আমরা প্রায়ই ৩০-এর দশককে জীবনের সেরা সময় মনে করি—ক্যারিয়ার স্থিতিশীল, পরিবার গড়ে উঠছে, স্বাস্থ্য ভালো। কিন্তু বাস্তবে অনেকের জন্য এই সময় হয়ে ওঠে চাপে ভরা, নিঃশব্দ সংগ্রামের এক দশক। কর্মজীবনের চাপ, পারিবারিক দায়িত্ব, আর্থিক টানাপোড়েন ও সম্পর্কের জটিলতা মিলিয়ে এই বয়সে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।
পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা
সিঙ্গাপুরে ২০২৪ সালে আত্মহত্যায় মারা গেছেন ৩১৪ জন, যার মধ্যে ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ৭৫—সব বয়সের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি। বর্তমানে প্রায় এক-চতুর্থাংশ আত্মহত্যাই এই বয়সীদের মধ্যে ঘটে। এর কারণ শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি নয়; বরং জীবনযাপনের চাপ ও মানসিক চ্যালেঞ্জেরও স্পষ্ট ইঙ্গিত।
ব্যক্তিগত সংগ্রামের নীরব কাহিনি
- একজন পুরুষ প্রতিদিন অফিসের পোশাক পরে বের হন, অথচ কয়েক মাস আগে চাকরি হারিয়েছেন; দিন কাটান লাইব্রেরিতে চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজে।
- একজন মা অফিস শেষে সন্তানদের দেখাশোনা করেন, শ্বশুরের ডিমেনশিয়ার যত্ন নেন, আর রাতে একা কাঁদেন ক্লান্তি ও অসহায়তায়।
- কেউ হঠাৎ সঙ্গীর পরকীয়ার প্রমাণ পান, পরদিন স্বাভাবিকভাবে আচরণ করেন, কিন্তু ভেতরে ভেঙে পড়েন।
এগুলো বিরল গল্প নয়; বরং অগণিত পরিবারে নীরবে ঘটে চলেছে। আত্মহত্যা অনেক সময় হঠাৎ ঘটেছে বলে মনে হলেও, তা দীর্ঘদিনের এক নিঃশব্দ যন্ত্রণার শেষ ধাপ।

৩০-এর দশকের চাপের ধরন
- কর্মজীবন: প্রমোশনের প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির পরিবর্তনের সাথে তাল মেলানো, বা চাকরি হারানোর আশঙ্কা।
- আর্থিক চাপ: বাড়ি ও গাড়ির ঋণ, সন্তান লালন-পালন, বয়স্ক বাবা-মায়ের খরচ, ব্যর্থ ব্যবসা বা ঋণের বোঝা।
- সম্পর্ক: বিবাহ, বিচ্ছেদ, বা দীর্ঘ সম্পর্কের অবসানে মানসিক আঘাত। সন্তান আসা যেমন আনন্দের, তেমনি বাড়ায় ক্লান্তি ও দায়িত্ব।
পুরুষ ও নারীর মানসিক চাপের পার্থক্য
২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ২০২ জন ছিলেন পুরুষ। বিশ্বব্যাপীও দেখা যায়, পুরুষরা আত্মহত্যায় বেশি মারা যান, যদিও নারীরা বেশি চেষ্টা করেন।
- পুরুষরা সাধারণত সমস্যার কথা না বলে একা মোকাবিলা করতে চান, সাহায্য চাইতে সংকোচ বোধ করেন, এবং তীব্র আবেগের মুহূর্তে প্রাণঘাতী পদক্ষেপ নিতে পারেন।
- নারীরা তুলনামূলকভাবে আগে সাহায্য চান, বন্ধু বা পরিবারের সাথে শেয়ার করেন, তবে সবারই প্রয়োজনীয় সহায়তা মেলে না।
সহায়তা ও প্রতিরোধের উপায়
আত্মহত্যা প্রতিরোধ শুধু হেল্পলাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তা হওয়া উচিত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জায়গায়—অফিস, কমিউনিটি সেন্টার, বা সামাজিক গোষ্ঠীতে।
প্রথম স্তর: সচেতনতা
মানুষকে জানাতে হবে যে ৩০-এর দশকের সাধারণ মানুষও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারেন। স্থানীয় গল্প, বাস্তব উদাহরণ ও পরিচিত পরিবেশে সচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যকর হতে পারে।

দ্বিতীয় স্তর: কর্মক্ষেত্র
- ম্যানেজারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা সমস্যার লক্ষণ বুঝে সহমর্মিতা দেখাতে পারেন।
- গোপন পরামর্শ সেবা (EAP) চালু করা।
- মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ও নিয়মিত চেক-ইনকে স্বাভাবিক করা।
- সহকর্মীদের পারস্পরিক সহায়তায় উৎসাহিত করা।
তৃতীয় স্তর: কমিউনিটি সাপোর্ট
প্যারেন্টিং গ্রুপ, জিম, অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক বা পাড়ার সামাজিক কার্যক্রম—এসব জায়গায় খোলামেলা আলাপের সুযোগ রাখা জরুরি।
চতুর্থ স্তর: ব্যক্তিগত উদ্যোগ
বন্ধু, পরিবার ও সহকর্মীরা কারো আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করলে জিজ্ঞাসা করা, মনোযোগ দিয়ে শোনা, এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার পথ দেখানো—এসব ছোট পদক্ষেপও জীবন বাঁচাতে পারে।
একসাথে বাঁচিয়ে রাখা
এমন সুরক্ষা জাল একদিনে তৈরি হয় না; তা গড়ে ওঠে হাজারো ছোট মানবিক উদ্যোগে—একজন ম্যানেজারের খোঁজ নেওয়া, প্রতিবেশীর খোঁজখবর, বন্ধুর পরামর্শ সেশনে সঙ্গ দেওয়া।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ শুধু বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব নয়; এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। যদি আমরা লক্ষ্য করি, জিজ্ঞাসা করি, আর সাহায্যের হাত বাড়াই—আমরা হতে পারি সেই সুরক্ষা জালের অংশ, যা মানুষকে জীবনের সাথে বেঁধে রাখে।
কেউ যেন জীবনের কোনো পর্যায়ে একা এই বোঝা বইতে না হয়—এটাই আমাদের যৌথ দায়িত্ব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















