ব্যাংক খাতে নতুন উত্থান
খেলাপি ঋণে নয়, বরং দাম বৃদ্ধিতে আলোচনায় এসেছে এক্সিম ব্যাংক। পুজোর ছুটি শেষে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ব্যাংক খাতে ছিল দাপট। চার দিনের বিরতির পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন শুরুর দিনে চমক দেখিয়েছে ব্যাংক খাতের শেয়ার। শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই ব্যাংক, আর তাদের মধ্যে তিনটি সেই ব্যাংক যারা একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
পুঁজিবাজারের বাস্তব চিত্র
শেয়ারবাজারকে ‘ফাটকা বাজার’ বলতে অনেক অর্থনীতিবিদ দ্বিধা করেন না। তবে বিনিয়োগ ও শিল্পপ্রকল্পে পুঁজি জোগানের সবচেয়ে ভালো উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারকেই ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে ব্যাংক ঋণ—যার বর্তমান পরিচিতি “খেলাপি”।
ঋণখেলাপির দায়ে এখন পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে গঠন করা হচ্ছে একটি বৃহৎ সরকারি মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক। গণমাধ্যমে এর খসড়া নামও পাওয়া যাচ্ছে।
শেয়ারবাজারে হঠাৎ উত্থান
গতকাল রবিবার এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে শেয়ারবাজারে। ব্যাংক খাতের শেয়ারে দেখা গেছে অস্বাভাবিক উত্থান। শীর্ষে ছিল এক্সিম ব্যাংক, তৃতীয় স্থানে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) এবং পঞ্চম স্থানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
দ্বিতীয় স্থানে ছিল প্রগতি ইনস্যুরেন্স, আর চতুর্থ স্থানে এবি ব্যাংক।
এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি
ডিএসই’র তথ্য অনুযায়ী, মূল্যবৃদ্ধির দিক থেকে রবিবার প্রথম স্থানে ছিল এক্সিম ব্যাংক। গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস মঙ্গলবার শেয়ারের দাম ছিল ৪ টাকা, রবিবার তা বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৪০ টাকা—অর্থাৎ বৃদ্ধি ১০ শতাংশ।
২১ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই শেয়ারটি ২.২০ থেকে ৩ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়েছিল। দুই সপ্তাহে আলোচিত এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের দাম কার্যত দ্বিগুণ হয়েছে, যদিও ব্যাংকটি এখনও গ্রাহকের টাকা যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ।
সরলভাবে বলা যায়, কেউ যদি গত সপ্তাহে ৩ টাকা দরে এক্সিম ব্যাংকের ৫ হাজার শেয়ার ১৫ হাজার টাকায় কিনে থাকে, তবে রবিবার তা ২০ হাজার টাকারও বেশি মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব ছিল।
সোশ্যাল ও ফার্স্ট সিকিউরিটির উত্থান
মূল্যবৃদ্ধির দিক থেকে রবিবার তৃতীয় স্থানে ছিল সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। মঙ্গলবার এর শেয়ারের দাম ছিল ৪ দশমিক ৪০ টাকা, যা রবিবার বেড়ে হয় ৪ দশমিক ৮০ টাকা—অর্থাৎ বৃদ্ধি ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই ব্যাংকের একটি শেয়ারের দাম ছিল ৩ থেকে ৩.৫০ টাকার মধ্যে। মাত্র এক সপ্তাহে বেড়েছে প্রায় ১ টাকা ৩০ পয়সা।
যে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, তাদের অন্যতম দাগী ব্যাংক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকও তালিকায় পঞ্চম। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে এর শেয়ারের দাম নেমেছিল ২ টাকার নিচে। রবিবার শেয়ারের দাম বেড়ে হয় ২ দশমিক ৮০ টাকা, যা ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধি।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর অতীত পতন
উল্লেখ করা প্রয়োজন, এসব শেয়ারের প্রতিটির ফেসভ্যালু ১০ টাকা। বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে এসআইবিএল ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। আর এক্সিম ব্যাংকের বড় অংশীদার নাসা গ্রুপের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদার।
এখন আবার ফিরে দেখা যাক অতীতের দিকে। যে পাঁচ ব্যাংক নিয়ে এত আলোচনা, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার, যিনি ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি)-এরও চেয়ারম্যান।
একীভূতকরণ ও বাজারমূল্যের পতন
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে এক্সিম ব্যাংক প্রায় দেউলিয়া পদ্মা ব্যাংককে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করার জন্য সমঝোতা স্মারকেও স্বাক্ষর করেছিল।
তবে গত এক বছরে একীভূত হতে যাওয়া এই পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারমূল্যের ব্যাপক পতন ঘটেছে।
গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মাত্র তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) এসব ব্যাংকের বাজারমূল্য কমেছে ৯২৬ কোটি টাকা।
২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এই ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে।
পতনের পরিসংখ্যান
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ১০ টাকার ফেসভ্যালুর বিপরীতে নেমেছে ২.৬ টাকায়, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১.৮ টাকায়, ইউনিয়ন ব্যাংকের ১.৯ টাকায়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪.৪ টাকায় এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪ টাকায়।
ডিএসই’র তথ্য অনুযায়ী, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বাজারমূল্য সবচেয়ে বেশি কমেছে—মাত্র তিন মাসে ৩৪২ কোটি টাকা হারিয়েছে।
গত ১৩ মাসে এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত বাজারমূল্য কমেছে ২,২৭৪ কোটি টাকা; এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের পতন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮৩ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট এই পাঁচ ব্যাংকের মোট বাজারমূল্য ছিল ৪,০৪৩ কোটি টাকা, শেয়ারের দাম ছিল ৬.১ থেকে ৮.১ টাকার মধ্যে।
কিন্তু ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে তা নেমে আসে ১.৮ থেকে ৪.৪ টাকার মধ্যে—যা সর্বোচ্চ ৭৩ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত পতন নির্দেশ করে।
ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, সরকারের পরিবর্তনের পর একীভূত হতে যাওয়া ইসলামী ব্যাংকগুলোর বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে মাত্র ১,৭৬৯ কোটি টাকায়।
#এক্সিমব্যাংক #শেয়ারবাজার #ইসলামীব্যাংক #ফার্স্টসিকিউরিটি #এসআইবিএল #বিনিয়োগ #অর্থনীতি #স্টকমার্কেট #ব্যাংকখাত