আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়….
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এদেশের একজন নাগরিক ১৮ বৎসর বয়স হলেই ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু সমগ্র উপমহাদেশেই এক সময় ভোটাধিকার এমন সর্বজনীন ছিল না। প্রাপ্তবয়স্কদের সকলে নয়, বরং সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষই কেবল ভোট দিতে পারতেন।
‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ ধারণাটিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় Universal Adult Franchise (UAF) অর্থাৎ ‘সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার’ বলে। এটি গণতন্ত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব অধ্যয়নের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমা গণতন্ত্র ‘এক ব্যক্তি এক ভোটের’ অধিকার প্রদান করতে এক শতাব্দীরও বেশি সময় নিয়েছে। সে পথও মসৃণ ছিল না, বরং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এমনকি রক্তরঞ্জিত ছিল। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বিভিন্ন দেশে নারীরা দীর্ঘকাল ভোট দিতে পারেনি। খোদ যুক্তরাজ্যে ১৯১৮ সালের আগ পর্যন্ত নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। সে বছর কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির মালিকানা সম্পন্ন ৩০ বছরের বেশি নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। এমেলিন প্যাঙ্কহার্স্ট প্রতিষ্ঠিত Women’s Social and Political Union (WSPU)-এর উদ্যোগে নারীর ভোটাধিকারের জন্য সহিংস আন্দোলন সংঘটিত হয়। ‘সাফারজেটস’ (Suffragettes) নামে পরিচিত WSPU-র সদস্যরা সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, বোমাবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ এবং কারাগারে অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এক পর্যায়ে রাজা ৫ম জর্জের ঘোড়ার আঘাতে এমিলি ডেভিডসনের নিহত হওয়ার ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি করে। অবশেষে ১৯২৮ সালে পুরুষদের সাথে সকল নারীর সমান ভোটদানের বয়স ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়। নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। সেখানে সহিংস ঘটনা না ঘটলেও কেট শেপার্ডের নেতৃত্বে Women’s Christian Temperance Union প্রবল জনমত গড়ে তুলেছিল। প্রচণ্ড চাপের মুখে ঐ বছর পুরুষ-শাসিত সংসদ নারীদের ভোটাধিকার দিয়ে বিল পাস করে। সুইজারল্যান্ডে বিগত শতাব্দীর ৭০ দশক পর্যন্ত নারী মাত্রই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। বার কয়েক ‘গণভোট’ (referendum) অনুষ্ঠিত হয়েছিল নারীরা ভোট দিতে পারবে কি পারবে না সে প্রশ্নে। সুইস পুরুষরা বারবার নারীদের ভোটাধিকার প্রদানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। অবশেষে ১৯৭১ সালের গণভোটে নারীদের ভোটাধিকার অনুমোদন লাভ করে। জাতিগত পরিচয়ের কারণেও মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৮৭০ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক গ্যারান্টি থাকা সত্ত্বেও খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৫ সালের আগ পর্যন্ত আফ্রিকান আমেরিকানরা ভোট দিতে পারতেন না। কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার সংগ্রাম গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-৬৫) পরে পুরো এক শতাব্দী ধরে চলে। শেষমেষ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে নাগরিক অধিকার আন্দোলন সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। আলাবামার সেলমায় ‘রক্তাক্ত রবিবার’-এর মতো ঘটনা জাতিকে হতবাক করেছিল, সেখানে শান্তিপূর্ণ মিছিলকারীদের উপর রাজ্যসৈন্যরা নির্মমভাবে আক্রমণ করেছিল। ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন পাসের মাধ্যমে সাক্ষরতা পরীক্ষা এবং ভোট কর বাতিল হয় এবং আফ্রিকান আমেরিকানরা ভোটাধিকার প্রয়োগ শুরু করতে সক্ষম হয়। এ উদাহরণগুলি প্রমাণ করে যে ভোটাধিকারে নারী ও জাতিবিশেষের অন্তর্ভুক্তি তথা ‘ইউএএফ’ ছিল দীর্ঘ, বহু-প্রজন্মের সংগ্রাম যা বিশ্বব্যাপী আইনি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল।
উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রায় ১,২০০ বছর আগে পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল জনগণের ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন বলে তিব্বতী বৌদ্ধ লামা তারানাথের লেখায় পাওয়া যায়। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এক শতাব্দীর তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অরাজকতার ‘মাৎস্যন্যায়’ কালের পর ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গোপাল বাংলা অঞ্চলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিক প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে গোপাল জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। পরিবর্তে, তিনি আঞ্চলিক সর্দার, সামন্ত প্রভু বা নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের একটি দল দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন। গোপালের নির্বাচনকাল থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ কায়েম (১৭৫৭)-এর মধ্যবর্তী সময়ে উপমহাদেশে কোন নির্বাচনের হদিস পাওয়া যায় না। প্রায় ১০০০ বছরের এই বিশাল সময়কালে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলি ছিল অপ্রতিরোধ্যভাবে রাজতান্ত্রিক এবং বংশানুক্রমিক: অর্থাৎ রাজত্ব উত্তরাধিকারসূত্রে (প্রয়োজনে যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে) প্রাপ্ত হয়েছিল, ভোটের মাধ্যমে অর্জিত হয়নি। ব্রিটিশ রাজ সাংবিধানিক শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার পর, আনুষ্ঠানিক, যদিও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, নির্বাচন শুরু হয়েছিল।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের কাছে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক উদ্যোগ থেকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং অত্র অঞ্চলে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সূচনা হয়। এরপর ১৫০ বছরেরও অধিক কাল অপেক্ষো করতে হয় একটি নির্বাচনের জন্য। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট এডউইন মন্টেগু এবং ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড উত্থাপিত সংস্কার প্রস্তাব (মন্টেগু-চেমসফোড রিফর্মস)-এর ভিত্তিতে ১৯১৯ সালে প্রণীত হয় ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট’, যা শাসনব্যবস্থায় ভারতীয়দের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার রূপরেখা দিয়েছিল। এ আইন ভারতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালু করে, তবে তা কেবল প্রাদেশিক পর্যায়ে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নয়। প্রাদেশিক আইনসভার দুটি কক্ষ ছিল: উচ্চকক্ষ (Legislative Council) এবং নিম্নকক্ষ (Legislative Assembly)। প্রাদেশিক নিম্নকক্ষের কিছু সদস্য সীমিত সংখ্যক ভোটারের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়। আর উচ্চকক্ষের সদস্যরা স্থানীয় সংস্থা (যেমন পৌরসভা, জেলা বোর্ড), প্রাদেশিক গভর্নর কর্তৃক নির্বাচিত বা নিযুক্ত হবেন; সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন না (কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত)। এরই ভিত্তিতে ভারতে প্রথম প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালে। বলা বাহুল্য নির্বাচনটি হয় শুধু প্রাদেশিক পর্যায়ে এবং নিম্নকক্ষে। ভোটার হওয়ার জন্য বয়স কোন মাপকাঠি ছিল না, ভোট দান সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল না, বরং ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলো প্রযোজ্য ছিল:
১. আর্থিক যোগ্যতা
জমির মালিকানা: যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ছিল।
ট্যাক্স প্রদানকারী: যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূমি রাজস্ব বা মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স প্রদান করতেন।
বাড়ি ভাড়া দেওয়া বা ভোগকারী: যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া বা বাসস্থান ভোগ করতেন (যেমন: বার্ষিক
২০-৫০ টাকা ভাড়া দেওয়া ব্যক্তি)।
২. শিক্ষাগত যোগ্যতা
যারা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষিত ছিলেন।
– কিছু ক্ষেত্রে স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হতো।
৩. সামরিক বা সরকারি চাকুরিজীবী
– সাবেক সৈনিক বা সরকারি চাকুরিজীবী (যেমন: রেলওয়ে, পোস্ট অফিস ইত্যাদিতে কর্মরত)।
৪. বিশেষ পেশাজীবী বা প্রতিষ্ঠান
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী সংঘের সদস্য ইত্যাদি।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মুসলিম এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর (Separate Electorates) ব্যবস্থা ছিল। মুসলিম ভোটারদের নাম মুসলিম ভোটার তালিকায় তোলা হত এবং তারা শুধু মুসলিম প্রার্থীকে ভোট দিতে পারতেন। একইভাবে শিখ ভোটাররা শুধুমাত্র শিখ প্রার্থীকে ভোট দিতেন। হিন্দুদের জন্য সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলী ছিল।
ফলশ্রুতিতে ১৯২০ সালের নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত। পুরো ব্রিটিশ ভারতে মাত্র ১.৫ থেকে ২ শতাংশ জনগণ (প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ) ভোট দিতে পারতেন। উদাহরণস্বরূপ: বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ভোটারের সংখ্যা ছিল মাত্র ২-৩ লক্ষ (মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪.৫ কোটি), মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৫ লক্ষ। সীমিত সংখ্যক ভোটারের মূল কারণ- ব্রিটিশ নীতি। ব্রিটিশ সরকার বিশ্বাস করত যে শিক্ষিত ও সম্পদশালী শ্রেণীই কেবল সঠিকভাবে ভোট দিতে সক্ষম। তাদের লক্ষ্য ছিল ‘যোগ্যতার ভিত্তিতে’ ভোটাধিকার সীমিত রাখা, যা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র জনগণকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখার একটি কৌশল ছিল। ১৯২০ সালে প্রথম নির্বাচন হওয়ার পর ১৯২৩ এবং ১৯২৬ সালেও একই আইনের অধীনে একই পদ্ধতিতে নিম্নকক্ষের নির্বাচনসমূহ অনুষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে নেহেরু রিপোর্ট (১৯২৮) এবং কংগ্রেসের করাচি প্রস্তাব (১৯৩১)। ভারতের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে মোতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এর ফলই হলো নেহেরু রিপোর্ট। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার ছিল এর সবচেয়ে বৈপ্লবিক দাবি। নেহেরু রিপোট ধর্ম, লিঙ্গ বা বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকারের প্রস্তাব করে। এটি ছিল ব্রিটিশদের ‘সীমিত ভোটাধিকার’ নীতির সরাসরি বিরোধিতা। নেহেরু রিপোর্ট ছিল স্বাধীন ভারতের জন্য ভারতীয়দের নিজস্ব প্রস্তাবিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। এরপর গান্ধী-আরউইন চুক্তি এবং লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের প্রাক্কালে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ করাচিতে তার বার্ষিক সভায় ভবিষ্যতের ভারতের জন্য তার মৌলিক অধিকার ও অর্থনৈতিক নীতির রূপরেখা প্রস্তাব করে। কংগ্রেসের এই করাচি প্রস্তাবে ভোটাধিকারের বিষয়টি সরাসরি না থাকলেও এটি যে গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রের অঙ্গীকার করেছিল, তা থেকেই সর্বজনীন ভোটাধিকারের চূড়ান্ত বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়েছিল।

১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ভারত সরকার আইন’ (Government of India Act) প্রণয়ন করে। আইনটি ছিল স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশদের দেওয়া শেষ প্রধান সাংবিধানিক কাঠামো। এটি ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি ‘সর্বভারতীয় ফেডারেশন’ গঠনের প্রস্তাব করেছিল। এই ফেডারেশন কখনও অস্তিত্ব লাভ করেনি, কারণ দেশীয় রাজ্যগুলি যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল আইনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সফলভাবে বাস্তবায়িত বৈশিষ্ট্য। ভারতীয়দের প্রথমবারের মতো প্রাদেশিক সরকার পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয় এবং বেশিরভাগ প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট’ (১৯১৯)-এর মাধ্যমে ভারতে কেবল প্রাদেশিক পর্যায়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালু হয়েছিল; আর ‘ভারত সরকার আইন’ (১৯৩৫)-এর মাধ্যমে ‘কেন্দ্রীয় আইনসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেটাকেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা হয়: কাউন্সিল অব স্টেট (উচ্চকক্ষ) এবং ফেডারেল অ্যাসেম্বলি (নিম্নকক্ষ)। ‘ভারত সরকার আইনে’ও সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। তবে পূর্বের সীমিত ভোটাধিকারের ব্যবস্থা কিছুটা প্রসারিত হয়। যেমন: আর্থিক সীমা কমিয়ে আনা হয়; ভাড়া বা ট্যাক্সের হার হ্রাস করা হয়। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় (দরিদ্র গোষ্ঠী বাদই থেকে যায়)। শিক্ষাগত যোগ্যতা আরও শিথিল করা হয়; মাধ্যমিক স্তরের নিচের শিক্ষিতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নতুন পেশা যোগ করা হয়; কৃষক, ব্যবসায়ী এবং শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের জন্য বিশেষ কোটা বা যোগ্যতা দেওয়া হয়। নারীদের ভোটাধিকার যথেষ্ট প্রসারিত করা হয়। পুরুষদের সমান আর্থিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। নারী ভোটারের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আইনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল- শুধু মুসলিম ও শিখই নয়, বরং খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং ‘তফসিলি শ্রেণি’ (অস্পৃশ্য)-দের জন্যও পৃথক নির্বাচকমণ্ডলির ব্যবস্থা চালু করা হয় (মহাত্মা গান্ধীর তীব্র বিরোধিতায় পরে তফসিলি শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বাতিল হয়)। সব মিলিয়ে ভোটারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৮.৫% (প্রায় ৪ কোটি), ১৯১৯-এর তুলানায় যা ৬-৭ গুণ বেশি।
‘ভারত সরকার আইনে’র ভিত্তিতে ১৯৪৬ সালের গুরত্বপূর্ণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জনগণ ঐ ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক নিম্নকক্ষ (বিধানসভা) (Legislative Assembly)-এর সদস্যদের নির্বাচিত করার জন্য ভোট প্রদান করে। বিজয়ীরা কেন্দ্রে কাউন্সিল অব স্টেট (উচ্চকক্ষ) এবং ফেডারেল অ্যাসেম্বলি (নিম্নকক্ষ) উভয় কক্ষের সদস্যদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। সুতরাং এটি ছিল একটি সীমিত, পরোক্ষ এবং সাম্প্রদায়িক নির্বাচন এবং সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার থেকে অনেক দূরস্থিত। তবে ১৯৪৬ সালের নির্বাচন তর্কাতীতভাবে উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পাকিস্তান ইস্যুতে চূড়ান্ত, অনস্বীকার্য গণভোট হিসেবে কাজ করেছিল এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মঞ্চ তৈরি করেছিল। নির্বাচনটি ছিল ভারতের ভবিষ্যতের জন্য দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সরাসরি প্রতিযোগিতা। নির্বাচনটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আইএনসি) এবং অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ (এআইএমএল)-এর মধ্যে একটি দেশব্যাপী দ্বৈরথে পরিণত হয়েছিল।
ফলাফলে প্রকৃত তাৎপর্য ছিল প্রাদেশিক নিম্নকক্ষের নির্বাচনের মধ্যে:
মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে (১৯৪৭ সালে যে প্রদেশগুলো নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়): মুসলিম লীগ ভূমিধস জয়লাভ করে, মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৪৯৪টি আসনের মধ্যে ৪৩৯টি (প্রায় ৮৯%) আসন দখল করে।
হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে:
প্রত্যাশিতভাবে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মাদ্রাজ, বোম্বে, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার এবং কেন্দ্রীয় প্রদেশের মতো প্রদেশে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে। উদাহরণস্বরূপ, এটি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান নাম খাইবার পাখতুনখোয়া)-এ কংগ্রেসপন্থী ‘খুদাই খিদমতগার’দের এবং পাঞ্জাবে ‘ইউনিয়নিস্ট পার্টি’ ও ‘আকালি দল’কে পরাজিত করে। এই ফলাফল ছিল জিন্নাহর অনস্বীকার্য ম্যান্ডেট। তিনি এখন বৈধভাবে দাবি করতে পারেন ভারতের মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি তিনি এবং মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে বিপুল ভোট দিয়েছে। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম লীগের প্রায় সম্পূর্ণ জয় প্রমাণ করে যে মুসলিমরা একটি অখণ্ড ভারতে হিন্দু আধিপত্যকে ভয় পেয়েছিল এবং মুসলিম লীগকে তাদের রক্ষক হিসেবে দেখেছিল। এটি দ্বি-জাতি তত্ত্ব, আরো স্পষ্টভাবে বললে ধর্মের ভিত্তিতে, দেশভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ব্রিটিশ রাজ এবং কংগ্রেস কেউই আর মুসলিম লীগকে একটি গৌণ দল হিসেবে বাতিল করতে পারেনি। এর অপ্রতিরোধ্য ম্যান্ডেট লাহোর প্রস্তার (১৯৪০)-এর আলোকে তাদের পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। মূলত, ১৯৪৬ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির গণতান্ত্রিক ট্রিগার। পরের বছর ব্রিটিশ সংসদে পাস হওয়া ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট, ১৯৪৭’-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দুটি নতুন দেশকে স্বীকৃতি দেয়; এই আইনটি ছিল ভারত ও পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা হস্তান্তরের দলিল। ঐ আইন অনুসরণ করে পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর-জেনারেল এবং লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী হন। স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথম নির্বাচন হয় প্রাদেশিক পর্যায়ে, ১৯৫৪ সালে। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালের ‘ভারত সরকার আইন’-এর (যেটি পাকিস্তান তার অস্থায়ী সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করেছিল) অধীনে। তবে তাতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়। ১৯৪৬ সালের বিজয়ী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মাধ্যমে গঠিত গণপরিষদ (Constituent Assembly) এই আইনটি সংশোধন করে ‘দ্য প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি (ইলেকশন) অর্ডার, ১৯৫৪’ নামে একটি শাসনাদেশ (Order) জারি করে। এই আদেশের মাধ্যমে নিম্নলিখিত মৌলিক পরিবর্তনগুলো আনা হয়, যা সর্বজনীন ভোটাধিকার আংশিকভাবে সূচনা করে:
প্রথমবারের মতো ‘২১ বছর বা তার বেশি বয়স’-কে ভোটার হওয়ার একমাত্র ও সর্বজনীন মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সম্পত্তি, ট্যাক্স বা শিক্ষাগত যোগ্যতার সমস্ত শর্ত সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়। শুধুমাত্র পাকিস্তানের নাগরিকত্বকে প্রধান শর্ত করা হয়। তবে, যদিও ভোটাধিকার সর্বজনীন করা হয়, কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে ‘পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী’র ব্যবস্থা বজায় রাখা হয়। অর্থাৎ, মুসলিম ভোটাররা শুধু মুসলিম প্রার্থীকে, হিন্দু ভোটাররা শুধু হিন্দু প্রার্থীকে ভোট দিতে পারতেন।
এভাবে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল ৫টি প্রদেশ নিয়ে: ১. পূর্ব বাংলা (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান), ২. পাঞ্জাব, ৩. সিন্ধু, ৪. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং ৫. বেলুচিস্তান। ১৯৫৪-র নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানের মোট নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩.৫-৪.০ কোটি। তন্মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিল প্রায় ১.৯ কোটি। পূর্ব পাকিস্তানে ভোটদানের হার ছিল অত্যন্ত উচ্চ, প্রায় ৫৭-৬০%; সমগ্র পাকিস্তানে ছিল আনুমানিক ৫০-৬০%। বেলুচিস্তানে প্রত্যক্ষ নির্বাচন হয়নি, সেখানে স্থানীয় নেতাদের (সারদার) মাধ্যমে পরোক্ষভাবে প্রাদেশিক পরিষদ (মুসলিম লীগ প্রভাবান্বিত) গঠন করা হয়। পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে। সিন্ধুতে কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও মুসলিম লীগ জোট সরকার গঠন করে। চমক ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ৪টি প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নিজাম-ই-ইসলাম পার্টি এবং গণতান্ত্রিক দল ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি মহাজোট গঠন করে ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে। এর ইশতেহার- ২১-দফা কর্মসূচি, পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের কবল থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করার দাবি জানায়। মুসলিম লীগের জন্য নির্বাচনের ফলাফল ছিল ভূমিকম্প সদৃশ: যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয়লাভ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। নির্বাচনটি ছিল প্রাদেশিক পর্যায়ে ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’-এর প্রথম সত্যিকারের প্রকাশ। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন অর্থাৎ সাধারণ নির্বাচনে এর প্রয়োগ তখনও বাকি থেকে যায়।
হতবাক কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টকে সরকার গঠনের অনুমতি দেয়, কিন্তু আইনশৃঙ্খলার অজুহাতে মাত্র দুই মাস পরে তা বরখাস্ত করে গভর্নরের শাসন জারি করে। বিজয়ী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মাধ্যমে ‘গণপরিষদ’ গঠিত হয়, যে পরিষদ ১৯৫৬ সালে পকিস্তানের প্রথম সংবিধান গ্রহণ করে। কিন্তু উক্ত সংবিধানে তথাকথিত ‘সমতার নীতি’ প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় ৫৫% পূর্ব পাকিস্তানের থাকা সত্ত্বেও, উভয় অংশে (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে) জাতীয় পরিষদে সমান সংখ্যক সংসদীয় আসন বণ্টন করা হয়। ফেডারেল পরিষদে ১৫০টি আসনের ৭৫টি পূর্ব পাকিস্তানে এবং ৭৫টি পশ্চিম পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হয়। তবে, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যুত্থান যাবতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে স্থগিত করে দেয়। তিনি মার্শাল ল জারি করেন এবং ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ (Basic Democracy) প্রর্বতন করেন, যার অধীনে ১৯৫৯ সালে স্থানীয় পর্যায়ে (ইউনিয়ন/ওয়ার্ড) পর্যায়ে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা অংশগ্রহণ করতে পারেনি। মুসলিম লীগের জন্য নয়, বরং আইয়ুব খান নিজের সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলার জন্য কারচুপিতে ভরপুর, চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এই নির্বাচন আয়োজন করেন। ১ম স্তরে শুধু স্থানীয় পর্যায়ের সাধারণ জনগণ (প্রাপ্তবয়স্ক) তাদের এলাকার প্রতিনিধি হিসেবে ৮০,০০০ (পরবর্তীতে ১,২০,০০০) ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ (Basic Democrat বা BD)-কে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করেন। ২য় স্তরে এই ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’বৃন্দ ভোট দিয়ে জাতীয় পরিষদ (১৯৬২ সালে), প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, পৌরসভার মেয়র, সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। ১৯৬০ সালে আয়ুব খানের জন্য জনগণের সরাসরি ভোট ছাড়াই নিজেকে ‘নির্বাচিত’ (৯৫.৬% বিডি ভোট পেয়ে) রাষ্ট্রপতি করা এবং একটি অনুগত সংসদ গঠন করা সম্ভব হয়। ১৯৬৪ সালে একই পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে তিনি আবারও ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন (৬৩.৩% ভোট)। এই ব্যবস্থাটি ছিল ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’-এর মূলনীতির একটি চতুর এবং সুপরিকল্পিত ধ্বংসলীলা।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মৌলিক গণতন্ত্রের পতন ঘটে। প্রবল ছাত্র-গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আয়ুব খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ইয়াহিয়া খান মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা বাতিল করেন এবং পাকিস্তানের ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী দলিল ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও), ১৯৭০’ জারি করেন। ৩০শে মার্চ জারিকৃত এই শাসনাদেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য একটি সাংবিধানিক কাঠামো ও নিয়মাবলি প্রণয়ন করা। এলএফওর মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ নীতি তথা সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক (২১ বছর) ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার ছিল জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদীয় আসন বণ্টন। ১৯৬১ সালের আদমশুমারি মোতাবেক এলএফও ৩১৩টি আসনের একটি জাতীয় পরিষদ (National Assembly) প্রতিষ্ঠা করে। এর মধ্যে ৩০০টি ছিল সরাসরি নির্বাচনের জন্য সাধারণ আসন এবং বাড়তি ১৩টি ছিল মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, যাদের নির্বাচিত সদস্যরা নির্বাচিত করবেন। প্রথমোক্ত ৩০০টি সাধারণ আসনের বণ্টন: ১. পূর্ব পাকিস্তান: ১৬২, ২. পাঞ্জাব: ৮২, ৩. সিন্ধু: ২৭, ৪. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ: ১৮, ৫. বেলুচিস্তান: ৪ এবং কেন্দ্র শাসিত উপজাতীয় অঞ্চল: ৭।

এলএফও ৬২০টি আসনের একটি প্রাদেশিক পরিষদ (Provincial Assemblies) প্রতিষ্ঠা করে। এর মধ্যে ৫৮০টি সাধারণ আসন এবং ৪০টি ছিল মহিলাদের জন্য। প্রথমোক্ত ৫৮০টি সাধারণ আসনের বণ্টন: ১. পূর্ব পাকিস্তান: ২৮০, ২. পাঞ্জাব: ১৮০, ৩. সিন্ধু: ৬০, ৪. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ: ৪০ এবং ৫. বেলুচিস্তান: ২০।
পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি ১৯৭০ সালে শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। নির্বাচনের ফলাফল ছিল রাজনৈতিক সুনামি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়লাভ করে; তারা জাতীয় পরিষদে ১৬২টি সাধারণ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অপরদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তানে (১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮১টি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তবে তা কেবল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। প্রাদেশিক পরিষদেও ছিল আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। পূর্ব পাকিস্তানে তারা ২৮০টি আসনের সবকটিতেই জয়লাভ করে। জামাতে ইসলামী, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম গ্রুপ), পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি খান গ্রুপ) একটি আসনেও জয়লাভকরতে পারেনি। এই ফলাফলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার গঠনেরও সম্পূর্ণ অধিকারী হয়। কিন্তু এটি এমন একটি ম্যান্ডেট ছিল যা পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার মেনে নিতে পারেনি। আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তাদের অস্বীকৃতির ফলে একটি সাংবিধানিক সংকট, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আগ্রাসন, গণহত্যা ও নারী নির্যাতন এবং মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ১ বছরের মধ্যে যে সংবিধান গৃহীত হয় তার ১২২ নম্বর অনুচ্ছেদে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয় এবং এর ২ নম্বর দফায় ১৮ বছর বয়সকে ভোটার হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। পাকিস্তান ১৮ বছর বয়সসীমা করে ১৯৮৫ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে; ভারত তা করে ১৯৮৯ সালে সংবিধানের একষট্টিতমতম সংশোধনীর মাধ্যমে।

‘তরুণ প্রজন্মের প্রথম ভোট, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হোক’- জনপ্রিয় এ শ্লোগানটির মূল টার্গেট সদ্য ১৮ বছর বয়স অতিক্রম করে ভোটাধিকার লাভ করা তরুণরা। ১৯৭২ সালের ‘বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ’ (‘দালাল আইন’ নামেও পরিচিত) ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তাকারীদের (যেমন রাজাকার, আলবদর ও আলশামস) বিচারের জন্য প্রণীত একটি আইন। এটি ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৮ হিসেবে জারি করা হয়েছিল এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হতো। সংবিধানের ভোটাধিকার লাভের ধারার উপ-দফা (ঙ) মোতাবেক দালাল আইনের অধীন কোন অপরাধের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তি ভোটার হতে পারবেন না। এমনকি ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদের দফা (২) এর উপদফা (ঙ) অনুযায়ী তিনি সংসদ সদস্য বা কোনো লাভজনক পদে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতাও হারাবেন।
উপমহাদেশে ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’-এর এই মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারটি কোনও সহজ লাভ ছিল না। এটি ছিল একটি সুদীর্ঘ ও সংগ্রামী পথ- যাকে অতিক্রম করতে হয়েছে সম্পত্তি ও শিক্ষার প্রাচীর, ধর্ম ও লিঙ্গের বৈষম্য, সামরিক শাসনের জটিল জাল এবং রক্তবিধৌত যুদ্ধ। আজ যখন একজন তরুণ প্রথমবারের মতো তার ভোট দেন, তিনি কেবল একটি রাজনৈতিক দলই বেছে নেন না; তিনি বহন করেন ইতিহাসের সেই দীর্ঘ অধ্যায়ের গুরুভার, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মদান ও অক্লান্ত সংগ্রাম এই সাধারণ অধিকারটিকে আমাদের জন্য সুনিশ্চিত করেছে। আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি এই অধিকার; এর রক্ষণ ও সদ্ব্যবহারই হবে ইতিহাসের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
গবেষক ও লেখক
baizid.romana@gmail.com
বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ 



















