১০:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫
২০২৬ সাল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচ ব্যবহার নিষিদ্ধ তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন: সালাহউদ্দিন চীনের হাতে বৈশ্বিক ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের নিয়ন্ত্রণ সিঙ্গাপুরের সাহিত্যকে এগিয়ে নিতে নিজের সম্পদ ঝুঁকিতে ফেলছেন এডমন্ড উই মৃত্যুহীন প্রসবের লক্ষ্য: ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাফল্য প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৩২) আমেরিকায় খাদ্যপরামর্শে ফেরত আসছে পুরোনো ‘ফুড পিরামিড’ বিতর্ক সিঙ্গাপুর বায়েনাল ২০২৫: শহরটাই হয়ে ওঠে খোলা একটি আর্ট গ্যালারি হিজাব পরা রেসলিং তারকা নূর ‘ফিনিক্স’ ডায়ানার আগুন থেকে উঠে দাঁড়ানোর গল্প পাকিস্তান আইডলে টপ–১৬–এ রোমাইসা তারিক: “এই শো আমার জীবন পুরো বদলে দিয়েছে”

বিজয়ের মাসের প্রথম দিন: সাধারণ রাজাকার ও হোয়াইট কলার রাজাকারের দ্বন্দ্বের নমুনা

বছর ঘুরে বাঙালির সামনে এসেছে আবার বিজয়ের মাস। বাংলাদেশের হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করাই বাঙালির একমাত্র গৌরবের অর্জন। যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা বহমান ততকালই বাঙালি তার এই অর্জনের ইতিহাস বুকে ধারণ করে থাকবে। এবং একে স্মরণ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে।
এই স্মরণ ও ধারণ করা কখনও কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়। এ গভীর চর্চার কাজ। ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে খুঁড়ে খুঁড়ে চর্চা করলেই শুধুমাত্র একে ধারণ করা হবে।
নিজস্ব ইতিহাসকে না জানলে বা অস্বীকার করলে যে জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে একটি ভূখন্ডে ওই জনগোষ্ঠী মূলত জঙ্গলের প্রাণীর মতো।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ১৯৭১ বাঙালির মহাকাব্য।
মহাকাব্যের মহাসাগরে থাকে অযুত নিযুত ঘটনা। যা ছড়িয়ে থাকে ছোট শিশুর মুখ থেকে বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যমের ডেসপাচ-ও। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে আজকের প্রজন্মের জন্য তাই বিশ্বখ্যাত সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সের ১১ অক্টোবর ১৯৭১ এর একটি ডেসপাচ (বার্তা) এখানে উল্লেখ করছি।

People’s Party Leader Admits Razakar Terror

A leading people’s party official dropped out of the party delegation hours before it left for East Bengal, alleging that power in the eastern wing had been handed over to reactionary and anti-people parties who had massacred political opponents.

Meiraj Mohamad Khan, the party’s Karachi secretary, said yesterday (October 10) that he felt it was “futile for me to go”.

The 10-man party delegation was scheduled to go to Dacca to survey the situation in view of the forthcoming by-election for 78 seats formally held by members of the Awami League.

Meriraj alleged that in East Bengal, “power in effect has been transferred to the reactionary and anti-people political parties defeated in the election and rejected by the people”.

He named one party – the Muslim Jamaat–e–Islam group – which is involved in the wholesale massacre of political opponents, for which they are using their Razakars.

Meiraj, who has influence among students, added: “Under the umbrella of a government consisting of members of defeated and reactionary parties, an election cannot be free.”

His action came as President Yahya Khan lifted the six-month ban, with effect from yesterday (October 10), on political activity in Pakistan, but laid down stringent rules for the conduct of parties and politicians.

People’s Party leader Mr. Zulfikar Ali Bhutto told the party delegation yesterday (October 10), “We have watched with great anguish developments over the last eight months, and I want you to convey to our brothers in the eastern wing our commitment towards national reconciliation and rebuilding a progressive and tranquil Pakistan.”

Mr. Bhutto said Pakistan must stop killing Pakistanis and “live peacefully and with charity towards all.”

Mr. Bhutto said much blood had flown and “we have seen the great tragedy of Pakistanis killing Pakistanis, which has brought the nation to the crossroads.”

He said East Bengal was exploited in the past, and its people were poorer. “The voice of the majority of people of East Bengal must be given its due weight”. Mr. Bhutto added.

( Reuter dispatch dateline Karachi- October 11, 1971)

[পাকিস্তানের পিপলস পার্টির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা অভিযোগ করেন যে পূর্ব বাংলায় ক্ষমতা এমন সব প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিরোধী রাজনৈতিক দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে—যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হত্যা করেছে। এ অভিযোগ জানানোর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি পূর্ব বাংলায় রওনা হওয়ার কথা থাকা দলীয় প্রতিনিধিদল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।

পিপলস পার্টির করাচি সম্পাদক মীরাজ মোহাম্মদ খান গতকাল (১০ অক্টোবর) বলেন যে তার পক্ষে “যাওয়া অর্থহীন হবে।”

দলটির ১০ সদস্যের এই প্রতিনিধিদলের ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল; তারা সেখানে ৭৮টি আসনের উপনির্বাচনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করতেন—যে আসনগুলো আগে আওয়ামী লীগের সদস্যদের দখলে ছিল।

মীরাজ অভিযোগ করেন যে পূর্ব বাংলায় “ক্ষমতা বাস্তবে হস্তান্তর করা হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে—যারা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে এবং জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।”

তিনি একটি দলের নাম উল্লেখ করেন—মুসলিম জামাত-ই-ইসলামী—যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, এবং এই কাজে তারা তাদের রাজাকার বাহিনীকে ব্যবহার করছে।

ছাত্রসমাজে যিনি প্রভাবশালী, সেই মীরাজ আরও বলেন, “পরাজিত ও প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে গঠিত সরকারের ছায়ায় কোনো নির্বাচনই অবাধ হতে পারে না।”

এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল (১০ অক্টোবর) থেকে কার্যকরভাবে ছয় মাসের রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, তবে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের জন্য কঠোর নিয়ম আরোপ করেন।

পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো গতকাল (১০ অক্টোবর) প্রতিনিধিদলকে বলেন, “গত আট মাসের ঘটনাবলি আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি। পূর্ব পাকিস্তানের আমাদের ভাইদের কাছে আপনারা আমাদের জাতীয় পুনর্মিলন এবং একটি প্রগতিশীল ও শান্ত পাকিস্তান গঠনের অঙ্গীকার পৌঁছে দেবেন।”

ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই পাকিস্তানিদের হত্যা বন্ধ করতে হবে এবং “সবার সঙ্গে শান্তি ও মানবিকতায় থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন যে বহু রক্ত ঝরেছে, এবং “আমরা দেখেছি পাকিস্তানিদের হাতে পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাকাণ্ড—যা জাতিকে একটি সংকটাপন্ন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে।”

তিনি বলেন, পূর্ব বাংলা অতীতে শোষিত হয়েছে এবং সেখানকার মানুষ আরও দরিদ্র ছিল। “পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কণ্ঠস্বরকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে,” যোগ করেন ভুট্টো।

(রয়টার্সের বার্তা, করাচি — ১১ অক্টোবর, ১৯৭১)]

রয়টারের এই নিউজটির একটু পটভূমি ও বিশ্লেষণঃ
রয়টার যখন এই নিউজটি করেছে সে সময় ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান যাতে স্বাধীন বাংলাদেশ না হয়ে যায় তা ঠেকানোর জন্যে উপ-নির্বাচনের চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তান পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পেয়েছিলো তার মধ্যে ৭৭টিতে তার এই উপ-নির্বাচনের চেষ্টা ছিলো। তার আগে তিনি পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবৈধ আইনে বিচার শুরু করে ফাঁসি দেবার দিকে এগিয়ে গেছেন। এবং আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে কার্যত কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী দল মৌলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির- ভাসানীর নেতৃত্ব মেনে যারা ছিলেন তাদের, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ) এবং পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিরও।

এমন একটি অবস্থায় এই নির্বাচন ঘোষণা করার পরে রয়টার্সের ওই নিউজে দেখা যাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভেতর নির্বাচন নিয়ে চরম দ্বন্দ্বটা এই পর্যায়ে গেছে যে পিপলস পার্টির নেতা মি. ভুট্টো জামায়াত-ই-ইসলামীকে শুধু রাজাকার বলছে না তাদেরকে গণহত্যাকারীও বলছে।

রাজাকাররা সেদিন নিজ হাতে গণহত্যা করেছিলো এটা সত্য। কিন্তু বাংলাদেশে ততদিনে অন্তত ২০ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল দলের কর্মী ও সমর্থক এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন- না হয় গোপনে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এ সবই ঘটেছে সরকারের মাধ্যমে ও সহযোগিতায়। যার ব্লুপ্রিন্ট এর অন্যতম রূপকার মি. জুলফিকার আলী ভুট্টো।

তাই তিনিও রাজাকারের বাইরে নন। পার্থক্য হলো তিনি হোয়াইট কলার রাজাকার। তার দলও হোয়াইট কলার রাজাকারদের দল। মূলত তার সঙ্গে সাধারণ রাজাকারদের কোনো পার্থক্য আগে ছিলো না। এদের উভয়েরই শত্রু আওয়ামী লীগ ও তার সহযাত্রী অন্য প্রগতিশীল দলগুলো।

কিন্তু সরকার আওয়ামী লীগও তার সহযাত্রী প্রগতিশীল দলগুলোকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে, তাদেরকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে নির্বাচন করার চেষ্টা শুরু করতেই- এই মাঠের রাজাকার ও হোয়াইট কলার রাজাকারদের মধ্যে ক্ষমতায় যাবার আশায় দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। আর সেই ইতিহাসের একটি উদাহরণ রয়টার্সের এই ডেসপাচটি।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

জনপ্রিয় সংবাদ

২০২৬ সাল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচ ব্যবহার নিষিদ্ধ

বিজয়ের মাসের প্রথম দিন: সাধারণ রাজাকার ও হোয়াইট কলার রাজাকারের দ্বন্দ্বের নমুনা

১১:৫৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫

বছর ঘুরে বাঙালির সামনে এসেছে আবার বিজয়ের মাস। বাংলাদেশের হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করাই বাঙালির একমাত্র গৌরবের অর্জন। যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা বহমান ততকালই বাঙালি তার এই অর্জনের ইতিহাস বুকে ধারণ করে থাকবে। এবং একে স্মরণ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে।
এই স্মরণ ও ধারণ করা কখনও কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়। এ গভীর চর্চার কাজ। ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তে খুঁড়ে খুঁড়ে চর্চা করলেই শুধুমাত্র একে ধারণ করা হবে।
নিজস্ব ইতিহাসকে না জানলে বা অস্বীকার করলে যে জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে একটি ভূখন্ডে ওই জনগোষ্ঠী মূলত জঙ্গলের প্রাণীর মতো।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ১৯৭১ বাঙালির মহাকাব্য।
মহাকাব্যের মহাসাগরে থাকে অযুত নিযুত ঘটনা। যা ছড়িয়ে থাকে ছোট শিশুর মুখ থেকে বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যমের ডেসপাচ-ও। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে আজকের প্রজন্মের জন্য তাই বিশ্বখ্যাত সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সের ১১ অক্টোবর ১৯৭১ এর একটি ডেসপাচ (বার্তা) এখানে উল্লেখ করছি।

People’s Party Leader Admits Razakar Terror

A leading people’s party official dropped out of the party delegation hours before it left for East Bengal, alleging that power in the eastern wing had been handed over to reactionary and anti-people parties who had massacred political opponents.

Meiraj Mohamad Khan, the party’s Karachi secretary, said yesterday (October 10) that he felt it was “futile for me to go”.

The 10-man party delegation was scheduled to go to Dacca to survey the situation in view of the forthcoming by-election for 78 seats formally held by members of the Awami League.

Meriraj alleged that in East Bengal, “power in effect has been transferred to the reactionary and anti-people political parties defeated in the election and rejected by the people”.

He named one party – the Muslim Jamaat–e–Islam group – which is involved in the wholesale massacre of political opponents, for which they are using their Razakars.

Meiraj, who has influence among students, added: “Under the umbrella of a government consisting of members of defeated and reactionary parties, an election cannot be free.”

His action came as President Yahya Khan lifted the six-month ban, with effect from yesterday (October 10), on political activity in Pakistan, but laid down stringent rules for the conduct of parties and politicians.

People’s Party leader Mr. Zulfikar Ali Bhutto told the party delegation yesterday (October 10), “We have watched with great anguish developments over the last eight months, and I want you to convey to our brothers in the eastern wing our commitment towards national reconciliation and rebuilding a progressive and tranquil Pakistan.”

Mr. Bhutto said Pakistan must stop killing Pakistanis and “live peacefully and with charity towards all.”

Mr. Bhutto said much blood had flown and “we have seen the great tragedy of Pakistanis killing Pakistanis, which has brought the nation to the crossroads.”

He said East Bengal was exploited in the past, and its people were poorer. “The voice of the majority of people of East Bengal must be given its due weight”. Mr. Bhutto added.

( Reuter dispatch dateline Karachi- October 11, 1971)

[পাকিস্তানের পিপলস পার্টির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা অভিযোগ করেন যে পূর্ব বাংলায় ক্ষমতা এমন সব প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিরোধী রাজনৈতিক দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে—যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হত্যা করেছে। এ অভিযোগ জানানোর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি পূর্ব বাংলায় রওনা হওয়ার কথা থাকা দলীয় প্রতিনিধিদল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।

পিপলস পার্টির করাচি সম্পাদক মীরাজ মোহাম্মদ খান গতকাল (১০ অক্টোবর) বলেন যে তার পক্ষে “যাওয়া অর্থহীন হবে।”

দলটির ১০ সদস্যের এই প্রতিনিধিদলের ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল; তারা সেখানে ৭৮টি আসনের উপনির্বাচনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করতেন—যে আসনগুলো আগে আওয়ামী লীগের সদস্যদের দখলে ছিল।

মীরাজ অভিযোগ করেন যে পূর্ব বাংলায় “ক্ষমতা বাস্তবে হস্তান্তর করা হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে—যারা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে এবং জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।”

তিনি একটি দলের নাম উল্লেখ করেন—মুসলিম জামাত-ই-ইসলামী—যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, এবং এই কাজে তারা তাদের রাজাকার বাহিনীকে ব্যবহার করছে।

ছাত্রসমাজে যিনি প্রভাবশালী, সেই মীরাজ আরও বলেন, “পরাজিত ও প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে গঠিত সরকারের ছায়ায় কোনো নির্বাচনই অবাধ হতে পারে না।”

এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল (১০ অক্টোবর) থেকে কার্যকরভাবে ছয় মাসের রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, তবে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের জন্য কঠোর নিয়ম আরোপ করেন।

পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো গতকাল (১০ অক্টোবর) প্রতিনিধিদলকে বলেন, “গত আট মাসের ঘটনাবলি আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি। পূর্ব পাকিস্তানের আমাদের ভাইদের কাছে আপনারা আমাদের জাতীয় পুনর্মিলন এবং একটি প্রগতিশীল ও শান্ত পাকিস্তান গঠনের অঙ্গীকার পৌঁছে দেবেন।”

ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই পাকিস্তানিদের হত্যা বন্ধ করতে হবে এবং “সবার সঙ্গে শান্তি ও মানবিকতায় থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন যে বহু রক্ত ঝরেছে, এবং “আমরা দেখেছি পাকিস্তানিদের হাতে পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাকাণ্ড—যা জাতিকে একটি সংকটাপন্ন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে।”

তিনি বলেন, পূর্ব বাংলা অতীতে শোষিত হয়েছে এবং সেখানকার মানুষ আরও দরিদ্র ছিল। “পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কণ্ঠস্বরকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে,” যোগ করেন ভুট্টো।

(রয়টার্সের বার্তা, করাচি — ১১ অক্টোবর, ১৯৭১)]

রয়টারের এই নিউজটির একটু পটভূমি ও বিশ্লেষণঃ
রয়টার যখন এই নিউজটি করেছে সে সময় ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান যাতে স্বাধীন বাংলাদেশ না হয়ে যায় তা ঠেকানোর জন্যে উপ-নির্বাচনের চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তান পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পেয়েছিলো তার মধ্যে ৭৭টিতে তার এই উপ-নির্বাচনের চেষ্টা ছিলো। তার আগে তিনি পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবৈধ আইনে বিচার শুরু করে ফাঁসি দেবার দিকে এগিয়ে গেছেন। এবং আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে কার্যত কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী দল মৌলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির- ভাসানীর নেতৃত্ব মেনে যারা ছিলেন তাদের, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ) এবং পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিরও।

এমন একটি অবস্থায় এই নির্বাচন ঘোষণা করার পরে রয়টার্সের ওই নিউজে দেখা যাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভেতর নির্বাচন নিয়ে চরম দ্বন্দ্বটা এই পর্যায়ে গেছে যে পিপলস পার্টির নেতা মি. ভুট্টো জামায়াত-ই-ইসলামীকে শুধু রাজাকার বলছে না তাদেরকে গণহত্যাকারীও বলছে।

রাজাকাররা সেদিন নিজ হাতে গণহত্যা করেছিলো এটা সত্য। কিন্তু বাংলাদেশে ততদিনে অন্তত ২০ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল দলের কর্মী ও সমর্থক এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন- না হয় গোপনে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এ সবই ঘটেছে সরকারের মাধ্যমে ও সহযোগিতায়। যার ব্লুপ্রিন্ট এর অন্যতম রূপকার মি. জুলফিকার আলী ভুট্টো।

তাই তিনিও রাজাকারের বাইরে নন। পার্থক্য হলো তিনি হোয়াইট কলার রাজাকার। তার দলও হোয়াইট কলার রাজাকারদের দল। মূলত তার সঙ্গে সাধারণ রাজাকারদের কোনো পার্থক্য আগে ছিলো না। এদের উভয়েরই শত্রু আওয়ামী লীগ ও তার সহযাত্রী অন্য প্রগতিশীল দলগুলো।

কিন্তু সরকার আওয়ামী লীগও তার সহযাত্রী প্রগতিশীল দলগুলোকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে, তাদেরকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে নির্বাচন করার চেষ্টা শুরু করতেই- এই মাঠের রাজাকার ও হোয়াইট কলার রাজাকারদের মধ্যে ক্ষমতায় যাবার আশায় দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। আর সেই ইতিহাসের একটি উদাহরণ রয়টার্সের এই ডেসপাচটি।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.