বাংলাদেশের রপ্তানি খাত দীর্ঘদিন দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে সেই ধারায় ধীরগতি দেখা দিয়েছে। টানা দুই মাস ধরে রপ্তানি আয় কমে গেছে, যা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভূমিকা: রপ্তানির গতি হোঁচট খেল দুই মাসে
বাংলাদেশের রপ্তানি আয় দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তবে টানা দুই মাস—আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—দেশের পণ্য রপ্তানি কমেছে, যা প্রবৃদ্ধির ধারায় নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর সর্বশেষ তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর মাসে মোট রপ্তানি হয়েছে ৩৬৩ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ কম। এর আগের মাস আগস্টেও রপ্তানি কমেছিল প্রায় ৩ শতাংশ।
তবে পুরো চিত্র একেবারে মলিন নয়। নতুন অর্থবছর ২০২৫–২৬-এর প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) মোট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৩১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও সাম্প্রতিক ধীরগতি ভবিষ্যতের জন্য একটি সংকেত।
খাতভিত্তিক চিত্র: কে এগোল, কে পিছোল
ইপিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য এবং প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই কমতির পেছনে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নতুন শুল্কনীতি ও ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তৈরি পোশাক খাত: সাফল্যের মাঝেও অনিশ্চয়তা
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক (RMG) খাত থেকে। এই খাতই বর্তমানে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৪.৫ শতাংশ। কিন্তু আগস্টে তা কমে ৪.৯ শতাংশ, এবং সেপ্টেম্বরে এসে রপ্তানি আরও ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই সময়ে মোট তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ২৮৪ কোটি ডলার, যা গত তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন,
“যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ ক্রেতা নতুন ক্রয়াদেশ দিতে ধীরগতিতে চলছে। তারা অতিরিক্ত ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের একটি অংশ সরবরাহকারীদের ওপর চাপাতে চাইছে।”
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাজারেও প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। চীন ও ভারত, মার্কিন বাজারে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইউরোপে কম দামে পোশাক রপ্তানি করছে। ফলে বাংলাদেশের উৎপাদকরা মূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
চামড়াজাত ও জুতা খাত: আশাবাদের আলো
আগস্টে পতনের পর সেপ্টেম্বরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে এই খাতে রপ্তানি হয়েছে ৯ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।
মোট তিন মাসে এই খাতের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৯২ কোটি ডলার, যেখানে প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ।
লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (LFMEAB)-এর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান বলেন,
“আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়ে সাধারণত অর্ডার কম থাকে। তবে মার্কিন বাজারে চীনের চেয়ে কম শুল্ক সুবিধার কারণে অর্ডার বাংলাদেশে আসছে। ফলে আমরা শিগগিরই বড় প্রবৃদ্ধির আশা করছি।”
এই খাতের পুনরুদ্ধার বাংলাদেশের রপ্তানি বহুমুখীকরণের ইতিবাচক ইঙ্গিত।
কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য: ধীর উন্নতি, অদেখা সম্ভাবনা
কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি সেপ্টেম্বর মাসে হয়েছে ১০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম।
তবে পুরো ত্রৈমাসিকে রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ২৭ কোটি ৬৫ লাখ ডলার, যা ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের ফল, সবজি, মসলা ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এখন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারে ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু মান নিয়ন্ত্রণ, প্যাকেজিং এবং শুল্ক কাঠামোর দুর্বলতা এখনো বড় বাধা।
হোম টেক্সটাইল: স্থবিরতা কাটাতে চাই নতুন উদ্ভাবন
এক সময় বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী রপ্তানি খাত ছিল হোম টেক্সটাইল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতেও ধীরগতি চলছে।
সেপ্টেম্বরে রপ্তানি হয়েছে ৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ০.৫৪ শতাংশ কম।
তবে তিন মাস মিলিয়ে রপ্তানি হয়েছে ২১ কোটি ডলার, যা ৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি।
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউরোপীয় বাজারেও ‘স্লো সিজন’-এর প্রভাব পড়েছে।
অন্য খাতগুলো: প্রকৌশল, প্লাস্টিক ও পাট
জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি হয়েছে ১৬ কোটি ডলার।
চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি হয়েছে ১৩ কোটি ডলার,
হিমায়িত খাদ্য ১২ কোটি ৬১ লাখ ডলার,
এবং প্লাস্টিক পণ্য ৭ কোটি ডলার।
অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্য, একসময় বাংলাদেশের গর্ব হলেও, এখন বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। কাঁচা পাটের দাম ও রপ্তানি শুল্ক এ খাতের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।
চ্যালেঞ্জ: বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রভাব
রপ্তানির ধীরগতির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—
- যুক্তরাষ্ট্রের Reciprocal Tariff নীতি, যা কিছু পণ্যে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করছে।
- চীনের বাজারে মন্দা, ফলে আন্তর্জাতিক অর্ডার স্থানান্তর অস্থির হয়েছে।
- ইউরোপীয় অর্থনীতির ধীরগতি, যার প্রভাবে পোশাক ও হোম টেক্সটাইলের চাহিদা কমেছে।
- দেশীয় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি — গ্যাস, বিদ্যুৎ, শ্রম ও কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে।
- পরিবহন ও লজিস্টিক সমস্যা — বন্দর বিলম্ব ও কাস্টমস জটিলতা রপ্তানিতে বাধা দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করলে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রপ্তানির স্থিতি ফেরাতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এখন এক সন্ধিক্ষণে। রপ্তানি শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয় — এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক ভাবমূর্তি ও কর্মসংস্থানের জীবনরেখা।
#বাংলাদেশ_অর্থনীতি #রপ্তানি #তৈরি_পোশাক #বাণিজ্য #EPB #Export2025 #সারাক্ষণ_রিপোর্ট