০২:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 18

ধীরেনদের বাসায়

এমন সময় কিরণদাদার ভগ্নীপতি সুরেনবাবু আসিয়া বাদ সাধিলেন। তিনি তাঁর শাশুড়িকে বলিলেন, “জসীম উদ্দীন মুসলমান। সে উপরতলার ঘরে থাকিবে আর আমি ব্রাহ্মণ-সন্তান থাকিব নিচের তলায়, ইহা কখনওই হইতে পারিবে না। তাহা ছাড়া সে আপনাদের চৌকিতে বসে। সেই চৌকিতে আমাকেও বসিতে হয়। এরূপ অনাচার চলিতে থাকিলে আর আমি শ্বশুর-বাড়িতে আসিব না।”

সুতরাং আমাকে এই বাড়ি হইতে চলিয়া আসিতে হইল। ছুটিছাটার দিনে যে সেখানে যাইয়া আমার বন্ধু ধীরেনের সঙ্গে পড়াশুনা করিব তাহারও কোনো উপায় রহিল না। পড়াশুনা তো দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া করা যায় না। কিন্তু সেই বাড়িতে যাইয়া বসিব কোথায়? তাঁহাদের চৌকিতেও বসা নিয়েধ হইল। এতদিন আমি মাত্র গ্রীষ্ম ও পূজার ছুটিতে এই বাড়িতে আসিয়া পড়াশুনা করিতাম। স্কুল চলার সময় বাড়িতেই থাকিতাম।

শ্রীশবাবুর বড় জামাতার আপত্তির জন্যই আমাকে তাঁহার বাড়ি হইতে চলিয়া আসিতে হইল। কিন্তু বাড়ির সকলেই আমাকে আগের মতোই স্নেহ করিতেন। তাঁহারা কেহ কেহ আমার চলিয়া আসাতে খুবই মর্মাহত হইয়াছিলেন। কিন্তু সেকালে কুলীন-ঘরের জামাতাকে অসন্তুষ্ট করিতে কেহই সাহস পাইলেন না। আমি যে জামাতার আপত্তির জন্য তাঁহাদের বাড়ি হইতে চলিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছিলাম তাহা বাড়ির-কর্তা শ্রীশবাবু জানিতেন না।

পূজার ছুটি শেষ হইয়া গেল। পরীক্ষার আর মাত্র এক মাস বাকি। আমার মোটেই পড়াশুনা হইতেছে না। একদিন ধীরেনের কাছে আমার অবস্থা জানাইলাম। ধীরেন আমাকে পরামর্শ দিল, “তুমি একটি মাদুর আর একটি বাক্স কিনিয়া আন। সেই বাক্সের উপর বসিয়া আমাদের চৌকিটাকে টেবিলের মতো করিয়া পড়াশুনা করিবে, আর রাত্রে তোমার মাদুরে ঘুমাইবে।”

ধীরেনের এই পরামর্শমতো আমি একটি বাক্স আর একটি মাদুর কিনিয়া আনিয়া আবার শ্রীশবাবুর বাসায় আসিয়া পড়াশুনা করিতে লাগিলাম। ধীরে ধীরে শীতকাল আসিয়া পড়িল। পড়ার ঘরের মেঝেয় শানের উপর মাদুর বিছাইয়া সামান্য একটি কম্বল গায়ে দিয়া আমি শীতে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে ঘুমাইয়া পড়িতাম।

একদিন অনেক রাত্রে কি একটা আইন-পুস্তক লইতে ধীরেনের বাবা শ্রীশবাবু নিচে আসিয়া আমাকে মাটিতে শুইয়া থাকিতে দেখিলেন। পরদিন তিনি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাদের এতগুলি চৌকি থাকিতে সাধু কেন মাটিতে শুইয়া ঘুমায়? এই শীতের রাত্রে মাটিতে শুইয়া ওর তো নিউমোনিয়া হইবে।” মা তাঁহাকে বড় জামাতা সুরেনবাবুর আপত্তির সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। শ্রীশবাবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, “তবে সাধুকে ওদের পড়ার-ঘরের পাশে আমার কাছারিঘরের ফরাসে শুইতে বলিয়া দিও।”

মাকে আর বলিতে হইল না। তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “আজ হইতে রাত্রে তুমি আমার ফরাসে শয়ন করিবে।”

এই বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার ঘটা বিশেষ ছিল না। মাঝে মাঝে শ্রীশবাবু ফেরিওয়ালা কশাইদের নিকট হইতে মাংস কিনিতেন। সেদিন মাকে বলিয়া দিতেন, “আজ সাধু আমাদের এখানে যেন খায়।” বাড়িতে কোনোদিন হাঁসের ডিম রান্না হইলেও তিনি আমাকে খাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিতেন।

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৬)

১১:০০:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ধীরেনদের বাসায়

এমন সময় কিরণদাদার ভগ্নীপতি সুরেনবাবু আসিয়া বাদ সাধিলেন। তিনি তাঁর শাশুড়িকে বলিলেন, “জসীম উদ্দীন মুসলমান। সে উপরতলার ঘরে থাকিবে আর আমি ব্রাহ্মণ-সন্তান থাকিব নিচের তলায়, ইহা কখনওই হইতে পারিবে না। তাহা ছাড়া সে আপনাদের চৌকিতে বসে। সেই চৌকিতে আমাকেও বসিতে হয়। এরূপ অনাচার চলিতে থাকিলে আর আমি শ্বশুর-বাড়িতে আসিব না।”

সুতরাং আমাকে এই বাড়ি হইতে চলিয়া আসিতে হইল। ছুটিছাটার দিনে যে সেখানে যাইয়া আমার বন্ধু ধীরেনের সঙ্গে পড়াশুনা করিব তাহারও কোনো উপায় রহিল না। পড়াশুনা তো দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া করা যায় না। কিন্তু সেই বাড়িতে যাইয়া বসিব কোথায়? তাঁহাদের চৌকিতেও বসা নিয়েধ হইল। এতদিন আমি মাত্র গ্রীষ্ম ও পূজার ছুটিতে এই বাড়িতে আসিয়া পড়াশুনা করিতাম। স্কুল চলার সময় বাড়িতেই থাকিতাম।

শ্রীশবাবুর বড় জামাতার আপত্তির জন্যই আমাকে তাঁহার বাড়ি হইতে চলিয়া আসিতে হইল। কিন্তু বাড়ির সকলেই আমাকে আগের মতোই স্নেহ করিতেন। তাঁহারা কেহ কেহ আমার চলিয়া আসাতে খুবই মর্মাহত হইয়াছিলেন। কিন্তু সেকালে কুলীন-ঘরের জামাতাকে অসন্তুষ্ট করিতে কেহই সাহস পাইলেন না। আমি যে জামাতার আপত্তির জন্য তাঁহাদের বাড়ি হইতে চলিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছিলাম তাহা বাড়ির-কর্তা শ্রীশবাবু জানিতেন না।

পূজার ছুটি শেষ হইয়া গেল। পরীক্ষার আর মাত্র এক মাস বাকি। আমার মোটেই পড়াশুনা হইতেছে না। একদিন ধীরেনের কাছে আমার অবস্থা জানাইলাম। ধীরেন আমাকে পরামর্শ দিল, “তুমি একটি মাদুর আর একটি বাক্স কিনিয়া আন। সেই বাক্সের উপর বসিয়া আমাদের চৌকিটাকে টেবিলের মতো করিয়া পড়াশুনা করিবে, আর রাত্রে তোমার মাদুরে ঘুমাইবে।”

ধীরেনের এই পরামর্শমতো আমি একটি বাক্স আর একটি মাদুর কিনিয়া আনিয়া আবার শ্রীশবাবুর বাসায় আসিয়া পড়াশুনা করিতে লাগিলাম। ধীরে ধীরে শীতকাল আসিয়া পড়িল। পড়ার ঘরের মেঝেয় শানের উপর মাদুর বিছাইয়া সামান্য একটি কম্বল গায়ে দিয়া আমি শীতে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে ঘুমাইয়া পড়িতাম।

একদিন অনেক রাত্রে কি একটা আইন-পুস্তক লইতে ধীরেনের বাবা শ্রীশবাবু নিচে আসিয়া আমাকে মাটিতে শুইয়া থাকিতে দেখিলেন। পরদিন তিনি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাদের এতগুলি চৌকি থাকিতে সাধু কেন মাটিতে শুইয়া ঘুমায়? এই শীতের রাত্রে মাটিতে শুইয়া ওর তো নিউমোনিয়া হইবে।” মা তাঁহাকে বড় জামাতা সুরেনবাবুর আপত্তির সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। শ্রীশবাবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, “তবে সাধুকে ওদের পড়ার-ঘরের পাশে আমার কাছারিঘরের ফরাসে শুইতে বলিয়া দিও।”

মাকে আর বলিতে হইল না। তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “আজ হইতে রাত্রে তুমি আমার ফরাসে শয়ন করিবে।”

এই বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার ঘটা বিশেষ ছিল না। মাঝে মাঝে শ্রীশবাবু ফেরিওয়ালা কশাইদের নিকট হইতে মাংস কিনিতেন। সেদিন মাকে বলিয়া দিতেন, “আজ সাধু আমাদের এখানে যেন খায়।” বাড়িতে কোনোদিন হাঁসের ডিম রান্না হইলেও তিনি আমাকে খাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিতেন।

চলবে…