পরিচিতি: পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ভালুক
সূর্যভালুক (Helarctos malayanus), যাকে ইংরেজিতে Sun Bear বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট আকারের ভালুক প্রজাতি। এর দেহ ছোট হলেও গঠন শক্তপোক্ত, মুখ ছোট ও গোল, এবং নখ লম্বা ও বাঁকানো। বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বুকে থাকা কমলা বা হলুদ রঙের অর্ধচন্দ্রাকৃতি দাগ, যা দেখতে অনেকটা সূর্যের মতো। এই কারণেই এদের নাম হয়েছে সূর্যভালুক।
খাবারের তালিকায় প্রধানত পিঁপড়া, উইপোকা, মধু, বিভিন্ন ফল ও বীজ থাকে। এরা গাছে উঠতে খুবই পারদর্শী এবং অনেক সময় গাছের ডালে ঘুমায় বা রোদ পোহায়। এদের জিহ্বা অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, ফলে মৌচাক বা পিঁপড়ার বাসা থেকে সহজেই খাবার বের করতে পারে।
বিস্তৃতি ও আবাস
সূর্যভালুক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আদি প্রাণী। উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম হয়ে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা এবং বোর্নিও দ্বীপপুঞ্জে এদের বিস্তৃতি ছিল এবং এখনো কিছুটা আছে। সাধারণত নিম্নভূমির চিরসবুজ ও আর্দ্র অরণ্যই এদের প্রধান আবাস।

চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসে উপস্থিতি
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সূর্যভালুকের উপস্থিতি অনিশ্চিত বলে ধরা হলেও, সাম্প্রতিক এক দশকে চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস এলাকায় এর নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্যামেরা-ট্র্যাপ জরিপে মাতামুহুরী ও সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্টে সূর্যভালুকের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় গ্রামবাসীদের বর্ণনা ও বন বিভাগের তথ্যেও এদের উপস্থিতি সমর্থন পেয়েছে।
এই উপস্থিতি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের পাহাড়ি অরণ্য এখনো সূর্যভালুকের জন্য শেষ আশ্রয়স্থলগুলোর একটি।
১০০ বছর আগে জনসংখ্যা ও অবস্থা
এক শতাব্দী আগে সূর্যভালুকের নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও ঐতিহাসিক বর্ণনা ও মানচিত্র অনুযায়ী দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের পাহাড়ি অরণ্যে তাদের বিস্তৃতি অনেক বেশি ছিল। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের অরণ্যে সূর্যভালুকের উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিল বলে গবেষকেরা ধারণা করেন।
কিন্তু বিগত শতকে বন উজাড়, বসতি সম্প্রসারণ, জুম চাষ, শিকার এবং বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্যের কারণে এ প্রজাতির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সূর্যভালুককে ‘সম্ভাব্য বিলুপ্ত’ বা কেবল ভ্রাম্যমাণ (vagrant) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে বাংলাদেশে সূর্যভালুককে অতি বিরল ও সংকটাপন্ন প্রজাতি হিসেবে ধরা হয়। চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস ছাড়া দেশের অন্য কোথাও তাদের উপস্থিতির প্রমাণ নেই। বৈশ্বিকভাবে IUCN সূর্যভালুককে Vulnerable বা হুমকির মুখে থাকা প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। গত তিন দশকে পৃথিবীব্যাপী এদের সংখ্যা প্রায় ৩০–৩৫% কমেছে।
বাংলাদেশে এখনো নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা গণনা করা সম্ভব হয়নি। তবে গবেষকরা বলছেন, পাহাড়ি অরণ্যের অখণ্ড অংশগুলো—বিশেষ করে মাতামুহুরী ও সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট—এই প্রজাতির শেষ আশ্রয়স্থল।
হুমকি ও সংকট
আবাস ধ্বংস: পাহাড়ি বনভূমি ক্রমেই উজাড় হচ্ছে, রাস্তাঘাট, বসতি ও চাষাবাদ বাড়ছে।
শিকার ও পাচার: মাংস, চর্বি ও অন্যান্য অঙ্গের অবৈধ বাণিজ্যের জন্য সূর্যভালুক শিকার হয়।
খণ্ডিত আবাসস্থল: বন খণ্ডিত হয়ে ছোট ছোট প্যাচে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, ফলে প্রজনন ও বেঁচে থাকা কঠিন হচ্ছে।
কম গবেষণা: দীর্ঘদিন সূর্যভালুক নিয়ে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি, ফলে কার্যকর নীতি গ্রহণ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংরক্ষণে করণীয়
- অখণ্ড বনভূমি রক্ষা:মাতামুহুরী–সাঙ্গু–কর্ণফুলী অঞ্চলের বনকে ‘নো-ডিস্টার্ব্যান্স কোর’ হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।
- গবেষণা ও জরিপ:নিয়মিত ক্যামেরা-ট্র্যাপ ও ডিএনএ-ভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে সংখ্যা ও বিস্তৃতি নির্ধারণ করা জরুরি।
- কমিউনিটি সম্পৃক্তকরণ:স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে অবৈধ শিকার বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।
- কঠোর আইন প্রয়োগ:সীমান্তপথে পাচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সূর্যভালুক একসময় বাংলাদেশের পাহাড়ি অরণ্যে তুলনামূলকভাবে বিস্তৃত ছিল। আজ থেকে শত বছর আগে তারা পূর্ববঙ্গের অরণ্যে স্বাভাবিকভাবে বিচরণ করত। কিন্তু বন উজাড় ও মানুষের কার্যকলাপের কারণে এখন তারা প্রায় বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে শুধু চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস অঞ্চলের অখণ্ড বনের ভেতরই সূর্যভালুকের অল্প কয়েকটি উপস্থিতি টিকে আছে।
এ প্রজাতিকে রক্ষা করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের পাহাড়ি অরণ্য থেকে সূর্যভালুক চিরতরে হারিয়ে যাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 









