গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার খবর চারদিকে স্বস্তির আশা জাগালেও বাস্তবতা ভিন্ন ছবি দেখাচ্ছে। গত দশ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পরও এখন পর্যন্ত চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজারের বেশি মানুষ। অবিরাম গোলাবর্ষণ ও গুলিবর্ষণের মধ্যেই দিন কাটছে গাজার সাধারণ মানুষের।
যুদ্ধবিরতির চার সপ্তাহ পরও থামেনি মৃত্যু
উত্তর গাজার বাসিন্দা চিকিৎসক জাবের আল আত্তার যুদ্ধবিরতির খবরে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন। দীর্ঘ দুই বছরের বোমাবর্ষণ শেষে শান্তির আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আশা ভেঙে যায় মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যেই। নুসেইরাতের আল আওদা হাসপাতালে কাজে যাওয়ার পথে ফোন পেয়ে জানতে পারেন, তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়ার সময় ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে তাঁর মেয়ে মাইসা। বাস্তুচ্যুত হয়ে বেইত লাহিয়ার আল আতাত্রা এলাকায় তাঁবুতে থাকা জাবের বলেন, এখানে কোনো নিরাপত্তা নেই, শান্তির কোনো নিশ্চয়তা নেই।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির পর থেকে অন্তত চারশ দশজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার একশ চৌত্রিশ জনেরও বেশি। তাদের অনেকেই নারী ও শিশু।
নামমাত্র যুদ্ধবিরতি, বাস্তবে অব্যাহত হামলা
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের পার্লামেন্টে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু গাজার মানুষের কাছে সেই প্রতিশ্রুতি এখন অর্থহীন। দুই মাসের তথাকথিত শান্তির পরও ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহর, ভাঙা বাড়িঘর আর উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর দুর্ভোগ একই রয়ে গেছে।
ইসরাইলের গোলাবর্ষণ ও গুলিবর্ষণের পাশাপাশি পাল্টা হামলায় ইসরায়েলি সেনাদের প্রাণ গেছে। উত্তর ইসরায়েলে পৃথক হামলায় বেসামরিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। দুই পক্ষের এই সংঘাতের খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

‘হলুদ রেখা’ আর মৃত্যুফাঁদ
যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে যে ‘হলুদ রেখা’ থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরে যাওয়ার কথা ছিল, সেটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গাজার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই সীমারেখা বারবার বদলানো হচ্ছে। ফলে সামান্য ভুলেই মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। বহু শিশু ও নারী এই রেখা অতিক্রম করার অভিযোগে নিহত হয়েছে।
খান ইউনুস এর কাছে বেনি সুহাইলায় হৃদয়বিদারক এক ঘটনায় হুইলচেয়ারে থাকা বাবার জন্য জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে যাওয়া আট বছরের ফাদি ও এগারো বছরের জুমা ড্রোন হামলায় নিহত হয়। ইসরায়েলি বাহিনী তাদের সন্দেহভাজন বলে দাবি করলেও স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী তারা ছিল নিরীহ শিশু।
ত্রাণ সংকট ও মানবিক বিপর্যয়
মানবিক সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করে বলছে, গাজায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ত্রাণ ঢুকছে। বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়ে অঞ্চলটি তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। হামাসের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে ইসরায়েল বলছে, তারা সব দায়িত্ব পালন করছে।
এই টানাপোড়েনের মাঝেই মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ছেন গাজার মানুষ। জাবের আল আত্তার জানান, মেয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ওজন কমেছে পঁচিশ কেজি। একসময় তিনটি বাড়ির মালিক ছিলেন তিনি, এখন তিনি গৃহহীন, একটি তাঁবুতেই তাঁর আশ্রয়।
গাজায় যুদ্ধবিরতির এই বাস্তবতা একটাই বার্তা দিচ্ছে—নামে যুদ্ধবিরতি হলেও মানুষের কষ্ট ও মৃত্যু থামেনি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















