সারাক্ষণ রিপোর্ট
২০২৫ সালের ২ মার্চ, একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, সিঙ্গাপুরের পুলাউ উবিন দ্বীপে এক সাবেক গ্রামপ্রধানের বাড়িতে জল ঝাড়ু দিচ্ছিলেন মাদাম ট্যান লুয়াই চিং-এর মেয়ে ও গৃহকর্মী। দুপুরে ৩.৪ মিটার উচ্চতার অস্বাভাবিক জোয়ারে আশপাশের সীমানা ছাপিয়ে সমুদ্রের পানি বাড়ির বারান্দায় ঢুকে পড়ে। আগামী ৩০ ও ৩১ মার্চেও এমন উচ্চ জোয়ার আসবে বলে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, যেটা আবারো বন্যার সম্ভাবনা তৈরি করেছে—বৃষ্টিপাত ছাড়াই।
৮৬ বছর বয়সী মাদাম ট্যান জানান, তিনি জীবনের পুরোটা উবিনে কাটিয়েছেন এবং প্রতি বছর অন্তত একবার এই বন্যার জন্য প্রস্তুত থাকেন।
স্প্রিং টাইড: স্বাভাবিক ঘটনা হলেও বিপদের বার্তা
এই ধরনের উচ্চ জোয়ারকে স্প্রিং টাইড বলা হয়, যা সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবী এক সরলরেখায় আসার ফলে ঘটে। এছাড়াও মৌসুমি বাতাসের প্রভাবে দ্বীপে আরও বেশি বন্যা দেখা যায়। বছরে কয়েকবার এই জোয়ার পাঁচটি নিচু এলাকায় পানি ছড়িয়ে দেয়—যার মধ্যে প্রধান গ্রাম এবং কয়েকটি সেতু অন্তর্ভুক্ত। এবার ১, ২ ও ৩ মার্চ এমন “দিবাকালীন বন্যা” দেখা গেছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ
সিঙ্গাপুরের জল ও উপকূল রক্ষা সংস্থা PUB জানিয়েছে, পুলাউ উবিনকে ভবিষ্যতে একটি নির্দিষ্ট গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যা উত্তর-পূর্ব উপকূল—পুংগোল ও পাশির রিসসহ—অঞ্চলে উপকূল রক্ষার সম্ভাব্য ব্যবস্থা চিহ্নিত করবে। ২১০০ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরের চারপাশে গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ ১.১৫ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
উবিনের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা
উবিন দ্বীপটি ঐতিহ্য ও প্রকৃতির জন্য জনপ্রিয়। এখানে সিঙ্গাপুরের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এবং চেক জাওয়া ওয়েটল্যান্ডস রয়েছে, যা ছয়টি ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে গঠিত—যেমন পাথুরে সৈকত, সামুদ্রিক ঘাসের খাল, কোরাল অংশ ইত্যাদি।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া উদ্যোগ
ন্যাশনাল পার্কস বোর্ড (NParks) উবিন দ্বীপের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা হিসেবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রধান গ্রামের পেছনে নতুন ড্রেন নির্মাণ, চেক জাওয়াগামী পথ উঁচু করা এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় কর্মকর্তাদের অবস্থান করা। ২ মার্চ দুপুরে কিছু এলাকায় পানি হাঁটু পর্যন্ত উঠেছিল।
বন্যা সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগ
প্রধান গ্রামের ওয়ায়াং স্টেজের কাছে সাগরের পাশের একটি ড্রেন ২০২৪ সালে উন্নত করা হলেও এবার তা উপচে পড়ে। বন্যা প্রায় দুই ঘণ্টা স্থায়ী হলেও বেশিরভাগ দর্শনার্থী তেমন বিরক্ত হননি—অনেকে পানির মধ্যে হাঁটলেন, কেউ দোকানে অপেক্ষা করলেন, আবার কিছু শিশু পানিতে খেলল।
মাদাম ট্যান বললেন, এবারের বন্যা তুলনামূলকভাবে কম সমস্যার ছিল। কয়েক বছর আগে পুরো ঘর ভিজে গিয়েছিল। তখন তাঁরা সব ইলেকট্রনিক ও কাপড়ের আসবাবপত্র উঁচু স্থানে রেখে সুরক্ষিত করেছিলেন।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিরক্ষা
কেউ কেউ নিজের উদ্যোগে বাড়ির অংশ উঁচু করে নিয়েছেন। মেরি ট্যান, যিনি একটি বাইসাইকেল ভাড়া ও ডেজার্ট দোকানে কাজ করেন, তাঁর ঘরের কিছু অংশ প্রায় ২০ সেন্টিমিটার সিমেন্ট দিয়ে উঁচু করেছেন, যেন পানি না ঢুকে। তবে রান্নাঘর এলাকার নিচে থাকা ড্রেন উপচে পড়ায় সেখানেও পানি জমে যায়।
উবিনে বাইসাইকেল ভাড়া বড় ব্যবসা। কিন্তু সাগরের লবণ পানি ধাতব বাইকের জন্য ক্ষতিকর। তাই দোকান মালিকরা দ্রুত বাইক ধুয়ে ফেলেন। ৭০ বছর বয়সী লিম চাই হি তাঁর দোকান বাড়ি নম্বর ২৫ ও ২৮-এ বেশিরভাগ বাইক রাখেন, যেগুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি এবং তাঁর ছেলে কাঠের ফ্রেম দিয়ে মেঝেতে একটি স্তর তৈরি করেছেন, যাতে বাইকগুলো পানির ওপরে থাকে।
আগামী পরিকল্পনা ও সম্ভাব্য সমাধান
২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে চাঙ্গি ও গ্রেটার সাউদার্ন ওয়াটারফ্রন্ট এলাকার জন্য উপকূল রক্ষা পরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে। সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে সীওয়াল, বাঁধ ও কৃত্রিম উঁচু জমি গঠনের কথা ভাবা হচ্ছে।
উপসংহার
উবিন দ্বীপের মানুষরা প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হুমকি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদে বিজ্ঞানসম্মত ও টেকসই সমাধান প্রয়োজন।