আন্দোলনের সূচনা ও রাজনৈতিক অস্পষ্টতা
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়নি। তাই আন্দোলনের চরিত্র ও শেখ হাসিনার সরকারের ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পরিবর্তনের বিষয়টি এখনও অস্বচ্ছ। বাস্তবে ৫ তারিখ কী ঘটেছিল তা এখনও সাধারণ মানুষ এমনকি সাংবাদিকদের কাছেও খুব স্বচ্ছ নয়।
শেখ হাসিনার পতনের দুই দিন আগে থেকে রাজপথে দাবি উঠেছিল, “এই মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনীর সরকার।” ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরে জাতির উদ্দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা আন্দোলনকারীদের কোনো নেতা ভাষণ দেননি। ভাষণ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান। তিনি তাঁর ভাষণে দেশবাসীকে তাঁর ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন। মানুষ ধরে নিয়েছিল, সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করবে। এবং এটা বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনও। কারণ, যখনই কোনো কারণে রাজনীতি পরাজিত হয়, তখনই সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে।
সেনাপ্রধানের ভূমিকা ও নাটকীয় পরিবর্তন
কিন্তু এর পরে কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে, যা এখনও সবার কাছে পরিষ্কার নয়। যেমন, ছাত্রদের চাকরির আন্দোলন নিয়ে যে ক’জন ছাত্র নেতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের একজন এখন উপদেষ্টা—সজীব মাহমুদ ভূঁইয়া। সে বলেছে, তারা যখন রাষ্ট্রপতির কাছে ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে, ওই সময়ে সেনাপ্রধান আপত্তি করেছিলেন। এমনকি শেষ অবধি তিনি যখন এটা মেনে নেন, সজীব মাহমুদের ভাষায়, সেনাপ্রধান বলেছিলেন, তিনি বুকে পাথর চাপা দিয়ে এটা মেনে নিচ্ছেন।

এমনকি ওই বৈঠকে ছিলেন এমন কিছু সূত্রের মাধ্যমে যতটুকু জানা যায়, সেনাবাহিনী নিজে ক্ষমতা না নিলে ইন্টারিম সরকারপ্রধান হিসেবে বিএনপি ভিন্ন নাম প্রস্তাব করেছিল।
বিএনপি নয়, জামায়াতের উত্থান
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বিস্মিত হয় দ্রুতই—শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে না সরকারের ওপর আধিপত্য রাখার ক্ষেত্রে। তার বদলে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে বাংলাদেশের খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। যারা মূলত বাংলাদেশে একটি ভিন্ন ধারার ইসলামিস্ট মৌলবাদী পার্টি হিসেবে পরিচিত এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবিদের হত্যায় সহায়তা করে।
অন্যদিকে, যে ছাত্রদের আন্দোলনের নেতা হিসেবে দেখা গিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের সদস্য বলে পরে নিজেদের পরিচয় দেয়। এবং তারা পরিচয় গোপন করে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিল।
ইন্টারিম সরকারের উত্থান ও বিতর্ক
বাংলাদেশের জনভিত্তি সম্পন্ন রাজনৈতিক দল বিএনপি কেন কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠতে পারল না শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পরে—তা কিছুটা পরিষ্কার হয়, যখন বাংলাদেশের ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রধান ইউনূস জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে ২০২৪-এ আমেরিকায় যান। সেখানে তিনি ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন, শেখ হাসিনার পতন কোনো তাৎক্ষণিক জনগণের আন্দোলন ছিল না—এটা দীর্ঘ মেটিকুলাস ডিজাইনের ফল।

সেখানে উপস্থিত একজন ছাত্রকে তিনি ওই মেটিকুলাস ডিজাইনের অন্যতম কারিগর বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এবং ওই ছাত্রের সহযোগীরা ততদিনে টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে বলেছে, তারা যদি পুলিশ হত্যা না করত, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা না করত, সেগুলো না পুড়ত, তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটত না।
বাস্তবে আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে যেমন মানুষ মারা গেছে, তেমনি আন্দোলনের শেষের দিকে ৪ শতাধিক থানা আক্রমণ হয় এবং সেখানে মোট কত পুলিশ মারা গেছে তা এখনও নিশ্চিত নয়। অবশ্য এই নিহত পুলিশ পরিবারের সদস্যরা কোনো বিচার পাচ্ছে না। কারণ, তাদের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না বলে ইন্টারিম ব্যবস্থা নির্বাহী আদেশে একটি আইন প্রণয়ন করেছে।
সশস্ত্র হুমকি ও উপদেষ্টাদের বক্তব্য
এছাড়াও, ছাত্রনেতা সজীব মাহমুদ বলেছেন, সেনাপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করলে প্রথমে মেনে নিতে চাননি। ওই ছাত্রনেতা ও বর্তমান ইন্টারিম ব্যবস্থার উপদেষ্টা আরও বলেছেন—৫ তারিখে শেখ হাসিনার পতন না ঘটলে তারা সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করত সরকারের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে, ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রথম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন আহত-নিহতদের দেহ দেখার পরে বলেছিলেন, একটি অংশ মারা গেছে বা আহত হয়েছে ৭.৬২ রাইফেলের গুলিতে। এগুলো পুলিশ বা আর্মি ব্যবহার করেনি। তাই এটা তদন্ত করতে হবে—কোথা থেকে এগুলো এলো? তাঁর এ বক্তব্যের দুই দিন পরে তাঁকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।
আন্দোলনের ফলাফল ও মৌলবাদী প্রভাব
এই সমস্ত ঘটনাগুলো বেশি ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার পতনের জন্য যে মাস আপরাইজিং হয়েছিল, তা পিছে ফেলে মেটিকুলাস ডিজাইনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছে—এখানে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ভোটের অধিকারের বিজয়ের থেকে একটি জামায়াতে ইসলামী-ধারার মৌলবাদী দল এবং মেটিকুলাস ডিজাইনের সঙ্গে জড়িত থাকা ভিন্ন ধরনের মৌলবাদী দলের বিজয় হয়েছে।
এমনকি এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরে কিছু সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি জেলখানা থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা যে সংগঠন করত বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় তারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিল—ওই সংগঠনগুলোর মূল কেন্দ্র পাকিস্তানে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন জেএমবি, নিউ জেএমবি, জয়শে ই মামুদ।

পাকিস্তানের ভূমিকা ও সম্পর্কের পুনর্গঠন
ঠিক এমন একটা সময়ে ইন্টারিম ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে দৃশ্যমানভাবে সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব রক্ষা করছে পাকিস্তান সরকার।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার তিন বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
এই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরেও দেখা গেছে—পাকিস্তান বাংলাদেশের মূলধারার জনগণ, অর্থাৎ যারা স্বাধীনতার স্বপক্ষ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই অনাগ্রহী ছিল। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সংবিধান লঙ্ঘন করে পাকিস্তানে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিলেও, তাঁর ফিরতি সফরে বাংলাদেশে এসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অসম্মান করেন।
তিনি প্রথমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্তম্ভ জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে অস্বীকার করেন এবং পরে পোলো শার্ট পরে—অর্থাৎ ফরমাল ড্রেসে না গিয়ে তিনি যেভাবে ফুল দেন, তাতে বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ আহত হয়। অবশ্য পরবর্তীতে পাকিস্তানের যত রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশ সফর করেছেন, সেখানে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি।

পাকিস্তানের নীতি ও জামায়াতমুখী অবস্থান
একটি বিষয় সব সময়ই দেখা গেছে—পাকিস্তানের বড় রাজনৈতিক দলগুলো সব সময়ই মধ্যপন্থী। অথচ পাকিস্তানের সরকার বা সরকারের ভেতরের একটি অংশ বাংলাদেশে মধ্যপন্থী দলগুলোর চেয়ে বরং উগ্রপন্থী জামায়াতে ইসলামী দলের সঙ্গেই বেশি সম্পর্ক রক্ষা করে।
বর্তমান ইন্টারিম ব্যবস্থার মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ কারা, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া এই মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর সদস্য সাত বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। এমনকি বাঙালি মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াতের ভাস্কর্যও কালি দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার চেতনা ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের যে সরকারেরই পরিবর্তন ঘটুক না কেন—এমনকি স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সরকারেরও পতন ঘটুক না কেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ তার স্বাধীনতাকে পছন্দ করে। কারণ, স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে তারা অর্থনৈতিক সুফল পেয়েছে। কিছুদিন আগেও পাকিস্তানের থেকে এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো ছিল।

তাই শেষ বিচারে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তার স্বাধীনতার পক্ষেই থাকবে। হয়তো পরিস্থিতি বা সরকারের রোষানলের কারণে কখনও কখনও সমাজে নিশ্চুপতা বিরাজ করবে। তবে তার অর্থ এ নয় যে মানুষ তার স্বাধীনতার স্বপক্ষ অবস্থান থেকে সরে গেছে।
পাকিস্তানের কূটনীতি ও পুরোনো ক্ষতের পুনর্জীবন
যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতি বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এগুলে তার ফল ভালো হয়। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তান যেভাবে বাংলাদেশ নীতি নিয়ে এগোচ্ছে, তাতে হয়তো দুই দেশই সাময়িক সুবিধা পাচ্ছে।
তবে বাস্তবতা হলো—পাকিস্তানের এক সামরিক শাসক তার সেনাবাহিনীকে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ও ভূমিতে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, বর্তমান পাকিস্তানের বাংলাদেশ নীতি আবারও সেই ক্ষতকে আহত করছে।
একটি দেশের অধিকাংশ মানুষকে ও তার গর্ব ও অর্জনের স্থানকে যে কূটনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেই কূটনীতি কি শেষ পর্যন্ত তার নিজদেশের জন্য কোনো সাফল্য বয়ে আনে? এমনকি ভালো হয় দুই দেশের মানুষের জন্যেও?
যে কোনো ক্ষমতারই একটি সীমারেখা আছে—কিন্তু মানুষ ও তার চেতনা বহমান। পাকিস্তানের কি বাংলাদেশের মানুষ নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয়?
লেখক: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.
( এই লেখাটি The Financial Daily- তে প্রকাশিত হয়। এখানে তার বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো। The Financial Daily তে প্রকাশিত লেখার e- paper copy লেখার ভেতরেই দেয়া হলো)

স্বদেশ রায় 



















