কীর্তনখোলা নদীর পরিচয়
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী কীর্তনখোলা। বরিশাল শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই নদী শুধু একটি জলপথ নয়, এটি দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলের জীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সভ্যতার বিকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
দুই শতকের ইতিহাস ও উপকূলের সভ্যতা
প্রায় ২০০ বছর আগে যখন ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, কীর্তনখোলা নদী হয়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসার মূল রক্তধারা। নদীর দুই তীরেই গড়ে উঠেছিল বাজার, ঘাট, খেয়া-পারাপারের কেন্দ্র। বরিশাল শহরের বিস্তার ও শ্রীবৃদ্ধি এই নদীর পাড়েই শুরু হয়।
পুরনো বরিশালকে বলা হতো “ভেনিস অফ দ্য ইস্ট”, যার একটি কারণ ছিল কীর্তনখোলা নদীসহ অসংখ্য খাল। নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছিল কাঠ, নৌকা তৈরির কর্মশালা, ধান-চালের আড়ত, গুড় ও সুপারি বাণিজ্য কেন্দ্র। নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতেও সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠেছিল—যারা নদীর পানিতে সেচ দিত, মাছ ধরত এবং শহরের বাজারে পণ্য বেচতে যেত।
ব্রিটিশ আমলে কলকাতার সঙ্গে সংযোগ
১৮০০ সালের শেষভাগ থেকে ১৯০০ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ শাসকরা বরিশাল ও কলকাতার মধ্যে সরাসরি নদীপথকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। কীর্তনখোলা নদী ছিল বৃহত্তর গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা নদীপ্রণালীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কলকাতা থেকে স্টিমার আসত বরিশাল পর্যন্ত। এই যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল সস্তা ও নির্ভরযোগ্য।
কলকাতার বাজারে বরিশালের ধান, পাট, কাঠ, গুড় সহজেই পৌঁছে যেত। কলকাতা থেকে আসত কাপড়, লবণ, কেরোসিন ও অন্যান্য তৈরি পণ্য। এই সংযোগই বরিশালকে একসময় দক্ষিণ বাংলার বাণিজ্যিক রাজধানী করে তুলেছিল। নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিল বিশাল ঘাট ও ডিপো।
পাকিস্তান আমলে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ
ব্রিটিশ আমল শেষে পাকিস্তান যুগে (১৯৪৭–১৯৭১) নদী যোগাযোগের গুরুত্ব কমেনি। বরিশাল-ঢাকা নৌপথ ছিল অন্যতম প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম। কীর্তনখোলা নদীর ঘাট থেকে লঞ্চ, স্টিমার ছেড়ে যেত ঢাকা সদরঘাট পর্যন্ত। সে সময় সড়ক যোগাযোগ দুর্বল ছিল, তাই যাত্রী ও পণ্য দুই-ই নদীপথে চলাচল করত।
এ ছাড়া বরিশালের অন্যান্য উপজেলা—উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, গৌরনদী ইত্যাদির সঙ্গে নদীর শাখা-উপশাখা দিয়ে সহজে পণ্য পরিবহন হতো। নদীপথে মাছ, চাল, ডাল, নারকেল, পাট ইত্যাদি ঢাকায় যেত, ঢাকার পণ্য বরিশালে আসত।
নদীর তীরের বনাঞ্চল
একসময় কীর্তনখোলার দুই তীরেই ছিল সবুজে ঘেরা বনাঞ্চল। নদীর বাঁকে বাঁকে ছিল বট, পাকুর, কড়ই, অর্জুন ও কেওড়ার ঝাড়। এই বনে থাকত নানা বন্যপ্রাণী—খরগোশ, শিয়াল, হরিণের মতো প্রাণীও নাকি আশেপাশে বনে দেখা যেত। নদীর তীর রক্ষা করত এই বন। বড় বন্যায়ও তীর ভাঙন অনেকটা ঠেকাত এই গাছপালা।
নদীর জলজ জীববৈচিত্র্য
কীর্তনখোলা নদীতে বহু রকমের মাছ পাওয়া যেত। রুই, কাতলা, শোল, গজার ছাড়াও নদীর মোহনা এলাকায় ইলিশ ধরা পড়ত। এছাড়া শাপলা, শালুক, পানিফলসহ জলজ উদ্ভিদ ছিল নদীর প্রকৃত সৌন্দর্য। নদীতে ডলফিন বা শুশুকও দেখা যেত, যদিও এখন তা খুবই দুর্লভ হয়ে গেছে।
বর্তমান অবস্থা
আজ কীর্তনখোলা নদী নানা চাপে নুব্জ।
• দূষণ: নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন, প্লাস্টিক বর্জ্য, কল-কারখানার বর্জ্য নদীতে পড়ছে।
• পলিভরাট: অতিরিক্ত পলি নদীর নাব্যতা কমিয়ে দিচ্ছে।
• অবৈধ দখল: দুই পাড়ে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। নদী সরু হয়ে আসছে।
• জলজ জীববৈচিত্র্য হ্রাস: অতিরিক্ত মাছ ধরা, দূষণ ও নাব্য সংকটের কারণে মাছ ও শুশুক কমে গেছে।
তবুও কীর্তনখোলা নদী বরিশালের জীবনরেখা। বরিশাল নদী বন্দর এখনো বাংলাদেশের একটি ব্যস্ততম লঞ্চ টার্মিনাল। প্রতিদিন শ’ শ’ যাত্রী নদীপথে ঢাকায় যাতায়াত করেন। নৌকার ব্যবসা, মালবাহী লঞ্চ, যাত্রীবাহী লঞ্চ সবই চলছে।
নদীর ভবিষ্যৎ
স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশবাদীরা নদী রক্ষার দাবি তুলছেন। নদীর পাড় পুনর্গঠন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেজিং, অবৈধ দখল উচ্ছেদ—এসব উদ্যোগ চলছে ধীরগতিতে। সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন না হলে নদী হারাবে তার প্রাণশক্তি।
দুই শতকের বেশি সময় ধরে কীর্তনখোলা নদী বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে আলো এনেছে। ব্যবসা, যোগাযোগ, কৃষি, খাদ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা এই নদীকে রক্ষা করা মানে আমাদের অতীতকে বাঁচানো, ভবিষ্যৎকে টিকিয়ে রাখা। নদী বাঁচলে বরিশাল বাঁচবে — এটাই সত্য।