০২:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
শিক্ষার্থী-শিক্ষকের প্রেমের গল্প নিয়ে বিতর্কে বন্ধ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে-ড্রামা পাকিস্তানে সীমাহীন শ্রমিক শোষণ আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাসাদে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক: ক্লিওপেট্রা ও সিজারের কথোপকথন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৪৯) বাংলাদেশে ইভ টিজিং- নারী মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতার সংকট এপি’র প্রতিবেদন: হাসিনা-বিরোধী বিদ্রোহের পরিণতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ মধুমতী নদী: দক্ষিনের যোগাযোগ পথ মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল ধ্বংস করা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর চিরসবুজ নায়িকা মৌসুমী: রূপালী পর্দার এক যুগের প্রতীক কাপ্তাই লেকের মাছের বৈচিত্র্য ও মাছ ধরার রীতি – পার্বত্য চট্টগ্রামের জলে জীবনের গল্প

থিয়েটার: ঔপনিবেশিক বিরোধিতা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও  স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে

উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে থিয়েটারের জন্ম

ভারতের উপমহাদেশে থিয়েটার কখনো নিছক বিনোদনের মাধ্যম ছিল না। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ও বিশ শতকের গোড়ায় থিয়েটার হয়ে ওঠে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সচেতনতার হাতিয়ার। কলকাতায় বেথুন থিয়েটার থেকে শুরু করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চ নাটকে দেশপ্রেম, বঞ্চিত মানুষের বেদনা, এবং শোষণের বিরুদ্ধ ভাষা প্রকাশ পেতে থাকে।

বাংলার নাট্যকাররা বুঝেছিলেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছড়াতে থিয়েটার গুরুত্বপূর্ণ। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা নাটকগুলোতে ইংরেজ শাসনের অন্যায়, ইতিহাসের বীরত্বগাথা, এবং আত্মমর্যাদার বার্তা উঠে আসে। ‘শাহজাহান’, ‘মীর কাসিম’, ‘নূরজাহান’ – এসব নাটক কেবল ইতিহাস নয়, সমসাময়িক শাসনের বিরুদ্ধে রূপক।

বাংলা থিয়েটার ও ব্রিটিশ সেন্সরশিপ

ব্রিটিশ সরকার এই সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ টের পেয়েছিল। ১৮৭৬ সালে ড্রামাটিক পারফরম্যান্সেস অ্যাক্ট (Dramatic Performances Act) করা হয়, যাতে “বিদ্রোহী” নাটকগুলোকে সেন্সর করা যায়। তবু থেমে যায়নি থিয়েটার আন্দোলন। মানুষ গোপনে নাটক মঞ্চস্থ করেছে, কবিগান, যাত্রা, পালা – সব মাধ্যমেই ইংরেজদের শোষণের গল্প উঠে এসেছে।

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে থিয়েটার

বাংলাদেশে থিয়েটার রাজনৈতিক চেতনার ধারক হয়ে ওঠে ১৯৪৭ এর পর। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার জন্য মঞ্চ নাটক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর এক নতুন ধরনের থিয়েটারচর্চা দেখা যায়। “ভাষা” নিয়ে নাটক, কবিতা আবৃত্তি, ছোট নাটিকা—এসবেই ভাষার দাবি উঠে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজের নাট্যদলগুলো এ সময় মঞ্চে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় থিয়েটার

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থিয়েটার একেবারে যুদ্ধে নেমে আসে। মুক্তাঞ্চলে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” শুধু গান, সংবাদ নয়—রেডিও নাটক প্রচার করত। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সাহস জুগানো হতো, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা তুলে ধরা হতো।

অভিনেতা আতাউর রহমান, মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক এ সময় প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘কবর’ নাটকটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের নিয়ে লেখা হলেও এর ভাষা পুরো জাতির বেদনাকে বহন করে। এছাড়া গেরিলা থিয়েটার দলগুলো শরণার্থী শিবিরে, মুক্তাঞ্চলে নাটক করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করত।

স্বাধীন বাংলাদেশের থিয়েটার ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন

স্বাধীনতার পরেও থিয়েটার বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ থেকে যায়। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পরের সামরিক শাসন, ৮০ এর দশকের এরশাদ সরকারের স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে থিয়েটার ছিল সরাসরি হাতিয়ার।

ঢাকায় নাট্যদল, আর্ট থিয়েটার, বটতলা, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, বহুব্রীহি, থিয়েটার আর্ট ইউনিট—এসব দল একের পর এক রাজনৈতিক নাটক মঞ্চে আনে। সেলিম আল দীনের ‘কিত্তনখোলা’, মামুনুর রশীদের ‘লাল শালু’, আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটকগুলো শাসকের অন্যায় তুলে ধরে।

“স্বৈরাচার নিপাত যাক” আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ, চারুকলার মাঠ হয়ে ওঠে খোলা থিয়েটারের মঞ্চ। রাস্তায় নাটক হতো—‘গেরিলা থিয়েটার’ আবার ফিরে আসে।

জনগণকে জাগিয়ে তোলা

বাংলাদেশের থিয়েটার কখনোই নিছক বিনোদন ছিল না। এটি মানুষের বেদনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রোধ, প্রতিবাদ, বিদ্রোহের ভাষা। ঔপনিবেশিক শাসন হোক, ভাষার অধিকার হোক, স্বাধীনতার যুদ্ধ হোক বা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন—থিয়েটার মানুষের মনের ভয় দূর করে, প্রতিবাদের ভাষা দেয়।

এখনো থিয়েটার শুধু মঞ্চে নয়, রাস্তা-ঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গ্রামে-গঞ্জে গণজাগরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এই ঐতিহ্য বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।

জীবন্ত দলিল

থিয়েটার বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। এটি ইতিহাসের এক একটি অধ্যায়ে মানুষের স্বরূপ প্রকাশ করেছে—কখনো কান্না, কখনো হাসি, কখনো রাগ, কখনো বিদ্রোহ। বাংলাদেশের থিয়েটার তাই কেবল শিল্প নয়, এটি জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ, লড়াইয়ের অস্ত্র, পরিবর্তনের সোপান।

শিক্ষার্থী-শিক্ষকের প্রেমের গল্প নিয়ে বিতর্কে বন্ধ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে-ড্রামা

থিয়েটার: ঔপনিবেশিক বিরোধিতা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও  স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে

১০:০০:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে থিয়েটারের জন্ম

ভারতের উপমহাদেশে থিয়েটার কখনো নিছক বিনোদনের মাধ্যম ছিল না। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ও বিশ শতকের গোড়ায় থিয়েটার হয়ে ওঠে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সচেতনতার হাতিয়ার। কলকাতায় বেথুন থিয়েটার থেকে শুরু করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চ নাটকে দেশপ্রেম, বঞ্চিত মানুষের বেদনা, এবং শোষণের বিরুদ্ধ ভাষা প্রকাশ পেতে থাকে।

বাংলার নাট্যকাররা বুঝেছিলেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছড়াতে থিয়েটার গুরুত্বপূর্ণ। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা নাটকগুলোতে ইংরেজ শাসনের অন্যায়, ইতিহাসের বীরত্বগাথা, এবং আত্মমর্যাদার বার্তা উঠে আসে। ‘শাহজাহান’, ‘মীর কাসিম’, ‘নূরজাহান’ – এসব নাটক কেবল ইতিহাস নয়, সমসাময়িক শাসনের বিরুদ্ধে রূপক।

বাংলা থিয়েটার ও ব্রিটিশ সেন্সরশিপ

ব্রিটিশ সরকার এই সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ টের পেয়েছিল। ১৮৭৬ সালে ড্রামাটিক পারফরম্যান্সেস অ্যাক্ট (Dramatic Performances Act) করা হয়, যাতে “বিদ্রোহী” নাটকগুলোকে সেন্সর করা যায়। তবু থেমে যায়নি থিয়েটার আন্দোলন। মানুষ গোপনে নাটক মঞ্চস্থ করেছে, কবিগান, যাত্রা, পালা – সব মাধ্যমেই ইংরেজদের শোষণের গল্প উঠে এসেছে।

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে থিয়েটার

বাংলাদেশে থিয়েটার রাজনৈতিক চেতনার ধারক হয়ে ওঠে ১৯৪৭ এর পর। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার জন্য মঞ্চ নাটক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর এক নতুন ধরনের থিয়েটারচর্চা দেখা যায়। “ভাষা” নিয়ে নাটক, কবিতা আবৃত্তি, ছোট নাটিকা—এসবেই ভাষার দাবি উঠে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজের নাট্যদলগুলো এ সময় মঞ্চে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় থিয়েটার

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থিয়েটার একেবারে যুদ্ধে নেমে আসে। মুক্তাঞ্চলে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” শুধু গান, সংবাদ নয়—রেডিও নাটক প্রচার করত। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সাহস জুগানো হতো, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা তুলে ধরা হতো।

অভিনেতা আতাউর রহমান, মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক এ সময় প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘কবর’ নাটকটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের নিয়ে লেখা হলেও এর ভাষা পুরো জাতির বেদনাকে বহন করে। এছাড়া গেরিলা থিয়েটার দলগুলো শরণার্থী শিবিরে, মুক্তাঞ্চলে নাটক করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করত।

স্বাধীন বাংলাদেশের থিয়েটার ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন

স্বাধীনতার পরেও থিয়েটার বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ থেকে যায়। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পরের সামরিক শাসন, ৮০ এর দশকের এরশাদ সরকারের স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে থিয়েটার ছিল সরাসরি হাতিয়ার।

ঢাকায় নাট্যদল, আর্ট থিয়েটার, বটতলা, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, বহুব্রীহি, থিয়েটার আর্ট ইউনিট—এসব দল একের পর এক রাজনৈতিক নাটক মঞ্চে আনে। সেলিম আল দীনের ‘কিত্তনখোলা’, মামুনুর রশীদের ‘লাল শালু’, আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটকগুলো শাসকের অন্যায় তুলে ধরে।

“স্বৈরাচার নিপাত যাক” আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ, চারুকলার মাঠ হয়ে ওঠে খোলা থিয়েটারের মঞ্চ। রাস্তায় নাটক হতো—‘গেরিলা থিয়েটার’ আবার ফিরে আসে।

জনগণকে জাগিয়ে তোলা

বাংলাদেশের থিয়েটার কখনোই নিছক বিনোদন ছিল না। এটি মানুষের বেদনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রোধ, প্রতিবাদ, বিদ্রোহের ভাষা। ঔপনিবেশিক শাসন হোক, ভাষার অধিকার হোক, স্বাধীনতার যুদ্ধ হোক বা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন—থিয়েটার মানুষের মনের ভয় দূর করে, প্রতিবাদের ভাষা দেয়।

এখনো থিয়েটার শুধু মঞ্চে নয়, রাস্তা-ঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গ্রামে-গঞ্জে গণজাগরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এই ঐতিহ্য বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।

জীবন্ত দলিল

থিয়েটার বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। এটি ইতিহাসের এক একটি অধ্যায়ে মানুষের স্বরূপ প্রকাশ করেছে—কখনো কান্না, কখনো হাসি, কখনো রাগ, কখনো বিদ্রোহ। বাংলাদেশের থিয়েটার তাই কেবল শিল্প নয়, এটি জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ, লড়াইয়ের অস্ত্র, পরিবর্তনের সোপান।