বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত অফিম খাইয়া স্বপ্ন দেখিতেন, কামাল আহমদ ইচ্ছা করিলে পৃথিবীর তাবৎ সুন্দর খাদ্য ও দামী মাদক সবই খাইতে পারেন।
তবে আজকাল তাহার একটা ভিন্ন অবস্থা হইয়াছে। তিনি জাগ্রত অবস্থায় একের পর এক স্বপ্ন দেখিয়া চলেন।
ডাক্তার দেখাইবেন মনে করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার বিজ্ঞ প্রফেসর বন্ধু বলিলেন, ডাক্তার ইহার কারণ খুঁজিয়া পাইবে না। আজকাল ডাক্তারগণ বড়ই ক্লিনিকাল টেস্টনির্ভর হইয়া গিয়াছেন, শরীরের সঙ্গে যে একটা পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক আছে তাহা তাহারা বোঝেন না।
কামাল আহমদ ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, তাহা হইলে তুমি কি আমাকে কবিরাজ বা হেকিম দেখাইতে বলিতেছ?
রাখাল বালক যেমন নির্দিষ্ট দূরে বসিয়া গরু-ছাগলকে উদর-পূর্তি করানোর কাজ করিয়া থাকে, প্রফেসর সাহেবও তেমনি সারা জীবন ছাত্রদের মগজ-পূর্তির কাজ করিয়াছেন। তাই তাহার পক্ষে অন্যের মগজে কিছু ঢুকাইবার কাজটি নতুন কিছু নহে।
তিনি বলিলেন, দেখুন আপনি একটি বিষয় বুঝিতেছেন না—শরীর কখনও একা থাকিতে পারে না।
কামাল আহমদ বলিলেন, আমাকে এই বয়সে কি তাহলে বিবাহ বা অন্য কোনো কিছুর কথা বলিতেছেন—যাহা ইদানিং আমার বয়সীদের লইয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি সুখাদ্য হইয়াছে। সত্য বলিয়া সেই সব ঘোরা-ফেরাকেও মানুষ মানিয়া লইতেছে।
প্রফেসর সাহেব জিহবা কাটিলেন, কাটিলেন মানে ভাব করিলেন। যেটা ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে অশরীরীদের লজ্জায় জিহবা কাটার যে বর্ণনা রাজশেখর বসু তাহার ভূষণ্ডীর মাঠে দিয়াছেন, তেমনি আর কি?
তিনি কামাল আহমদের দিকে বেশ শক্তভাবে তাকাইয়া বলিলেন, শরীর মনের সঙ্গে বহিয়া চলিয়া থাকে আর মন এমনই এক বস্তু যাহা কেহ দেখিতে পায় না—বাস্তবে তাহার নিজের কোনো অস্তিত্বই শরীরে নাই, তাহার পরেও পারিপার্শ্বিকের চাপ তাহার ওপরই বেশি পড়ে। তোমার ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটিয়াছে।
কামাল আহমদ আবারও জটিলতায় পড়িলেন, বলিলেন, পারিপার্শ্বিকের চাপ মানে?
প্রফেসর সাহেব বলিলেন, মহাকাশে যেমন মহাকর্ষকে অস্বীকার করিতে পারে না—যে যেখানে বাস করিবে সে ওই স্থানের কর্ষণকেও অস্বীকার করিতে পারিবে না।
যেমন মানব শিশু জন্মের পরে হরিণ শিশুদের সঙ্গে রাখিয়া আসিলে সে দ্রুত চার পায়ে দৌড়াতে শেখে। আবার ইদানিং বিজ্ঞানীরা বলিতেছেন, শিম্পাঞ্জি মানুষের সঙ্গে বাস করিয়া বুদ্ধিতে এআইকে হারাইয়া জিতিয়া যাইতেছে।
কামাল আহমদ বলিলেন, প্রফেসর আপনি কি জটিলতা সৃষ্টির জন্যই কেবল কথা বলিতেছেন?
প্রফেসর সাহেব বলিলেন, মোটেই নহে, আমি শিক্ষক মানুষ—এক কথায় প্রকাশ করানো যেমন ছাত্রদের শিখাইয়াছি, তেমনি আপনাকেও বলিতেছি, আপনি বর্তমানে সংস্কারের মহাকাশে বাস করিতেছেন। তাই আপনি না জানিলেও বৈশ্বিক গতির ফলে আপনার মাথায় কিছু সংস্কার ঘটিয়া গিয়াছে। সে কারণেই যে স্বপ্ন আগে আপনি ঘুমাইয়া দেখিতেন তাহা এখন জাগিয়া দেখিতেছেন।
কামাল আহমদ একটু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, আমি তো শুনিয়াছি, সংস্কারের ভ্রূণকে গর্ভপাত করা হইয়াছে। তাই তাহা লইয়া আর তো কোনো ঝামেলা থাকিবার কথা নহে। গর্ভপাতের পরে আর কোনো প্রমাণ থাকে না।
প্রফেসর বলিলেন, প্রমাণ বড় বিষয় নহে—বড় বিষয় হইল সংস্কারের ক্রিয়াকর্ম, যাহা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
পরিবেশ মানুষকে লম্বা বা খাটো করিয়া থাকে, গায়ের রঙ পরিবর্তন করিয়া থাকে। তাই সংস্কারের পরিবেশের প্রভাব তোমার মস্তিষ্কে পড়িয়াছে। আর এই পরিবেশেই তোমাকে ভুলাইয়া দিয়াছে তুমি জাগিয়া আছ নাকি ঘুমাইয়া আছ?
কামাল আহমদ স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন, তাহার স্থিরতা মানেই স্বপ্ন দেখা।
কামাল আহমদ স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিলেন—
তিনি এখন দিব্য চক্ষুষ্মান: তিনি দেখিতে পাইতেছেন—মসিনিন্দিতবর্ণের বিশাল বপু একজন তরুণ হিলি বন্দর হইতে ঘাড়ে করিয়া একশ কেজির পেঁয়াজের বস্তা লইয়া দ্রুত দৌড়াইতেছে—তাহার পিছে পিছে কিছু তরুণ-তরুণীও একই কাজ করিতেছে।
কামাল আহমদের চক্ষু আবারও মুদিয়া গেল—তিনি দেখিতেছেন, নবাগত মেদভূড়ির শরীর লইয়া একশ কেজির চাউলের বস্তা পিঠে লইয়া একইভাবে আরেক তরুণ বেনাপোল বন্দর হইতে দৌড়াইতেছে। আবার শরীর শীর্ণকায় হইলেও একটি তরুণী জিরার বস্তা কাঁধে লইয়াছেন—তাহার শরীর ও রঙ কেমন যেন জিরার সঙ্গে মিশিয়া যাইতেছে।
এমন সময় বিশাল গাড়ি হইতে নামিয়া রুদ্রচক্ষুর এক কৃষকায় তরুণ দ্রুত আলুর বস্তা পিঠে লইল—
দ্রুত তাহারা পোর্টের সীমানা পার হইয়া জোর গলায় স্লোগান ধরিল—ঢাকা না দিল্লি—ঢাকা, ঢাকা।
কিন্তু চাউল, আলু, পেঁয়াজ তাহা মানিল না। তাহাদের জাত্যাভিমানে বাধিল। তাহারা বলিয়া উঠিল—ঢাকা না দিল্লি—দিল্লি, দিল্লি।
সঙ্গে সঙ্গেই মসিনিন্দিতবর্ণের বিশাল বপু থেকে নবাগত মেদভূড়ি, জিরা সকলেই পেঁয়াজ, আলু ও চালের কাছে মাথা নত করিয়া বলিতে থাকিল—ঢাকা না দিল্লি—দিল্লি, দিল্লি।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present Word।

স্বদেশ রায় 



















