নতুন আবিষ্কার: প্রাচীন দাঁত থেকে মানব ইতিহাসের সূত্র
ইথিওপিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় পাওয়া প্রাচীন দাঁতের জীবাশ্ম জানাচ্ছে, প্রায় ২৬ থেকে ২৮ লক্ষ বছর আগে একই স্থানে দুই ভিন্ন মানব পূর্বপুরুষ বা হোমিনিন প্রজাতি পাশাপাশি বসবাস করত। এর মধ্যে একটি হয়তো এখনো অজানা কোনো প্রজাতি।
২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পাওয়া ১০টি দাঁত অস্ট্রালোপিথেকাস গণের অন্তর্ভুক্ত, আর ২০১৫ সালে পাওয়া ৩টি দাঁত হোমো গণের (যার অন্তর্ভুক্ত আধুনিক মানুষ) বলে চিহ্নিত হয়েছে। এই ফলাফল বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
মানব বিবর্তনের জটিলতা
সাধারণ ধারণা ছিল যে হোমো প্রজাতি এসেছে অস্ট্রালোপিথেকাসের পর, কিন্তু নতুন প্রমাণ বলছে তারা একই সময়ে টিকে ছিল। অস্ট্রালোপিথেকাস সোজা হয়ে হাঁটতে পারত, তবে তাদের মস্তিষ্ক ছিল তুলনামূলক ছোট। অপরদিকে হোমো প্রজাতির মস্তিষ্ক বড় হওয়ায় তা একধরনের বিবর্তনীয় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক কায়ে রিড বলেন, মানব বিবর্তনকে সরলরেখা ধরে এপ থেকে নিয়ান্ডারথাল হয়ে আধুনিক মানুষ হয়েছে — এই ধারণা ভুল। বাস্তবে বিবর্তন একটি ‘গাছের মতো ঝোপঝাড়’, যেখানে বহু প্রজাতি পাশাপাশি টিকে ছিল, আবার অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

লুসি থেকে নতুন প্রজাতির ইঙ্গিত
অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিসের সবচেয়ে বিখ্যাত জীবাশ্ম হলো ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ায় পাওয়া লুসি। মাত্র ১ মিটার উচ্চতার এই নারী পূর্বপুরুষের ছিল এপ-সদৃশ মুখ, ছোট মস্তিষ্ক, তবে হাঁটতে পারত সোজা হয়ে।
কিন্তু ২০১৮ ও ২০২০ সালের খননে পাওয়া নতুন দাঁত আফারেনসিস বা অন্য পরিচিত প্রজাতি গারহির সঙ্গে মেলেনি। ফলে গবেষকদের ধারণা, এটি হয়তো লুসির পরবর্তী এক নতুন অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতি, যে আবার প্রাথমিক হোমো প্রজাতির সঙ্গে পাশাপাশি বাস করত।
আফার অঞ্চলের গুরুত্ব
এই দাঁতগুলো পাওয়া গেছে ইথিওপিয়ার আফার অঞ্চলে, যেখান থেকে মানব বিবর্তন সম্পর্কিত বহু জীবাশ্ম ও প্রাচীন হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এখানকার সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন প্রায় ৫০ লক্ষ বছরের স্তর উন্মোচন করছে। আগ্নেয়গিরির ছাই ও স্ফটিকের মাধ্যমে এসব জীবাশ্মের বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।
নতুন দাঁতের বয়স ধরা হয়েছে প্রায় ২৬.৩ লক্ষ বছর, আর হোমো দাঁতগুলোর বয়স ২৫.৯ থেকে ২৭.৮ লক্ষ বছরের মধ্যে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো নির্দিষ্ট প্রজাতি চিহ্নিত করতে সতর্ক আছেন, কারণ আরও জীবাশ্ম প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
গবেষণার প্রধান ব্রায়ান ভিলমোয়ার বলেন, কেবল দাঁতের ভিত্তিতে পার্থক্য করা কঠিন, তবে এর মাধ্যমে বোঝা যায় অস্ট্রালোপিথেকাস ও হোমো একই স্থানে পাশাপাশি ছিল। দাঁতের আকার ও গঠনে এগুলো পরিচিত প্রজাতির সঙ্গে মেলেনি।
পেনসিলভানিয়ার মার্সিহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেফানি মেলিলো বলেন, এই আবিষ্কার ২০ থেকে ৩০ লক্ষ বছর আগের রহস্যময় সময়কে উন্মোচন করছে। কারণ সে সময়ের জীবাশ্ম তুলনামূলক কম পাওয়া গেছে।
পরিবেশ ও জীবনযাত্রা
মিলিয়ন বছর আগে আফার অঞ্চল ছিল অর্ধ-মরুভূমি নয়, বরং মৌসুমি ভেজা ও শুকনা ঋতুর মিশ্র পরিবেশ। সেখানকার নদী বছরের কিছু সময় পানি বহন করত, চারপাশ ছিল ঘাস ও জলাভূমি। জীবাশ্মে পাওয়া জিরাফ ঘাস খেত, যা তাদের খাদ্যাভাবের ইঙ্গিত দেয়।

গবেষকরা খুঁজছেন, হোমো ও অস্ট্রালোপিথেকাস একই খাদ্য খেত কি না, কিংবা সম্পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত কি না। দাঁতের ক্ষুদ্র দাগ ও রাসায়নিক বিশ্লেষণে এই বিষয়গুলো জানা সম্ভব হবে।
মানব বিবর্তনের ধাঁধা
এই আবিষ্কার দেখাচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস কোনো সরলরেখা নয়। বহু প্রজাতি ছিল, কেউ টিকে গেছে, কেউ হারিয়ে গেছে। গবেষক কায়ে রিড বলেন, প্রতিটি নতুন জীবাশ্ম মানব ইতিহাসের ধাঁধায় নতুন টুকরো যোগ করে। আমরা যেহেতু টিকে আছি, ইতিহাস আমাদের সঙ্গেই জুড়ে আছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















