চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী এরশাদুল্লাহ বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় অস্ত্রধারীদের গুলিতে আহত হয়ে—এই লেখা যখন লিখছি তখন তিনি হাসপাতালে। তাঁর এক সহকর্মীও গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে।
দুই দিন হলো বিএনপি তাদের ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এবার যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে, যার শিডিউল এখনও ঘোষণা করা হয়নি, ওই নির্বাচনে বিএনপির পরে বড় দল জামায়াতে ইসলামী।
এরশাদুল্লাহ যে সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তার কিছু আগেই জামায়াতে ইসলামী জনসভা করে দাবি করেছে—তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অতীত ভোট রেকর্ড হিসাব করলে আকাশ–পাতাল পার্থক্য। তবে বর্তমান ইন্টারিম ব্যবস্থার আশীর্বাদ কার ওপর, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
তবে সে সব প্রশ্নের থেকে বড় প্রশ্ন হলো, বিএনপি প্রার্থী ঘোষণার দুই দিন পরে নির্বাচনী প্রচারের—এক কথায় প্রথম দিনের প্রচারে যে ঘটনা ঘটলো—এমনটি কি ইন্টারিম ব্যবস্থার অজানা ছিল? মোটেই অজানা কোনো বিষয় নয়।

কারণ, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ইন্টারিম প্রধান ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের সভায় যাকে তার পূর্ববর্তী সরকারের পতন ঘটানোর ‘অ্যামেজিং মেটিকুলাস ডিজাইনারদের’ অন্যতম বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি এখন তার ব্যবস্থার একজন উপদেষ্টা—তিনি এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, আগামী মাস থেকে বিশেষ নির্বাচনের ঘোষণার পর থেকেই দেশের অবস্থা ভয়াবহ হবে।
তিনি যেহেতু মেটিকুলাস ডিজাইনার, তিনি ভবিষ্যৎ দেখতেই পাবেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় অতি সাধারণ মানুষও এই বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছে।
কারণ, “নির্বাচনের পরিবেশ” বলে একটা কথা আছে। রাজনীতিবিদ, যারা নির্বাচন করেন, বা যারা নির্বাচন পরিচালনা করেন—তারা সকলেই জানেন, নির্বাচনী পরিবেশ বলতে কী বোঝায়।
যেকোনো সরকারকে কোনো নির্বাচন করার আগে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে হয়। এবং নির্বাচনী পরিবেশে সব থেকে বড় বিষয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
বর্তমানে যারা সরকারে আছেন, তাদের একটি অ্যাটিচিউড—শক্তি দিয়ে সব ধরনের পরিবেশ তৈরি করা যায়। তার সঙ্গে অনেক কিছুই অস্বীকার করা যায়।
শক্তি দিয়ে সব সময়ই ভেঙে ফেলা যায়, কোনো কিছু গড়া যায় না। গড়ার জন্য প্রয়োজন হয় সমঝোতা ও আইনকে মান্য করা। আর সর্বোপরি যার কাজ তার করা।

দেশের নির্বাচনী পরিবেশ সব সময়ই তৈরি হয় রাজনৈতিক সমঝোতা ও প্রশাসনের তৎপরতা ও দক্ষতার ওপর।
বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, মিলিটারি প্রশাসন যে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্য দক্ষ তা তারা যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই প্রমাণ করেছে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮—এ তারা দেশকে ভালো নির্বাচন দিতে তাদের সক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচন সব সময়ই সিভিল প্রশাসন করে। মিলিটারি প্রশাসন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকে। তারপরও মিলিটারি প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মিডিয়া যখনই স্বাধীনতা পেয়েছে, তখনই তারাও নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে তাদের যে ভূমিকা সেটাও পালন করেছে। আবার যখনই সরকার কঠোর হয়েছে, শক্তিকেই সব কিছু মনে করেছে, রাষ্ট্রকে দানবীয় শক্তির মতো কাজে লাগিয়েছে—তখনই মিডিয়া গুটিয়ে গেছে।
কারণ, সাংবাদিকরা কেউ ভিন্ন গ্রহ থেকে আসেনি। তাদের অধিকাংশই রক্ত দিয়ে বিপ্লবী হওয়ার জন্য সাংবাদিকতার পেশায় আসেনি। কোনো সরকার পতনের পরে কোনো প্রকৃত সাংবাদিকের কাছে সেটা একটা খবর ছাড়া কোনো উল্লাসও হয় না। এমনকি ওই সরকার তার পছন্দের বা অপছন্দের যাই হোক না কেন। কারণ, মিডিয়া আর যাই হোক সরকারি দল বা বিরোধী দল নয়।

কিন্তু বর্তমানে যে পরিবেশে নির্বাচন করবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করতে পারবে তাদের মধ্যে সব থেকে বড় দলটি যখন প্রার্থী ঘোষণা করেছে—এ সময়ে দেশের বাস্তবতা কী?
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের আগে ও পরে যে পুলিশ নির্মমভাবে নিহত হয়েছে বা তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, এবং হত্যা করার পরে গণমাধ্যমে বলা হয়েছে তাদেরকে হত্যা না করলে তারা এই ক্ষমতার পট পরিবর্তনে সফল হতো না। এই যে পুলিশ সদস্য যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে—তারা কেউ বিচার পাবে না। হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসনে গত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল বলে রেকর্ড সংখ্যক অভিজ্ঞ বুরোক্র্যাটকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। গত তিন নির্বাচনে কাজ করেছে—এই কারণে নির্বাচন থেকে তাদেরকে দূরে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি মিলিটারি বুরোক্রেসিকে খুব সম্মানের অবস্থানে রাখা হয়েছে—এ কথাও কি বলা যাবে?
অন্যদিকে ইন্টারিম ব্যবস্থা যাদেরকেই প্রতিপক্ষ মনে করছে, তাদেরকেই জেলে ঢুকাচ্ছে—তাই সে যেই হোক না কেন। হাজার হাজার মানুষকে জেলে নিয়েছে। তারা জামিনও পাচ্ছে না।
এর বাইরে সব থেকে বড় বিষয় আছে—যারা নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছে তাদের অনেকেই শিল্পপতি। বর্তমান বাস্তবতায় তাদের অনেকের হাজার হাজার কর্মী বেকার হতে বাধ্য হয়েছে।
তাছাড়া যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য বর্তমান ইন্টারিম ব্যবস্থার সদয় দৃষ্টি পেয়েছে—তারাও একত্র নয়। বরং সেখানেও আছে ‘থুসিডাইডিসের ট্রাপ’ অর্থাৎ পুরোনো শক্তিকে ধ্বংস করে দিয়ে নতুন শক্তির বিজয়কেতন ওড়ানোর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ যে কত ভয়াবহ যুদ্ধ এবং এ ধরনের যুদ্ধে কতটা নির্মমতা থাকে, তা ইতিহাসের যে কোনো ছাত্র মাত্রই জানে।

আর সচেতন বা অবচেতনভাবে হোক, এই যুদ্ধক্ষেত্র তৈরিতে, এই প্রতিহিংসার পরিবেশ তৈরিতে সরকার প্রতি মুহূর্তে সহায়তা করে যাচ্ছে।
সরকার এতদিন এই প্রতিহিংসার পরিবেশ তৈরি করে, আর প্রতিহিংসার পরিবেশে জেতার জন্য “প্রাইভেট বাহিনী” তৈরি করে, মব সন্ত্রাসকে সমর্থন করে—একটির পর একটি বিজয়কেতন উড়িয়েছে।
কিন্তু নির্বাচনে প্রাইভেট বাহিনীর জন্য যদি কণা পরিমাণও সুযোগ থাকে—তাহলে আর নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগই থাকে না।
বিএনপি প্রার্থী এরশাদুল্লাহ যেদিন বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, ওই দিন সকালে দেশের প্রধান বাংলা দৈনিকে পূর্বের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা তাঁর সাক্ষাৎকারে নির্বাচন করার বিষয়ে বর্তমানের ইন্টারিম ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি আরও অনেক প্রশ্ন তুলেছেন।
দেশের অনেক মানুষ সকালে তাঁর ওই সাক্ষাৎকার পড়েছেন। আর বিকেলে নির্বাচনী প্রচারের শুরুতেই গুলিবিদ্ধ প্রার্থীকে দেখতে পেল দেশের মানুষ।
এটাই কি ভবিষ্যতের জন্য অনেক বড় অশনি সংকেত নয়?
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 

















