০৮:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

ট্রাম্প কূটনীতিকে ধ্বংসাত্মক মনে হলেও উদ্দেশ্য এশিয়ায় একটি সহযাত্রী জোট

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের ছয় মাসও হয়নি, এরই মধ্যে তার প্রশাসনের বৈদেশিক নীতি দেশে ও বিদেশে বিস্তৃত হতাশা ও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর শুল্ক আরোপ, কানাডা, গ্রীনল্যান্ড ও পানামা সংযুক্ত করার হুমকি এবং ওয়াশিংটনের সবচেয়ে কাছের অংশীদারদের সরাসরি সমালোচনা – সবকিছুই অভিজ্ঞ নীতিনির্ধারকদের কাছে স্বেচ্ছাচারী ও ধ্বংসাত্মক মনে হচ্ছে। তাদের ধারণা, জটিল বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করতে হলে মিত্রতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নরম ক্ষমতা দরকার – যা ট্রাম্প প্রশাসন ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর।

এই নীতিগুলোর কিছু অংশ বোধগম্য না হলেও এর পেছনে একটি যুক্তি আছে। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক শৃঙ্খলা গড়ার আগের কৌশলটি ভুল ছিল এবং এতে আমেরিকার শক্তি ক্ষয় হয়েছে। তারা মনে করে নরম শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা আসলে অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং অতিরিক্ত প্রসার তৈরি করেছে, আর শক্ত নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি মিত্রদের আত্মনির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে।

এখন ট্রাম্প প্রশাসন বৈশ্বিক শৃঙ্খলা গড়তে নয়, বরং একটি সীমিত ও লক্ষ্যভিত্তিক কৌশল নিচ্ছে: অগ্রাধিকার নির্ধারণ। যুক্তি খুব সরল – যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ সীমিত এবং চীন সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক হুমকি। তাই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মিত্রদের নিজেদের দায়িত্ব নিতে উৎসাহিত করে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় মনোযোগ দিতে চায়।

এখনো এই অগ্রাধিকারের কৌশল ট্রাম্প প্রশাসনের একমাত্র পথ নয়। তবে এই নীতি তাদের ভাষা ও কাজে স্পষ্ট। মার্চে পেন্টাগনে প্রচলিত অন্তর্বর্তী জাতীয় প্রতিরক্ষা নির্দেশনায় প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ চীনকে “ডিপার্টমেন্টের একমাত্র গতি নির্ধারক হুমকি” হিসেবে বর্ণনা করেন। তাইওয়ানের দখল রুখে দেয়া এবং একসাথে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড রক্ষা করা “ডিপার্টমেন্টের একমাত্র গতি নির্ধারক দৃশ্যকল্প” হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এই ধারণা এলব্রিজ কলবি বহুদিন ধরেই তুলে ধরছেন। তিনি এখন প্রতিরক্ষা নীতির আন্ডার সেক্রেটারি এবং তার ২০২১ সালের বই “দ্য স্ট্র্যাটেজি অফ ডিনায়াল”-এ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য এশিয়ায় একটি “বিরোধী-হেজেমনিক জোট” গঠন করা বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এই কৌশল ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা করে। ন্যাটো মিত্রদের সাথে কঠিন ভাষা ব্যবহার করা হয় যাতে তারা বুঝতে পারে যে ওয়াশিংটনের ওপর আর নির্ভর করা যাবে না এবং নিজেদের প্রতিরক্ষা বাড়াতে হবে। ইউক্রেনে যুদ্ধ দ্রুত শেষ করে শান্তি আনা যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় মনোযোগ দিতে সেনা হ্রাসের সুযোগ দেবে। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তিচুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতপার্থক্যও এর সাথে সম্পর্কিত – ইউরোপ চায় যুক্তরাষ্ট্র বড় ভূমিকা নিক, আর ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয়দের কাঁধেই দায়িত্ব চাপিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।

অগ্রাধিকার নির্ধারণের এই নীতির শিকড় ট্রাম্পেরও আগে। ওবামা প্রশাসন থেকে শুরু করে সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই ইউরোপ থেকে এশিয়ায় মনোযোগ সরাতে চেয়েছেন। যদি ট্রাম্প প্রশাসন এই বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে, ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টরা সহজে সেটা ফিরিয়ে নেবেন না।

১৯৪০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র “সংযম” (containment) কৌশল নিয়েছিল। প্রথমে এই নীতিতে সমস্যা ছিল, পরে তা সংশোধিত হয়। অগ্রাধিকার কৌশলেরও দুর্বলতা আছে – যদিও এটি সীমিত সম্পদের বাস্তবতা মেনে চলে, তবু ট্রাম্প প্রশাসন প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়েছে। আবার, এই নীতি পূর্ব এশিয়ায় চীনের আধিপত্য ঠেকাতে চাইলেও কিছু পদক্ষেপ অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করছে।

কৌশলগত সমীকরণ

তিন দশক ধরে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছে একটি উদার আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা গড়তে ও নেতৃত্ব দিতে। ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে এটি একটি কল্পনা। বৈশ্বিক রাজনীতি বদলানোর প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ, অতি-প্রসারিত সামরিক উপস্থিতি এবং সুবিধাভোগী মিত্রদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ন্যায়সঙ্গত শরণার্থী অধিকার বা মুক্ত বাণিজ্যের মতো আদর্শ দেশীয় শিল্পশক্তি ও সীমান্তনিয়ন্ত্রণ ক্ষয় করেছে।

অগ্রাধিকার কৌশল এই বৈদেশিক নীতিকে পুনর্গঠন করে দেশের নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও সামাজিক সংহতিকে কেন্দ্রে আনে। তবে এটি নিছক স্বতন্ত্রতাবাদ নয়। বরং এটি একাকি চলা এবং বিশ্ব নেতৃত্বের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান – যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদকে অতি-প্রসার থেকে বাঁচিয়ে সবচেয়ে বড় হুমকি চীনের উত্থান মোকাবেলায় কেন্দ্রীভূত করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ সংকট এবং সামরিক ব্যয়

যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ এখন ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার, যা প্রায় জিডিপির সমান। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ছয় শতাংশেরও বেশি। Medicare ও Social Security খরচ বৃদ্ধির কারণে এই চাপ বাড়বে। এই অবস্থায় বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যয় চালানো কঠিন হয়ে যাবে।

অন্যদিকে চীন এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী – অর্থনৈতিক সমকক্ষ এবং বহু প্রযুক্তিতে শীর্ষে। সামরিক শক্তি ও পারমাণবিক অস্ত্রাগারও দ্রুত বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকে, তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মনোযোগ দেওয়ার সময় ও সম্পদ কমে যাবে।

অগ্রাধিকার কৌশল বাস্তববাদী। ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয় যুদ্ধে জড়াতে। আজ সেই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এশিয়া। রাশিয়া আগ্রাসী হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। ইউরোপের দেশগুলো চাইলে রাশিয়াকে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু এশিয়ায় চীনের জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি ক্ষমতা বেশি। দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে “গ্রে জোন” কৌশল ব্যবহার করে চীন নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে। তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নকরণ, সাইবার আক্রমণ, সামরিক অনুপ্রবেশ – সবই এই নীতির অংশ।

ইউরোপে অবস্থান হ্রাস ও মিত্রদের দায়িত্ব

অগ্রাধিকার কৌশল বলছে – ইউরোপে সেনা কমাতে হবে। মিত্রদের নিজেদের প্রতিরক্ষা বাড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র শেষ ভরসা হিসেবে থাকবে। ইউরোপকে বুঝতে হবে যে ওয়াশিংটন প্রথম লাইনে থাকবে না।

এশিয়া-কেন্দ্রিক ধারা

ওবামা ২০১১ সালে এশিয়া-পিভট ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধ, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল – সব মিলিয়ে সেই চেষ্টা থেমে যায়। ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসন আবার এশিয়া-কেন্দ্রিক হয়। ন্যাটো বাজেট নিয়ে ইউরোপের মিত্রদের সমালোচনা করে। জার্মানি থেকে ১২ হাজার সেনা সরানোর ঘোষণাও আসে।

বাইডেন প্রশাসন ইউরোপের সাথে সম্পর্ক মেরামত করে, তবে এশিয়াতেও মনোযোগ বাড়াতে চেয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার সেই কৌশলের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় সংঘাত আবার এশিয়ার পিভটকে পেছনে ঠেলে দেয়।

দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন এবার সেই “পিভট” কার্যকর করছে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় প্রস্তুতি বাড়ানো, চীনের প্রভাব রোধে বাণিজ্য ও প্রযুক্তি উদ্যোগ, মিত্রদের কাছ থেকে বেশি প্রতিরক্ষা ব্যয় দাবি – সবই এর অংশ।

ইউরোপে নতুন বাস্তবতা

দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিনেই ইউরোপে লড়াইয়ে নামার পরিকল্পনা করত। এখন যুক্তরাষ্ট্র পরে এবং কম শক্তি নিয়ে আসার কৌশল নেবে। এই সুরক্ষার জাল তুলে নিলে ইউরোপীয় মিত্রদের নিজেদের শক্তি বাড়াতে হবে।

সমালোচনা ও উদ্বেগ

এই কৌশল সমালোচনার মুখে। ইউরোপীয় মিত্ররা মনে করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা ছেড়ে দিচ্ছে। এমনকি ন্যাটোর পারমাণবিক শেয়ারিং প্রোগ্রামও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইউরোপ হয়তো যৌথ পারমাণবিক বাহিনী গড়বে বা জার্মানি-পোল্যান্ড আলাদা পারমাণবিক অস্ত্র খুঁজবে।

এশিয়ার মিত্রদের প্রতিক্রিয়া

যখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে ব্যস্ত ছিল, এশিয়ার মিত্ররা কম খরচে মার্কিন নিরাপত্তা পেয়েছে। জাপান ও তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা বাজেট খুবই সীমিত ছিল। এখন ট্রাম্প প্রশাসন চায় এরা নিজেরা বেশি খরচ করুক। তবে এই পরিবর্তন সহজ হবে না।

চীনের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের ঝুঁকি

অগ্রাধিকার নীতি চীনের বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক। তাইওয়ান রক্ষার প্রতিশ্রুতি আসলে পারমাণবিক শক্তিধর চীনের সাথে যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করে।

ভবিষ্যতে মার্কিন প্রশাসন কিছুটা নরম হতে পারে। বিদেশি সাহায্য পুনরায় চালু করতে পারে, ন্যাটোর সাথে সম্পর্ক মেরামত করতে পারে। তবে ইউরোপ থেকে যেসব প্রতিরক্ষা সম্পদ সরিয়ে নেয়া হবে, তা আর ফিরিয়ে নেয়া হবে না।

যেমন ঠান্ডা যুদ্ধে “সংযম” নীতি সময়ের সাথে পাল্টেছে, এই “অগ্রাধিকার” নীতিও সময়ের সাথে উন্নত করতে হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর এশিয়া-কেন্দ্রিক এবং চীন-কেন্দ্রিক থাকবে – এটা এখন নিশ্চিত।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

জেডআই খান পান্নার নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা

ট্রাম্প কূটনীতিকে ধ্বংসাত্মক মনে হলেও উদ্দেশ্য এশিয়ায় একটি সহযাত্রী জোট

০৮:০০:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের ছয় মাসও হয়নি, এরই মধ্যে তার প্রশাসনের বৈদেশিক নীতি দেশে ও বিদেশে বিস্তৃত হতাশা ও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর শুল্ক আরোপ, কানাডা, গ্রীনল্যান্ড ও পানামা সংযুক্ত করার হুমকি এবং ওয়াশিংটনের সবচেয়ে কাছের অংশীদারদের সরাসরি সমালোচনা – সবকিছুই অভিজ্ঞ নীতিনির্ধারকদের কাছে স্বেচ্ছাচারী ও ধ্বংসাত্মক মনে হচ্ছে। তাদের ধারণা, জটিল বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করতে হলে মিত্রতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নরম ক্ষমতা দরকার – যা ট্রাম্প প্রশাসন ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর।

এই নীতিগুলোর কিছু অংশ বোধগম্য না হলেও এর পেছনে একটি যুক্তি আছে। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক শৃঙ্খলা গড়ার আগের কৌশলটি ভুল ছিল এবং এতে আমেরিকার শক্তি ক্ষয় হয়েছে। তারা মনে করে নরম শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা আসলে অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং অতিরিক্ত প্রসার তৈরি করেছে, আর শক্ত নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি মিত্রদের আত্মনির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে।

এখন ট্রাম্প প্রশাসন বৈশ্বিক শৃঙ্খলা গড়তে নয়, বরং একটি সীমিত ও লক্ষ্যভিত্তিক কৌশল নিচ্ছে: অগ্রাধিকার নির্ধারণ। যুক্তি খুব সরল – যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ সীমিত এবং চীন সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক হুমকি। তাই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মিত্রদের নিজেদের দায়িত্ব নিতে উৎসাহিত করে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় মনোযোগ দিতে চায়।

এখনো এই অগ্রাধিকারের কৌশল ট্রাম্প প্রশাসনের একমাত্র পথ নয়। তবে এই নীতি তাদের ভাষা ও কাজে স্পষ্ট। মার্চে পেন্টাগনে প্রচলিত অন্তর্বর্তী জাতীয় প্রতিরক্ষা নির্দেশনায় প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ চীনকে “ডিপার্টমেন্টের একমাত্র গতি নির্ধারক হুমকি” হিসেবে বর্ণনা করেন। তাইওয়ানের দখল রুখে দেয়া এবং একসাথে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড রক্ষা করা “ডিপার্টমেন্টের একমাত্র গতি নির্ধারক দৃশ্যকল্প” হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এই ধারণা এলব্রিজ কলবি বহুদিন ধরেই তুলে ধরছেন। তিনি এখন প্রতিরক্ষা নীতির আন্ডার সেক্রেটারি এবং তার ২০২১ সালের বই “দ্য স্ট্র্যাটেজি অফ ডিনায়াল”-এ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য এশিয়ায় একটি “বিরোধী-হেজেমনিক জোট” গঠন করা বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এই কৌশল ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা করে। ন্যাটো মিত্রদের সাথে কঠিন ভাষা ব্যবহার করা হয় যাতে তারা বুঝতে পারে যে ওয়াশিংটনের ওপর আর নির্ভর করা যাবে না এবং নিজেদের প্রতিরক্ষা বাড়াতে হবে। ইউক্রেনে যুদ্ধ দ্রুত শেষ করে শান্তি আনা যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় মনোযোগ দিতে সেনা হ্রাসের সুযোগ দেবে। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তিচুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতপার্থক্যও এর সাথে সম্পর্কিত – ইউরোপ চায় যুক্তরাষ্ট্র বড় ভূমিকা নিক, আর ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয়দের কাঁধেই দায়িত্ব চাপিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।

অগ্রাধিকার নির্ধারণের এই নীতির শিকড় ট্রাম্পেরও আগে। ওবামা প্রশাসন থেকে শুরু করে সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই ইউরোপ থেকে এশিয়ায় মনোযোগ সরাতে চেয়েছেন। যদি ট্রাম্প প্রশাসন এই বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে, ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টরা সহজে সেটা ফিরিয়ে নেবেন না।

১৯৪০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র “সংযম” (containment) কৌশল নিয়েছিল। প্রথমে এই নীতিতে সমস্যা ছিল, পরে তা সংশোধিত হয়। অগ্রাধিকার কৌশলেরও দুর্বলতা আছে – যদিও এটি সীমিত সম্পদের বাস্তবতা মেনে চলে, তবু ট্রাম্প প্রশাসন প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়েছে। আবার, এই নীতি পূর্ব এশিয়ায় চীনের আধিপত্য ঠেকাতে চাইলেও কিছু পদক্ষেপ অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করছে।

কৌশলগত সমীকরণ

তিন দশক ধরে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছে একটি উদার আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা গড়তে ও নেতৃত্ব দিতে। ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে এটি একটি কল্পনা। বৈশ্বিক রাজনীতি বদলানোর প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ, অতি-প্রসারিত সামরিক উপস্থিতি এবং সুবিধাভোগী মিত্রদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ন্যায়সঙ্গত শরণার্থী অধিকার বা মুক্ত বাণিজ্যের মতো আদর্শ দেশীয় শিল্পশক্তি ও সীমান্তনিয়ন্ত্রণ ক্ষয় করেছে।

অগ্রাধিকার কৌশল এই বৈদেশিক নীতিকে পুনর্গঠন করে দেশের নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও সামাজিক সংহতিকে কেন্দ্রে আনে। তবে এটি নিছক স্বতন্ত্রতাবাদ নয়। বরং এটি একাকি চলা এবং বিশ্ব নেতৃত্বের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান – যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদকে অতি-প্রসার থেকে বাঁচিয়ে সবচেয়ে বড় হুমকি চীনের উত্থান মোকাবেলায় কেন্দ্রীভূত করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ সংকট এবং সামরিক ব্যয়

যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ এখন ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার, যা প্রায় জিডিপির সমান। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ছয় শতাংশেরও বেশি। Medicare ও Social Security খরচ বৃদ্ধির কারণে এই চাপ বাড়বে। এই অবস্থায় বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যয় চালানো কঠিন হয়ে যাবে।

অন্যদিকে চীন এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী – অর্থনৈতিক সমকক্ষ এবং বহু প্রযুক্তিতে শীর্ষে। সামরিক শক্তি ও পারমাণবিক অস্ত্রাগারও দ্রুত বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকে, তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মনোযোগ দেওয়ার সময় ও সম্পদ কমে যাবে।

অগ্রাধিকার কৌশল বাস্তববাদী। ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয় যুদ্ধে জড়াতে। আজ সেই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এশিয়া। রাশিয়া আগ্রাসী হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। ইউরোপের দেশগুলো চাইলে রাশিয়াকে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু এশিয়ায় চীনের জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি ক্ষমতা বেশি। দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে “গ্রে জোন” কৌশল ব্যবহার করে চীন নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে। তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নকরণ, সাইবার আক্রমণ, সামরিক অনুপ্রবেশ – সবই এই নীতির অংশ।

ইউরোপে অবস্থান হ্রাস ও মিত্রদের দায়িত্ব

অগ্রাধিকার কৌশল বলছে – ইউরোপে সেনা কমাতে হবে। মিত্রদের নিজেদের প্রতিরক্ষা বাড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র শেষ ভরসা হিসেবে থাকবে। ইউরোপকে বুঝতে হবে যে ওয়াশিংটন প্রথম লাইনে থাকবে না।

এশিয়া-কেন্দ্রিক ধারা

ওবামা ২০১১ সালে এশিয়া-পিভট ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধ, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল – সব মিলিয়ে সেই চেষ্টা থেমে যায়। ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসন আবার এশিয়া-কেন্দ্রিক হয়। ন্যাটো বাজেট নিয়ে ইউরোপের মিত্রদের সমালোচনা করে। জার্মানি থেকে ১২ হাজার সেনা সরানোর ঘোষণাও আসে।

বাইডেন প্রশাসন ইউরোপের সাথে সম্পর্ক মেরামত করে, তবে এশিয়াতেও মনোযোগ বাড়াতে চেয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার সেই কৌশলের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় সংঘাত আবার এশিয়ার পিভটকে পেছনে ঠেলে দেয়।

দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন এবার সেই “পিভট” কার্যকর করছে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় প্রস্তুতি বাড়ানো, চীনের প্রভাব রোধে বাণিজ্য ও প্রযুক্তি উদ্যোগ, মিত্রদের কাছ থেকে বেশি প্রতিরক্ষা ব্যয় দাবি – সবই এর অংশ।

ইউরোপে নতুন বাস্তবতা

দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিনেই ইউরোপে লড়াইয়ে নামার পরিকল্পনা করত। এখন যুক্তরাষ্ট্র পরে এবং কম শক্তি নিয়ে আসার কৌশল নেবে। এই সুরক্ষার জাল তুলে নিলে ইউরোপীয় মিত্রদের নিজেদের শক্তি বাড়াতে হবে।

সমালোচনা ও উদ্বেগ

এই কৌশল সমালোচনার মুখে। ইউরোপীয় মিত্ররা মনে করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা ছেড়ে দিচ্ছে। এমনকি ন্যাটোর পারমাণবিক শেয়ারিং প্রোগ্রামও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইউরোপ হয়তো যৌথ পারমাণবিক বাহিনী গড়বে বা জার্মানি-পোল্যান্ড আলাদা পারমাণবিক অস্ত্র খুঁজবে।

এশিয়ার মিত্রদের প্রতিক্রিয়া

যখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে ব্যস্ত ছিল, এশিয়ার মিত্ররা কম খরচে মার্কিন নিরাপত্তা পেয়েছে। জাপান ও তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা বাজেট খুবই সীমিত ছিল। এখন ট্রাম্প প্রশাসন চায় এরা নিজেরা বেশি খরচ করুক। তবে এই পরিবর্তন সহজ হবে না।

চীনের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের ঝুঁকি

অগ্রাধিকার নীতি চীনের বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক। তাইওয়ান রক্ষার প্রতিশ্রুতি আসলে পারমাণবিক শক্তিধর চীনের সাথে যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করে।

ভবিষ্যতে মার্কিন প্রশাসন কিছুটা নরম হতে পারে। বিদেশি সাহায্য পুনরায় চালু করতে পারে, ন্যাটোর সাথে সম্পর্ক মেরামত করতে পারে। তবে ইউরোপ থেকে যেসব প্রতিরক্ষা সম্পদ সরিয়ে নেয়া হবে, তা আর ফিরিয়ে নেয়া হবে না।

যেমন ঠান্ডা যুদ্ধে “সংযম” নীতি সময়ের সাথে পাল্টেছে, এই “অগ্রাধিকার” নীতিও সময়ের সাথে উন্নত করতে হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর এশিয়া-কেন্দ্রিক এবং চীন-কেন্দ্রিক থাকবে – এটা এখন নিশ্চিত।