায়ী সমাধান, ব্যয়-স্বচ্ছতা এবং সর্বোপরি রোগীর সন্তুষ্টির ওপর। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—দুই দেশের কূটনৈতিক সমীকরণে স্বাস্থ্য-সাহায্য এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘সফট পাওয়ার’ হাতিয়ার, যার সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশের ভুক্তভোগী রোগী-সমাজ।