১১:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৬ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৪
  • 20
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

উপদেশের ‘একটা কথা ভাবতে ভাবতে অন্ত কথার জবাব অমনি করেই দিতে হয়।’ ‘ও, আচ্ছা ভাবুন; আমি চুপ করলাম।’

বাড়ির দরজায় গাড়ি থামা পর্যন্ত সুপ্রিয়া সত্যই চুপ করে রইল। যেখানে তারা বাড়ি নিয়েছে সেখান থেকে সমুদ্রের আওয়াজ শোনা যায় বটে, বাড়ির ছাবে না উঠলে সমুদ্র দেখা যায় না। এবারও সুপ্রিয়া হেরম্বকে বাড়ির বাজে অংশ পার করিয়ে একেবারে তার শোবার ঘরে নিয়ে হাজির করল। হেরম্ব লক্ষ্য করল স্বরখানা দোকানের মতো সাজানো নয়, শয়নঘরের মতোও নয়।

বিদেশ বলে বোধহয় ঘরে আসবাব বেশী নেই, অস্থায়ী বলে স্বপ্রিয়ার নেই ঘর সাজাবার উৎসাহ। উৎসাহের অভাব ছাড়া অন্ধ্র কারণও হয়তো আছে। এটা যদি সুপ্রিয়ারই শয়নকক্ষ হয় তবে সে এখানে একাই থাকে। ছোট চৌকিতে যে বিছানা পাতা আছে সেটা একজনের পক্ষেও ছোট। অশোক যদিও এখন বিছানায় চিত হয়ে পড়ে আছে, এ অধিকার হয়তো তার সাময়িক, হয়তো এ তার নিছক গায়ের জোর। এই সব পলকনিহিত অনুমানের মধ্যেও হেরম্ব কিন্তু টের পাচ্ছিল অশোকের গায়ের জোর বড় আর নেই। সে দুর্ভিক্ষ-পীড়িতের মতো শীর্ণ হয়ে গেছে।

অশোক উঠল না। বলল, ‘হেরম্ববাবু যে!’

হেরম্ব বলল, ‘আমিই। তোমাকে চেনা যাচ্ছে না, অশোক।’

‘যাবেও না। মরে ভৌতিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছি যে! এ যা দেখছেন,

এ হল সুক্ষ্ম শরীর।’

‘সূক্ষ্ম সন্দেহ নেই।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার পত্রে জানা গেল এখানকার জল-হাওয়া ভাল। উনি মনে করলেন, আমার অবস্থা বুঝে পুরীতে আমাদের নেমন্তন্নই বুঝি করছেন ওই কথা লিখে। তাই জোর করে টেনে এনেছেন। ছুটির জন্য বেশী লেখালেখি করতে গিয়ে চাকরিটি প্রায় গিয়েছিল, মশায়।’

আনন্দের সঙ্গে কথা বলবার সময় সুপ্রিয়ার কণ্ঠস্বরে যে ব্যঙ্গ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, অশোকের কথায় যেন তারই ভদ্র, গোপন-করা ধ্বনি শোনা যায়। হেরম্ব একটু সাবধান হল।

‘তোমার আঙুল কি হল, অশোক?’

অশোকের ডানহাতের মাঝের আঙুল দুটি কাটা। ঘা শুকিয়ে এসেছে কিন্তু আরক্তভাব এখনো যায়নি, শুকনো ঘায়ের মামড়ি তুলে ফেললে যেমন দেখায়। এ বিষয়ে অশোকের নিজের কৌতূহল বোধহয় এখনো যায়নি, হাতটা চোখের সামনে ধরে সে কাটা আঙুলের গোড়া দুটি পরীক্ষা করে নিল। বলল, ‘একজন ছোরা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।’

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৬ তম কিস্তি )

১২:০০:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

উপদেশের ‘একটা কথা ভাবতে ভাবতে অন্ত কথার জবাব অমনি করেই দিতে হয়।’ ‘ও, আচ্ছা ভাবুন; আমি চুপ করলাম।’

বাড়ির দরজায় গাড়ি থামা পর্যন্ত সুপ্রিয়া সত্যই চুপ করে রইল। যেখানে তারা বাড়ি নিয়েছে সেখান থেকে সমুদ্রের আওয়াজ শোনা যায় বটে, বাড়ির ছাবে না উঠলে সমুদ্র দেখা যায় না। এবারও সুপ্রিয়া হেরম্বকে বাড়ির বাজে অংশ পার করিয়ে একেবারে তার শোবার ঘরে নিয়ে হাজির করল। হেরম্ব লক্ষ্য করল স্বরখানা দোকানের মতো সাজানো নয়, শয়নঘরের মতোও নয়।

বিদেশ বলে বোধহয় ঘরে আসবাব বেশী নেই, অস্থায়ী বলে স্বপ্রিয়ার নেই ঘর সাজাবার উৎসাহ। উৎসাহের অভাব ছাড়া অন্ধ্র কারণও হয়তো আছে। এটা যদি সুপ্রিয়ারই শয়নকক্ষ হয় তবে সে এখানে একাই থাকে। ছোট চৌকিতে যে বিছানা পাতা আছে সেটা একজনের পক্ষেও ছোট। অশোক যদিও এখন বিছানায় চিত হয়ে পড়ে আছে, এ অধিকার হয়তো তার সাময়িক, হয়তো এ তার নিছক গায়ের জোর। এই সব পলকনিহিত অনুমানের মধ্যেও হেরম্ব কিন্তু টের পাচ্ছিল অশোকের গায়ের জোর বড় আর নেই। সে দুর্ভিক্ষ-পীড়িতের মতো শীর্ণ হয়ে গেছে।

অশোক উঠল না। বলল, ‘হেরম্ববাবু যে!’

হেরম্ব বলল, ‘আমিই। তোমাকে চেনা যাচ্ছে না, অশোক।’

‘যাবেও না। মরে ভৌতিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছি যে! এ যা দেখছেন,

এ হল সুক্ষ্ম শরীর।’

‘সূক্ষ্ম সন্দেহ নেই।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার পত্রে জানা গেল এখানকার জল-হাওয়া ভাল। উনি মনে করলেন, আমার অবস্থা বুঝে পুরীতে আমাদের নেমন্তন্নই বুঝি করছেন ওই কথা লিখে। তাই জোর করে টেনে এনেছেন। ছুটির জন্য বেশী লেখালেখি করতে গিয়ে চাকরিটি প্রায় গিয়েছিল, মশায়।’

আনন্দের সঙ্গে কথা বলবার সময় সুপ্রিয়ার কণ্ঠস্বরে যে ব্যঙ্গ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, অশোকের কথায় যেন তারই ভদ্র, গোপন-করা ধ্বনি শোনা যায়। হেরম্ব একটু সাবধান হল।

‘তোমার আঙুল কি হল, অশোক?’

অশোকের ডানহাতের মাঝের আঙুল দুটি কাটা। ঘা শুকিয়ে এসেছে কিন্তু আরক্তভাব এখনো যায়নি, শুকনো ঘায়ের মামড়ি তুলে ফেললে যেমন দেখায়। এ বিষয়ে অশোকের নিজের কৌতূহল বোধহয় এখনো যায়নি, হাতটা চোখের সামনে ধরে সে কাটা আঙুলের গোড়া দুটি পরীক্ষা করে নিল। বলল, ‘একজন ছোরা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।’