মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “দেশ টার্গেট কিলিংয়ে ঢুকে যাচ্ছে।” এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁর নেতা তারেক রহমান বলেছেন, তিনি আগেও বলেছিলেন, এখনও বলছেন, “সহজে নির্বাচন হবে না।” অন্যদিকে, সারা দেশের নির্বাচনী অফিসগুলোর নিরাপত্তা চেয়ে আইজিপিকে চিঠি দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের প্রার্থীদের অস্ত্র দেওয়া হবে।
এই কথা ও কাজগুলো নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার মাত্র দুই দিনের ভেতরই ঘটেছে। এর থেকে নির্বাচনী পরিবেশের একটি ভবিষ্যৎ দৃশ্য—সূর্যোদয়ের প্রথম রশ্মি থেকে নিশ্চয়ই দেখা যাচ্ছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাজ ও কথা বাদ দেওয়া যাক। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রবীণ রাজনীতিবিদ, তারেক রহমান তরুণ হলেও তিনি যে অবস্থানে আছেন, সেখানে তথ্য স্রোত পৌঁছাবেই। তাই তাঁদের দুজনের কথাকে হালকা করে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া কিছু মানুষ বা বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে জানেন না এমন বিদেশীরা যাই বলুন না কেন, ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি ওই অর্থে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই।

এবং এটা যে ঘটবে, বা বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে না সেটা জুলাই আন্দোলন ভিন্ন দিকে টার্ন নিলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে দ্রুত ছাত্রদের সঙ্গে বসতে বলেছিলেন। সে সময়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ওই আন্দোলন দমন করতে তাঁর ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ওবায়দুল কাদেরকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে ছোট মাপের রাজনীতিক বলছি না, তবে তিনি তখন অন্য পরিবেশে ছিলেন—তাই রাজনীতিটা তাঁর থেকে দূরে চলে গিয়েছিল।
ওই সময়ে অনেক রাজনীতি-সচেতন মানুষ বলেছিলেন, মির্জা ফখরুল ইসলামই এ সময়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন। বাস্তবে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বাংলাদেশে রাজনীতির সব সমস্যার সমাধান সব সময়ই রাস্তায় হয়। রাজনীতিবিদের সেখানে দায়িত্ব থাকে, রাজনীতি যেন রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকে।
এর আগে ১৯৯০-তে মাস-আপরাইজিংয়ের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটে। তাঁর পতনের পরে রাজনীতি রাজনীতিবিদ অর্থাৎ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার হাতেই মূলত ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবে এরশাদের পতনের পরে পরবর্তী ক্ষমতার গোলপোস্টটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সামনে এসেছিল। তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ক্ষমতায় যায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে বসে। দেশের রাজনীতির যা সংস্কার করা দরকার ছিল তখন—অর্থাৎ সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরা—সেটা পার্লামেন্টে বৈধভাবেই হয়।

এরপরে আবার খালেদা জিয়ার সরকার ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন করলে দেশে মাস-আপরাইজিং হয়। খালেদা জিয়ার সরকারের পতন হয়। পতনের আগে জনগণের দাবির অনুযায়ী তিনি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যোগ করেন। যার ফলে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিকভাবে গঠিত হয়। তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হয়। ক্ষমতার গোলপোস্ট শুধু নয়, দেশের সব কিছু তখন রাজনীতিবিদদের হাতে ছিল। তিন মাসের মধ্যে রাজনীতিবিদের ইচ্ছা ও মতামত অনুযায়ী নির্বাচন হয়।
কিন্তু জুলাই আন্দোলন মধ্য-জুলাই থেকে ভিন্ন দিকে টার্ন নিলে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন—যেভাবে আওয়ামী লীগের পতন হতে যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতার গোলপোস্টটি দ্রুত তাঁদের সামনে আসবে না।
বাস্তবতাও তাই দেখা গেল—৫ আগস্টের পরে বিএনপির কর্মীরা অনেক কিছু ভাঙচুর ও দখল করতে সমর্থ হলো, কিন্তু ক্ষমতার গোলপোস্ট তাঁদের সামনে এখনও আসেনি। এবং আওয়ামী লীগের পতন হলো বটে, তবে ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের হাতে থাকেনি। বরং যারা মির্জা ফখরুলের একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলে ধন্য হতেন, তারা রাজনীতির মঞ্চে গিয়ে বসলেন, আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ তাঁদের সামনে ছাত্রের মতো চেয়ারে বসে সংস্কারের গল্প শুনতে বাধ্য হতে হলেন।

হয়তো এই বাস্তবতা আঁচ করতে পেরেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে বলেছিলেন।
কারণ, এটাও তো সত্য, আওয়ামী লীগ যতই উন্নয়ন করুক না কেন, তাদের নেতাদের আচরণ থেকে শুরু করে অনেক উপাদান মিলিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার সময়টি দ্রুত কাছে চলে আসছিল। এবং স্বাভাবিকভাবে সেটা ঘটলে দেশ রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকত। তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন হতো—আর সেক্ষেত্রে তখন ক্ষমতায় যাওয়ার গোলপোস্টটি স্বাভাবিকভাবে বিএনপির সামনে এসে দাঁড়াত।
কিন্তু গত সতেরো মাসের বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির সামনে ক্ষমতায় যাওয়ার গোলপোস্টটি শুধু অনিশ্চিত হয়নি—দেশের অনেক কিছুই অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। যার ফলে যে নির্বাচনী গোলপোস্টটি বসানো হয়েছে, তা নিয়ে বিএনপি নেতা সংশয় প্রকাশ করছেন। নির্বাচনী পরিবেশ শুধু নয়, দেশ কোন পথে হাঁটছে সে ভয়াবহতার ফোরকাস্ট ইঙ্গিতে জানিয়ে দিচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তাছাড়া যে ফুটবল ম্যাচের ঘোষণা ও গোলপোস্টটি বসানো হয়েছে—ওই ম্যাচে যদি কাপ পাওয়াও যায়—সেটা কতক্ষণ ক্লাবের শেলফে রাখা যাবে—সে পরীক্ষা তো শেখ হাসিনার মাধ্যমে একবার হয়েই গেছে!
তাই সেই পুরোনো ম্যাচ আবার হবে… না, নির্বাচনী গোলপোস্টের পেছনে যাদুকরের কোনো ম্যাজিক আছে?
কারণ যাই হোক, দেশ ও রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এ সময়ে ম্যাজিশিয়ানরাই রাষ্ট্রের বড় খেলোয়াড়।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World।

স্বদেশ রায় 


















