বিদ্যুৎচালিত গাড়ির বিপ্লব শুধু পরিবেশ রক্ষার লড়াই নয়—এটি আসলে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতির ক্ষমতার লড়াই। এই দৌড়ে চীন ইতিমধ্যেই সামনের সারিতে, আর যুক্তরাষ্ট্র ক্রমে হারাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের আসন। চীনের ইভি (EV) প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব এখন মার্কিন নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।
ব্যাটারির নিয়ন্ত্রণ মানেই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ
গাড়ি নয়—ব্যাটারিই এখন আধিপত্যের মূল কেন্দ্র। স্মার্টফোন থেকে ড্রোন, এমনকি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র—সবকিছুর শক্তির উৎস ব্যাটারি। আর এই খাতে চীন আজ বিশ্বের শীর্ষে। তারা তৈরি করেছে একটি পূর্ণাঙ্গ, উল্লম্বভাবে একীভূত ইভি সাম্রাজ্য—উৎপাদন, সরবরাহ শৃঙ্খল ও গবেষণা-উন্নয়ন—সবই একসঙ্গে।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্র চার্জিং স্টেশন ও বাণিজ্যনীতি নিয়ে দ্বিধায়, সেখানে চীন এগিয়ে গেছে রোবোটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও স্মার্ট সিটি প্রযুক্তির গভীরে। ওয়াশিংটনের সাবেক কর্মকর্তা ডেভিড ফেইথ বলেন, “একটি শক্তিশালী অটো সেক্টর মানে পুরো শিল্প শক্তির ভিত্তি—যা সামরিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করে।”
অর্থনীতি থেকে কৌশল—সবখানেই চীনের আগ্রাসন
চীনের ইভি পরিকল্পনা শুরু হয় ২০০৯ সালে—সরকারি ভর্তুকি, শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা ও বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জবাব হিসেবে। এখন তারা বিশ্বের মোট ইভি উৎপাদনের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী ২ কোটি ইভি বিক্রির মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ উৎপাদন করবে চীন।
চীনা কোম্পানি BYD নিজস্ব জাহাজ বহর দিয়ে রপ্তানি করছে হাজার হাজার ইভি, আর ২০২৪ সালেই দেশে বিক্রি হওয়া গাড়ির অর্ধেকের বেশি ছিল বৈদ্যুতিক। ২০২৬ নাগাদ এই হার ছুঁতে পারে ৬০ শতাংশ। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা এখনও মাত্র ১০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞ মাইকেল ডান সতর্ক করেছেন—“আমেরিকা যদি দ্রুত রূপান্তর না আনে, তাহলে ডেট্রয়েট আবারও ফিরে যাবে ১৯৫০ দশকের গ্যাসচালিত যুগে।”
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধা, চীনের সুযোগ
চীনা ইভি-র বাজার দখল এখন বৈশ্বিক। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, মেক্সিকো, এমনকি ব্রাজিলেও চীনা ব্র্যান্ড দাপট দেখাচ্ছে—সেখানে তাদের মার্কেট শেয়ার ৬৫ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত। শ্রম ব্যয় কম, সরবরাহ শৃঙ্খল পরিপূর্ণ, আর সরকারের অনুদান মিলিয়ে চীনের গড় ইভি দাম নেমে এসেছে মাত্র ২৬,০০০ ডলারে, যা গ্যাসচালিত গাড়ির সমান।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখন আমদানি সীমিত করার পথে। চীনা ইন্টারনেট-সংযুক্ত ইভি নিষিদ্ধ করা হয়েছে “নিরাপত্তা ঝুঁকি” দেখিয়ে—যেমন তথ্য গুপ্তচরবৃত্তি বা অবকাঠামো নজরদারির আশঙ্কা। যদিও এসব পদক্ষেপ প্রযুক্তিগত ব্যবধান কমাতে পারছে না।
নীতিগত শূন্যতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে থমকে আমেরিকা
বাইডেন প্রশাসন ১৭০ বিলিয়ন ডলারের ইভি বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু ট্রাম্পের নতুন নীতিতে ৭,৫০০ ডলারের ফেডারেল কর ছাড় বাতিল হয়, আর ৫ বিলিয়ন ডলারের চার্জিং নেটওয়ার্ক প্রকল্পও ঝুলে যায় আদালতে।
বিশ্লেষক ওয়েন্ডি কাটলার মনে করিয়ে দেন—এই দেরি মার্কিন সৌরশক্তি শিল্পের মতো ব্যর্থতা ডেকে আনতে পারে, যেখানে এখন চীন বিশ্বের ৮০ শতাংশ সোলার প্যানেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
গাড়ির চাকা ঘুরছে পূর্বের পথে
আজকের চীনা ইভি কেবল যান নয়, চলমান কম্পিউটার—টাচস্ক্রিন, ইনফোটেইনমেন্ট, এমনকি ড্রোন যুক্ত গাড়িও বাজারে। আর যুক্তরাষ্ট্র? হয়তো “আইস” ইঞ্জিনের দ্বীপে আটকে আছে—যেখানে নতুন প্রযুক্তির দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে আলোর গতিতে।
চীনের ইভি বিপ্লব তাই কেবল পরিবেশবান্ধব নয়, এটি এক নতুন ভূরাজনৈতিক অস্ত্র—যেখানে প্রযুক্তি, শক্তি ও সার্বভৌমত্ব একসঙ্গে জড়িয়ে আছে।