দীপু দাসের মৃত্যু সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ওই রাতে লাইভ দেখেছিলাম। কষ্ট পেয়েছিলাম কিনা বলতে পারি না। কারণ, বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য শুধু নয় বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এই প্লেগের ভয়ে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কিত।
যেমন দীপু দাসের মৃত্যুর দিন দুয়েক আগে একজন বিদেশি বাংলাদেশের হিন্দুদের উদ্ধার করবার বিষয়ে বহু পন্থার কথা বলে যখন আমার মত চাইলেন। আমি তাঁকে রবীন্দ্রনাথের “একরাত্রি” গল্পের এ কটি লাইন তাকে বলি, “.. একদিন ছুটির দিনে রাম লোচন বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়েছি, মনে নাই কী বিষয়ে আলোচনা হইতেছিল, বোধ করি ভারতবর্ষের দুরবস্থা সম্পর্কে। তিনি যে সে বিষয়ে বিশেষ চিন্তিত এবং ম্রিয়মাণ ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু বিষয়টা এমন যে তামাক টানিতে টানিতে, এ সম্বন্ধে ঘণ্টাখানেক-দেড়েক অনর্গল শখের দুঃখ করা যাইতে পারে”।
ভদ্রলোক একটু বিব্রত হলেন। কিন্তু এই শখের দুঃখ শোনার অভিজ্ঞতা শুধু যে আমাদের এই প্লেগের সময় হয়েছে তা নয়। বলা যেতে পারে এ আমাদের আজন্ম সঙ্গী। এমনকি সাহিত্য আড্ডায়ও বাদ যায় না।
যেমন আগে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যিকরা প্রায় বাংলাদেশে আসতেন। বহু খাতির যত্ন পেতেন। এবং তাদেরকে ভালো হুইস্কিই খাওয়ানো হতো। সঙ্গে নানা ধরনের মাছ। তখন বাংলাদেশে মাছের অভাব ছিল না। এমন আড্ডার মাঝরাতে যখন সবাই একটু ঝিমিয়ে যায়, সে সময় নতুন একজন কবি বা সাহিত্যিক পরিচিত হতে গিয়ে নামটি শোনার পরে একটু গা ঘেঁষে বসতেন। তারপর খুব আস্তে বলতেন, “আপনারা এখানে কেমন আছেন বলুন তো”।

বুঝতে পারতাম শখের দুঃখ এখন শুরু হবে। তাই তাড়াতাড়ি বলতাম, “দাদা, আরেক পেগ দেই। আর এ মাছটা একটু টেস্ট করতে পারেন, এটা মেঘনার পিয়ালি মাছ। ছোট হলেও এ মাছ ফ্রাইয়ের স্বাদ আলাদা। অন্য কোথাও পাবেন না।”
একদিকে যেমন আমাদের এই শখের দুঃখ ও ভাগ্য বদলের অনেক ইউটোপীয় ধারণা সহ্য করতে হয় তেমনি ২০০১ সালে ভোলা, বাগেরহাট, রামশীলের নারী নির্যাতন, হত্যা, লুঠ সর্বোপরি পূর্ণিমা শীলের মুখও সহ্য করে আমাদের হাসতে হয়।
তখন অবশ্য ওয়াহিদুল হক, ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন। আরও অনেকে ছিলেন। কিন্তু এখন নাম উল্লেখ করলে তাদের বিপদ আরও বাড়বে।
তাছাড়া সেই তারুণ্য, যৌবন সবই চলে গেছে। এখন তো রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবসা এগুলো একটু হলেও বুঝি।
তাই নির্মম হলেও সত্য বলি, দীপু দাসের মৃত্যু দেখেও কষ্ট পেতে সাহস পাইনি। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ফেসবুকে চার লাইনের একটি পোস্ট দেন। প্রথম দুই লাইন উল্লেখ করার সাহস আমার নেই। শেষের দুই লাইনের সঙ্গে মনে হয় বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু একমত যেন, “দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আমাদেরকে সঙ্গে না নিও, একটু বাঁচতে দিও”।
আমার বন্ধু বান্ধব শুধু নয়, আপনজন বলতে যা বোঝায়, যে পরিমণ্ডলে বড় হয়েছি, এখনও চলাচল করি—সবাই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। তারা সেক্যুলার। তাদের অনেকে পরের দিন সকালে দীপু দাসের মৃত্যুর কথা আমার সঙ্গে বলতে যেমন সংকুচিত হয়েছেন—তাতে এখনও আশা রাখি বাংলাদেশের এই “প্লেগ” কেটে যাবে।

কারণ, বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত হিন্দু কমে যাচ্ছে ঠিকই। তবে স্বাধীনতার পরে হিন্দুদের ওপর রাষ্ট্র অত্যাচার করার সুযোগ দিয়েছে দুইবার। প্রথমবার ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পরে। আর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে।
২০০১ সালের হিন্দু নির্যাতন মাস তিনেক ধরে চলেছিল। আর এখন তো হিন্দুদের জন্য একটা প্লেগ চলছে। আর প্লেগ হলে যা হবার তাই তো হবে।
এ নিয়ে কোথায় কী রাজনীতি হলো, কে বিবৃতি দিল তা হাজার হাজার দীপু দাসের কোনো কাজে আসে না।
তাই সত্য বলি—গার্মেন্টসে চাকরি করা দরিদ্র দীপু দাসকে ওইভাবে পিটিয়ে, গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন দিয়ে যখন পোড়ানোর দৃশ্য আমাকেও হৃদয়হীন করে ফেলেছিল। বরং আমি এক কঠিন বাস্তবে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আসলে দীপু দাসকে যেভাবে পোড়ানো হয়েছে তা দারিদ্র্য বিমোচনের একটা অংশ। পশ্চিমারা ইচ্ছে করলে এ মডেলটিও নিতে পারে। যদিও তারা মৃতদেহ সৎকার করে মাটিতে কবর দেয়। কিন্তু এখনও যেসব সমাজে আগুনে পোড়ানোর আচরণ আছে—সেখানে তারা এটা চালু করে দিতে পারে—একেবারে মাইক্রো লেভেলে। যে কোনো ফাউন্ডেশন বা গভর্নর এটাকে গ্রহণ করতে পারে মৃত্যুকালীন দারিদ্র্য বিমোচনের একটি নতুন উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক ফর্মুলা হিসেবে।
কারণ, দরিদ্র দীপু দাসকে মারার পরে যদি তারা দেহটি ফেলে যেত—তাহলে দীপু দাসের বৃদ্ধ বাবা ও অসহায় বিধবা স্ত্রীর কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা দাহ করার জন্য খরচ হতো। তার বদলে তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে ওই পাঁচ হাজার টাকার দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করেছে।

পাঁচ হাজার টাকা খরচের বিষয়টি জেনেই বলছি। কারণ, সম্প্রতি পরিচিত একজনের বাবা মারা গেছেন। তিনি জানালেন, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ চালিত শ্মশানের ব্যবস্থা করে গেছে। যে কারণে এখন পাঁচ হাজার টাকা দিলেই শবদেহ দাহ হয়ে যায়। কাঠ কিনতে গেলে তো অন্তত বিশ হাজার টাকার কাঠ লাগত। তাই অন্তত পাঁচ হাজার টাকা তো ওই পরিবারের বেঁচে গেছে। এবং সেটা সুদও নয়, তার কোনো কিস্তিও দিতে হবে না। এটা সমবায় ভিত্তিক ঘটেছে বা রাষ্ট্রকে এমন সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এটা ঘটছে।
তাই সত্যি অর্থে দীপু দাসের মৃত্যুর পরে কয়েকদিন কেবলই মনে হয়েছিল—দীপু দাসরা মারা যাক, দারিদ্র্য বিমোচনের এই ফর্মুলার পরীক্ষা নিয়ে তো কোনো কথা বলা উচিত নয়।
কিন্তু গুরুদশাগ্রস্ত সাদা কাপড় পরা দীপু দাসের বাবার একটি ভিডিও কে করেছে জানি না। নির্মমভাবে নিহত হওয়া পুত্রের অসহায় পিতা—মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে—“বাবারে এই পোষাকটি তুই পরতি বাবা, সেটাই আমি পরতি…”।
ওই কাপড়টির সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে আমিও পরিচিত। বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পরে তাদের মতো আমিও পরেছি। এমনকি মাত্র দু বছর আগে পিতা ও মাতার মৃত্যুকে স্মরণ করে বেনারসের গঙ্গায় ওই কাপড় পরে নেমেছি। সেটাকে একটা পবিত্র কিছু মনে হতো। জানতাম না এ কাপড় এত ভারী হতে পারে—যার বোঝা বহন করা যায় না। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ সব থেকে ভারী জানতাম—কিন্তু দীপু দাসের পিতার শরীরের সাদা কাপড় জানিয়ে দিল—পুত্রের সৎকারের কাপড় পিতার শরীরে কত ভারী—আর তা রোগে, বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে নয়। শুধু সংখ্যালঘু বলে দরিদ্র পিতার সাধারণ কাজ করা পুত্র যখন নির্মমতার বলি হয়—তখন তার ভার কে মাপতে পারে!
অথচ এর কোনো প্রতিকার নেই—বরং বণিকের মানদণ্ড আর রাজদণ্ডের খেলায় দীপু দাসদের পিতা রবি দাসদের যে আর কত এ কাপড় পরতে হবে—তা কেউ জানে না।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 



















