বিলাসী খাবারের প্রদর্শনী
লস অ্যাঞ্জেলেসের এক জমকালো ডিনার পার্টিতে পরিবেশিত হয়েছিল অভিনব এক পিৎজা—যার দাম ছিল ২ হাজার ডলার। ব্যক্তিগত শেফ ব্রুক বায়েভস্কি সেটি টিকটকের ক্যামেরার সামনে তুলে ধরেন। ক্যাভিয়ার, অর্গানিক ডুমুর, মানুকা মধু এবং ২৪ ক্যারেট সোনার পাত দিয়ে সাজানো এই খাবার আসলে স্বাদে ভিন্ন কিছু না হলেও আলোকোজ্জ্বল প্রদর্শন তৈরি করে। বায়েভস্কি, যিনি অনলাইনে “শেফ বে” নামে পরিচিত, দাবি করেন রাজপরিবার, ক্রীড়া তারকা ও হলিউড অভিনেতাদের জন্য তিনি রান্না করেন। তাঁর ভিডিওতে ব্যঙ্গচিত্র নয়, বরং ধনী সমাজের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।
ঝলক থেকে অনুসরণ
এখনকার ব্যক্তিগত শেফরা শুধু খাবার পরিবেশনেই সীমাবদ্ধ নন। তাঁরা অনুসারীদের দেখাচ্ছেন বিশাল ফ্রিজের ভেতরের দৃশ্য, দামি খাদ্যদ্রব্যের দোকান কিংবা ইয়টে বসে বিলাসী খাবার খাওয়ার মুহূর্ত। এমিলি রুইবাল, আরেকজন শেফ, বাহামাসের ইয়টে চার-কোর্সের মেনু পরিবেশন করে জনপ্রিয় হয়েছেন। টিকটকে #privatechef হ্যাশট্যাগেই দেখা গেছে ৫ বিলিয়নের বেশি ভিউ। ফলে বোঝা যায়, বিলাসবহুল খাবারের জগত কেবল অভিজাত সমাজেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ডিজিটাল পর্দার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কৌতূহল ও আকর্ষণের অংশ হয়ে উঠেছে।
হ্যাম্পটনসের জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক রূপ
নিউইয়র্কের হ্যাম্পটনস গ্রীষ্মকালে ধনী সমাজের অন্যতম গন্তব্য। সেখানে “হ্যাম্পটনস অ্যাসথেটিক”—সমুদ্রপাড়ের বিলাসী জীবনযাত্রা—টিকটকে একটি ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। শেফ মেরেডিথ হেইডেন তাঁর দীর্ঘ কেটারিং শিফটের ভিডিও ডায়েরি বানিয়ে লাখো মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখানে মেনুর কেন্দ্রে থাকে না সোনার পাত, বরং হাতে তোলা তাজা সবজি ও সরল খামারি উপকরণ। অর্থাৎ, একদিকে যখন বিলাসী উপাদান যেমন ক্যাভিয়ার বা লবস্টার ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যদিকে একই সঙ্গে সরল জীবনযাত্রাকেও এক ধরনের স্টাইল হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে।
ব্যক্তিগত শেফ পেশার উত্থান
একসময় ব্যক্তিগত শেফের কাজ ছিল গোপনীয়, প্রায় অদৃশ্য। কিন্তু এখন এই শিল্প দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকান এজেন্সি কুলিনিস্টাস জানিয়েছে, হ্যাম্পটনসে এই গ্রীষ্মে তাঁদের ব্যবসা আগের বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। একজন শেফকে মৌসুমের জন্য নিয়োগ দিতে খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার ডলার। ধনী সমাজ ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকে যেসব শেফকে দেখে তাঁদের সরাসরি নিয়োগ দিচ্ছেন। ফলে এই পেশা, যা আগে অবহেলিত ছিল, এখন মূলধারার রন্ধনশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা পাচ্ছে।

সামাজিক প্রভাব ও বৈষম্যের প্রতিফলন
এখানে একটি বড় প্রশ্ন উঠে আসে—এমন বিলাসী প্রদর্শনীর সামাজিক প্রভাব কী? সাধারণ মানুষের কাছে এ ধরনের ভিডিও প্রায়শই ধনী-অভিজাতদের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেদের দূরত্বকে স্পষ্ট করে তোলে। বিলাসী খাবারের ভিডিও দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হন, আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি কেবল সম্পদ আর বৈষম্যের প্রদর্শনী। অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধনী সমাজের প্রতিটি বিলাসী পদক্ষেপ দৃশ্যমান হওয়ায় বৈষম্যের উপলব্ধি আরও বাড়ছে। তবে একই সঙ্গে শেফদের জন্য এটি একটি সুযোগ—নিজেদের প্রতিভা প্রদর্শন করে পেশাগত সাফল্য অর্জন করার।
গোপনীয়তা থেকে খ্যাতি
টিকটকের এই জগৎ অনেক শেফকে একান্ত ব্যক্তিগত জীবন থেকে তুলে এনে জনসমক্ষে পরিচিত করেছে। যেমন—মেরেডিথ হেইডেন তাঁর রান্নার পাশাপাশি বই লিখে বেস্টসেলার লেখক হয়েছেন এবং হ্যাম্পটনসে নিজের বাড়ি কিনেছেন। আরেকদিকে ব্রুক বায়েভস্কির মতো শেফরা হলিউড তারকাদের সঙ্গে কাজ করে সেই অভিজ্ঞতাকে জনসমক্ষে ভাগ করছেন। এতে তাঁরা কেবল রন্ধনশিল্পী নন, বরং ডিজিটাল প্রভাবশালী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন।
টিকটকে ধনী সমাজের ব্যক্তিগত শেফদের গল্প কেবল বিলাসবহুল খাবারের বর্ণনা নয়, বরং সামাজিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক প্রভাব, এবং ডিজিটাল দুনিয়ায় পেশার রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি। একসময়ের নিভৃত পেশা এখন পরিণত হয়েছে আলোকোজ্জ্বল ক্যারিয়ারে—যেখানে রান্না শুধু খাওয়ার জন্য নয়, বরং সমাজে এক নতুন জীবনধারার প্রতীক।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















