ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এর জনমত জরিপের রিপোর্টটির যে সফট কপিটি আমি পেয়েছি, সেখানে তাদের গ্রাফে দেখা যাচ্ছে, আগামী সপ্তাহে নির্বাচন হলে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) পাবে ৩০% ভোট, আর জামায়াতে-ই-ইসলামী বাংলাদেশ (জামায়াত) পাবে ২৬% ভোট।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার একই সংস্থার জনমত জরিপ নিয়ে যে রিপোর্টটি করেছে সেখানে তারা লিখেছে বিএনপি ৩৩% জামায়াত ২৯% ভোট পাবে। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মোট ভোটের পার্থক্য দুই দলের মধ্যে ৪%।
আইআরআই এর রিপোর্টে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন হলো, এ মুহূর্তে দেশের ৫৩ শতাংশ মানুষ জামায়াতকে পছন্দ করে আর ৫১ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে পছন্দ করে।
এর পরে এই জনমত জরিপের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ৭% মানুষ এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। এবং ১১% শতাংশ তাদের মতামত জানাতে রাজি হয়নি।
আমি কিছুদিন আগে India Today-তে আমার একটি মতামত কলামে পরোক্ষভাবে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। সে লেখায় বলেছিলাম, ১৯৯১-তে আন্ডারডগ বিএনপি নিশ্চিত বিজয়ী আওয়ামী লীগের শিরোপা নিজেদের ঘরে তুলেছিল। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন যদি আওয়ামী লীগ ছাড়া হয় তাহলে ১৯৯১-এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আন্ডারডগই শিরোপা নিয়ে যেতে পারে।

এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই আইআরআই-এর এই সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস জুড়ে করা জরিপে দেখা যাচ্ছে—সাংবাদিক হিসেবে আমরা ঠিক যেমন মাঠের খবরটি পাচ্ছি—আওয়ামী লীগ ছাড়া বর্তমান মাঠের জনমত জরিপের ফল তার কাছাকাছি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে বাংলাদেশের নির্বাচনে ৪% ভোটে এগিয়ে থাকা অনেক বড় বিষয়। কারণ, মাত্র ৫% এর কাছাকাছি ভোট বেশি পাওয়াতে বিএনপি জোট ২০০১-এ আওয়ামী লীগের থেকে ১৩১ আসন বেশি পেয়েছিল। সেখানে ৪% এগিয়ে থাকা বিএনপি অতি সহজে জামায়াতে-ই-ইসলামী’র থেকে ১শ’ আসন বেশি পাবে।
কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ ছাড়া যে নির্বাচন করার চেষ্টা হচ্ছে সেখানে ২০০১-এর নির্বাচনের চরিত্রের থেকে অনেক বেশি মিল ১৯৯১-এর নির্বাচনের। বরং ১৯৯১-এর নির্বাচনের থেকেও এখানে আন্ডারডগের পক্ষে আরও কিছু বিষয় জড়িয়ে গেছে।
১৯৯১-এর নির্বাচনের আগে বিআইডিএস একটি জরিপ করে। ওই জরিপ যেদিন তারা সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ করে সে সময়ে বাংলাদেশে বিবিসির প্রতিনিধি আতাউস সামাদ এবং লন্ডন থেকে আগত সিরাজুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন ওই সাংবাদিক সম্মেলনে।
আমরা সব পত্রপত্রিকার সাংবাদিকরা সেদিন মূল রিপোর্ট অনুযায়ী রিপোর্ট করি—আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত। তারা এত পারসেন্ট ভোটে এগিয়ে জনমত জরিপ অনুযায়ী।
বিবিসির রিপোর্ট ছিল অনেকটা এমনই, জনমতে এখনও আওয়ামী লীগ এগিয়ে তবে নির্বাচনের ফল সম্পর্কে এখনও শেষ কথা বলা যায় না।
রিপোর্টিং-এ আতাউস সামাদ ভাইয়ের কাছে তথ্য ছিল পবিত্র বিষয়। তিনি এই জরিপ পাওয়ার পরেও কেন এতটা নিশ্চয়তা নিয়ে এ ধরনের রিপোর্ট করলেন, এটা নিউজ প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় আঘাত করে।
পরদিন সকালেই তাঁর বাসায় যাই। বয়সের পার্থক্য যাই থাকুক—তার সঙ্গে সম্পর্কটি ভিন্নই ছিল বলা যায়। শুধু সাংবাদিকতার বিষয় নয়, ব্যক্তিগত বিষয়ও আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আলোচনা হতো। তাছাড়া বিপদে আপদে তিনি সব সময়ই আমাকে সহায়তা করতেন।
তাই সামাদ ভাইকে যখন জিজ্ঞেস করি, তিনি কেন এমন নিউজ করলেন। তিনি হাত ধরে দোতলায় নিয়ে গিয়ে চা খেতে খেতে বললেন, কাল তুমি আমার পাশে ছিলে না?

বলি, ঠিক আপনার পাশে নয় সিরাজ ভাইয়ের পরের চেয়ারে আমি ছিলাম। তিনি বলেন, একটু খেয়াল করো যখন আমি উঠে দাঁড়াই তখন তুমি আমার পেছনে ছিলে।
শ্রদ্ধায় যেমন মাথা নত হলো, তেমনি শিখলাম একজন রিপোর্টারের চোখ কত তীক্ষ্ণ হতে হয়।
তিনি বললেন, তুমি খেয়াল করোনি। ওই সময়ে পাশের আইল থেকে একজন লোক হামাগুড়ি দিয়ে এসে আমার পাঞ্জাবির কোণা ধরে টান দেয়। আমি বুঝতে পেরে তার দিকে হাত বাড়াই সে একটা কাগজ আমাকে দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা পাঞ্জাবির পকেটে ভরে ফেলি। বাসায় এসে দেখি ওই কাগজটি মূল রিপোর্টের সঙ্গে নেই—অর্থাৎ কোনো কারণে বাঁধাই করা হয়নি। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়নি এমন ভোটারের সংখ্যা দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে যে ভোটের পার্থক্য আছে তার থেকে অনেক বেশি।
আমার আর বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন তিনি এভাবে ভিন্ন রিপোর্ট করলেন।
এবারও দুই দলের মধ্যে ভোটের পার্থক্য ৪% কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়নি এমন মানুষ ৭% অন্যদিকে সিদ্ধান্ত জানাতে রাজি হয়নি ১১%।
১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪০টি আসন। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৮টি আসন। ভোটের পার্থক্য ছিল মাত্র দশমিক ৭৩% অর্থাৎ বিএনপি পেয়েছিল ৩০.৮০% ভোট, আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.০৮% ভোট।

তাই এ মুহূর্তে আগামী নির্বাচনে যদি শুধু জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়—আওয়ামী লীগ যদি বাইরে থাকে—তাহলে বিষয়টা পুরোপুরি পেন্ডুলামের মতো দুলছে।
যেমন এবার সিদ্ধান্ত নেয়নি বা সিদ্ধান্ত জানাতে রাজি নয় এমন ভোটারের সংখ্যা আইআরআই এর জরিপের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে ১৮% (৭+১১)।
এই ১৮% মানুষ কোনদিকে যেতে পারে তার কয়েকটি বিশ্লেষণ বা হিসাব করা যেতে পারে।যেমন এই জরিপ অনুযায়ী বিএনপি থেকে জামায়াতকে পছন্দ করেছে ২% বেশি মানুষ। এই পছন্দের প্রভাব যারা সিদ্ধান্ত নেয়নি তাদের ওপর পড়তে পারে।
১৯৯১-এর অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়—শুধু সিদ্ধান্ত না নেওয়া মানুষ নয়, কেন্দ্রে ভোটার আনার ক্ষেত্রে ও বুথ বা নির্বাচনী ক্যাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের থেকে বিএনপি এগিয়েছিল। কারণ, সেবার ডাকসুতে ছাত্রদল প্রায় এককভাবে ছিল। তাছাড়া বড় বড় কলেজগুলোতেও ছাত্রদলের প্রভাব ছিল বেশি। এই ছাত্ররাই সেদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপির পক্ষে ভোটার নিয়ে আসে। এমনকি হাতে পায়ে ধরেও তারা কিছু মানুষকে ধানের শীষে ভোট দিতে বাধ্য করে।
এবার ১৯৯১-এর সঙ্গে তুলনা করলে—আওয়ামী লীগের স্থানেই বিএনপি আর বিএনপির স্থানেই জামায়াত। কারণ, প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবার তাদের ছাত্রদের দখলে। এই ছাত্ররাই তো ভোটার কেন্দ্রে আনার কাজ করবে।

এছাড়াও ১৯৯১-এর নির্বাচনের থেকেও এবার যে নির্বাচন করা হবে বলে বলা হচ্ছে; সেখানে যেহেতু আওয়ামী লীগকে রাখা হবে না। তাই আরও বাড়তি কিছু বিষয় এসে যোগ হয়েছে।
যেমন আওয়ামী লীগের কিছু লোক ভোট কেন্দ্রে যাবে। বা এলাকায় টিকে থাকার জন্য তাদের যেতে হবে। এরা কোথায় ভোট দেবে?
সাধারণ হিসেবে বিএনপির থেকেও বড় শত্রু আওয়ামী লীগের জামায়াত মনে করা হলেও—ভোটের ক্ষেত্রে কয়েকটি ভিন্ন বিষয় বিবেচনার আছে।
আওয়ামী লীগের কর্মীদের ভালোবাসার জায়গা দুটো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনা। এর বাইরে আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের ভালোবাসার কোনো পিলার নেই।
সত্য মিথ্যা যাই হোক—আওয়ামী লীগ এখানে দুটো ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। এবং আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকরা তা বিশ্বাস করে। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। এবং ২১ আগস্ট, ২০০৪, শেখ হাসিনা হত্যা চেষ্টার গ্রেনেড অ্যাটাকের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ওই সময়ের ক্ষমতাসীন ও তার পরিবারকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে- তাদের কর্মীদের কাছে।

তাই যারা মত প্রকাশ করছে না এই জরিপে যে ১১%—এর ভেতর যদি আওয়ামী লীগ থাকে ও যারা এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি যে ৭% তার ভেতরই যদি আওয়ামী লীগ থাকে তাহলে তারা নির্বাচনে ভোট দিতে গেলে “সতীনের বাটিতেই বিষ গুলে খাবে” অর্থাৎ বিএনপিকে ফেল করানোর চেষ্টা করবে।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের ভালোবাসার জায়গায় সর্বশেষ যে আঘাত করা হয়েছে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই ঐতিহাসিক বাড়ি ভাঙার দায় শেখ হাসিনা সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া তাঁর একটি অডিও ভাষণে বিএনপি ও তাদের উদীয়মান নেতার নির্দেশে হয়েছে বলে তাঁর কর্মীদের জানিয়েছেন। কেন তিনি এটা জানিয়েছেন তা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
তাই আইআরআই এর জরিপ এর পরে —বলা যেতে পারে যেভাবে নির্বাচনের পথে দেশ এগুচ্ছে শেষ অবধি এভাবে নির্বাচন হলে জামায়াতে ইসলামী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই।
লেখকঃ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 


















