১০:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫
সাঙ্গু নদী: পাহাড়ের কোলে জন্ম, জীবনের ধারায় প্রবাহ রণক্ষেত্রে (পর্ব-১১৬) পাকিস্তানে প্রথম চীনা নির্মিত সাবমেরিন- ২০২৬ সালে উদ্বোধন সরকার বলছে, নেত্র নিউজের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর প্রার্থী বাছাইয়ে নারীদের প্রতি অবহেলা: বিএনপির রাজনীতিতে অদৃশ্য অর্ধেক বাংলাদেশে এ শীতে ১০ দফা শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা: আবহাওয়া অধিদপ্তর ভ্যাটিকান মন্ত্রীর কক্সবাজার সফর: রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক সংহতির বার্তা শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন, দুই বোরসের সূচক নিম্নমুখী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হলেন মাহমুদুল হাসান রাজধানীতে মঙ্গলবার সিএনজি অটোরিকশা চালকদের সমাবেশ

নির্বাচন কি এখনও অনিশ্চিত, না কি ভোটারবিহীন?

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার আবহ

বাংলাদেশের ইন্টিরিম ব্যবস্থার প্রধানসহ কয়েক উপদেষ্টা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে রমাদানের আগে নির্বাচন হবে। সে অর্থে নির্বাচনের জন্যে সময় আছে তিন মাস ও কয়েকদিন।

কিন্তু এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ইন্টারিম ব্যবস্থা যে নির্বাচনটি করতে চাচ্ছে, তা অনেকটা একপক্ষীয় একটা নির্বাচন — যেমনটি শেখ হাসিনা করেছিলেন, ২০২৪ সালে। বাংলাদেশে সর্বশেষ ভালো নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

যদি ওই নির্বাচনের দল ভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের হারের হিসাব ধরা হয়, তাহলে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) ৩২.৫%, জামায়া-ই-ইসলামীর ৪.২৮% ও অনান্যদের যারা বিএনপি জামায়াতের অনেক কাছাকাছি তাদের প্রায় ৩% ভোটারকে বাদ দিয়ে অর্থাত্‌ দেশের মোট ভোটারের ৩৯.৭৮ (৪০% ধরা যেতে পারে) ভাগ ভোটারকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করেছিলেন।

বর্তমান ইন্টারিম ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তত্‌পরতা বন্ধ করেছে। নির্বাচন কমিশনও বলেছে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে না। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কিনা সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রশ্নে ধোঁয়াশা

কারণ, ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রধান বা তাদের সৃষ্ট কমিশনগুলো যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয় না। তাই তাদেরকেও যদি নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়, তাহলে ২০০৮ এর নির্বাচনের প্রাপ্ত ভোটের হিসাব অনুযায়ী নির্বাচনের বাইরে থাকবে আওয়ামী লীগের ৪৮.০৪%, জাতীয় পার্টির ৭.০৪% ও আওয়ামী লীগের জোটের ওয়ার্কাস পার্টি ও জাসদের মিলে ১.৯% — মোট ৫৬.১৭% ভোটার।

ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, লোকে বলে আওয়ামী লীগের ২০% ভোট এখনও আছে। কিন্তু তিনি তা বিশ্বাস করেন না। যে কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ সম্মান করা উচিত। কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর রাজনীতির বাস্তবতা কখনই এক সঙ্গে যায় না।

আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

যেমন অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগ এখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের থেকেও খারাপ অবস্থায়। ১৯৭৫ সালের পরে ১৯৭৯-এ যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায় আওয়ামী লীগ — ওই সময়ে আওয়ামী লীগ মূলত তিনভাগে ভাগ ছিলো।

তার ভেতর আওয়ামী লীগ (মালেক ও রাজ্জাক)কে মূল আওয়ামী লীগ মনে করতো ওই দলের কর্মীরা। বাকি মিজান চৌধুরি ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর আওয়ামী লীগকে মূল দল হিসেবে মনে করেনি আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরা।

ভোটের ইতিহাস ও ফলাফল

১৯৭৯ সালের নির্বাচন মোটেই ভালো নির্বাচন ছিলো না। তারপরেও মালেক-রাজ্জাক আওয়ামী লীগ ২৪.৫৬% ভোট পায়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনও ভালো নির্বাচন ছিলো না। তারপরেও আওয়ামী লীগ ২৬.১৬% ভোট পায়।

১৯৯১ এ বিএনপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছিলো। তবে বিএনপি পেয়েছিলো ৩০.৮১% ভোট আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ৩০.০৮% ভোট। বিএনপি মোট ভোট পায় ১ কোটি ৫০ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯ ভোট — এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ১ কোটি ২৫ লাখ ৯ হাজার ৮৬৬ ভোট।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের লুকানো দিক

ওই নির্বাচনের একটি বিষয় খুব বেশি আলোচনা হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ হিসেবে শেখ হাসিনার ভাষণকে দায়ী করা হলেও এ বিষয়টি সামনে আসেনি।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক জেনারেল সেক্রেটারী আব্দুর রাজ্জাক নিজে আওয়ামী লীগের প্রতীকে নির্বাচন করলেও একশ’র বেশি আসনে তাঁর দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) নিজস্ব প্রতীকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন করে । তারা মোট ভোটের ১.৮১% ভোট পায়।

বাকশাল ও আওয়ামী লীগের ভোট বিভাজন

এই ভোট সবই আওয়ামী লীগের ভোট। বাকশালের কারণে ৪০টিরও বেশি আসনে আওয়ামী লীগ ১শ’র কম ভোট থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়।

ওই সব আসনে বাকশাল প্রার্থী ৫০ হাজার থেকে ১০ হাজারের মতো ভোট পায়। বাকশালের মোট প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৬১ লাখ ৬০ হাজার ১৪। বাকশালের ভোট ও আওয়ামী লীগের ভোট যোগ হলে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮ শ ৮৮ ভোট। অর্থাত্‌ একক সংখ্যা গরিষ্ট দল বিএনপির থেকেও বাস্তবে ২৭ লাখের বেশি ভোট পেয়েছিলো আওয়ামী লীগ।

২০০৮-এর নির্বাচনের পর থেকে ভোট প্রবণতা

এরপরে ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪৪%, বিএনপি পায় ৩৩.৪০% আর জাতীয় পার্টি পায় ১৬.৪০%, জামায়াতে-ই-ইসলামী পেয়েছিলো মাত্র .১১%।

এর আগে ২০০১ এর নির্বাচনে ও ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের হার উল্লেখ করেছি। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাক্তন ছাত্র নেতা ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ নাজিম কামরান চৌধুরি ২০০৬ এ যে নির্বাচন হবার কথা ছিলো, ওই নির্বাচন নিয়ে যে জনমত জরিপ করেন, তার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা গিয়েছিলো — আওয়ামী লীগ যে ভোট পাবে ২০০৬ এর নির্বাচনে, যা মূলত ২০০৮ এ হয়েছিলো — ওই নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে তাদের ৪০ ভাগের বেশি আওয়ামী পরিবারের ভোট।

 

আওয়ামী পরিবারের সামাজিক প্রভাব

অর্থাত্‌ আওয়ামী লীগ ২০০৮ এ নির্বাচনে যে ৪৮.০৪% ভোট পেয়েছিলো, তার ৪০% এসেছিলো আওয়ামী পরিবার থেকে।

বাংলাদেশে আওয়ামী পরিবারের মতো ঠিক ওইভাবে অন্য কোন দলের মতাদর্শগত পরিবার হওয়া সম্ভব নয়। এর প্রধান কারণ দুটো — শেখ মুজিবই বাংলাদেশে একমাত্র কাল্ট, আর বাংলাদেশের সব থেকে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধ, যা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছিলো।

শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কাল্ট রাজনীতি

এই সর্বোচ্চ ঘটনা ও তাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কাল্টকে ঘিরে ওই অনুসারী পরিবার হবেই। যে কারণে একটি অংশ আওয়ামীলীগারদের কাছে আওয়ামী লীগ অনেকটা ধর্মের মতো।

শেখ হাসিনা নিজেও ৭৮ বছর বয়স এসেও এবং পাঁচ বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে ‘মুজিব কন্যা’ বা ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা’ হিসেবে পরিচয় দেন। এমনকি এখনও যে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল থেকে প্রায় প্রতিদিন যারা গ্রেফতার হচ্ছে, সে সব মিছিলের সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও ফুটেজ দেখলে শোনা যায়, তারা স্লোগান দেয় “শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধু” ও মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান “জয় বাংলা” ।

শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক বাস্তবতা

অন্যদিকে শেখ হাসিনার পতনের পরে অতি উত্‌সাহী কিছু মানুষ ওই ঘটনাকে বিপ্লব বলেছিলো, বেশি মানুষ গণ-অভূত্থান বলেছিলো, সেটা ৯০ ভাগ উড়িয়ে দেন — মুহাম্মদ ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশানে, শেখ হাসিনার পতন “দীর্ঘ মেটিকুলাস ডিজাইনের ফসল” বলে।

ইউনূসের এই স্বীকারোক্তি মূলত আওয়ামী লীগারদের ভিন্নভাবে ভাবিয়েছে — এরপর থেকে তারা মনে করে তাদের রাজনৈতিক পরাজয় হয়নি, ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে গেছে।

দমননীতি ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

এর পাশাপাশি দেশের ৫৫টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইন্টারিম ব্যবস্থা ও তার সমর্থক মাত্র ১৮টি রাজনৈতিক দল যারা জুলাই চার্টারে সই করেছে এবং ইউনুস সমর্থিত ছাত্রদের দল — এই ১৯টি দলের কিছু মানুষ সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বিচারে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করে এদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে।

যার ফলে দেখা যাচ্ছে — আওয়ামী লীগের এতবড় বিপর্যয়ের পরেও একজনও আওয়ামীলীগার বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয়নি। বরং বিএনপি থেকে জামায়াত, জামায়াত থেকে বিএনপিতে যাচ্ছে।

অর্থনীতিসমাজ ও জনমত

গত এক বছরে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়া, মার্কেটে মধ্যবিত্তের বিলাস পণ্যে ভয়াবহ রকম খরা — সব কিছু মিলে শুধু সোশ্যাল ফোরাম কেন, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এখন অনেকে বলতে শুরু করেছেন, “আগে ভালো ছিলাম।”

তাই ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রধানের কাছে আওয়ামী লীগের ভোটের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত হলেও বাস্তবতা কি সেটা সাধারণ মানুষ অর্থাত্‌ গ্রামে ও দরিদ্র শ্রেণীর ভেতর গিয়েই বুঝতে হবে।

রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি

তবে যারা রাজনীতিবিদ তারা অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যেমন বিশিষ্ট ছাত্র নেতা, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ওই দলের সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছিলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না — তিনি তার বর্তমান দল নিয়ে জুলাই চার্টারে সই করলেও প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশান (পি আর) পদ্ধতির পক্ষে নয়।

তিনি সাংবাদিক সম্মেলেনেই বলেছেন, পি আর পদ্ধতিতে যদি ভোট হয় আর আওয়ামী লীগ যদি অংশ গ্রহণ করার সুযোগ পায়, তাহলে তার ভাষায় “আমরা সবাই মিলে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে পারবো না।”

বিএনপির উদ্বেগ ও ঐক্যের বার্তা

বিষয়টি যে বিএনপিও বুঝছে না তা নয়। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ২৫ অক্টোবরে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, সবাইকে এক থাকতে হবে, নইলে ফ্যাসিস্ট (আওয়ামী লীগ) ফিরে আসবে।

অন্যদিকে ২৪ ও ২৫ দুই দিনেই দুটি সভায় মীর্জা ফখরুল ইসলাম, বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, জামাত, ছাত্রদের দল এনসিপি সহ সকল দলকে এক থাকতে হবে। তা না হলে ফ্যাসিস্টরা ফিরে আসবে।

আওয়ামী লীগ এখনও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী

তাদের এই কথার ভেতর দিয়ে হয়তো এখনই প্রকাশ পাচ্ছে না যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ গ্রহন করার সুযোগ পাবে। কিন্তু তাদের কথার ভেতর দিয়ে এই সত্য প্রমাণ পাচ্ছে, আওয়ামী লীগের বা আওয়ামী লীগের জোটের বিরুদ্ধে বিএনপি বা বর্তমান ইন্টারিম সমর্থিত দলগুলোকে সম্মলিতভাবে দাঁড়াতে হবে।

অর্থাত্‌ রাজনীতির বাস্তব মাঠে এখন বিএনপিসহ ইন্টারিম সমর্থিত সম্মিলিত শক্তির প্রতিদ্বন্ধি আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনের বাস্তবতা ও ভোটার অনুপস্থিতি

এর অর্থ দাঁড়ায়, ২০০১ এর আওয়ামী লীগের ৪০.১৩% বা ২০০৮ এর ৪৮.০৪% ভোটের কাছাকাছি যদি ভোট নাও থাকে তারপরেও আওয়ামীলীগই এখনও তাদের প্রতিদ্বন্ধি।

বাংলাদেশের ভোটের ট্রেন্ড বিচার করলে ভালো নির্বাচন হলে এই প্রতিদ্বন্ধিতায় ভোটের পার্থক্য খুব বেশি নয়। তাই বাস্তবে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক ভোটারকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে সেটা ২০২৪ এর শেখ হাসিনার নির্বাচনের থেকে অন্য কিছু হবে না।

পূর্ববর্তী একপক্ষীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা

অর্থাত্‌ ২০২৪ এর নির্বাচনের মতো এখানে দলের নমিনেশান পাওয়াটাই বড় থাকবে। ভোটার এসে ভোট কেন্দ্রে ভোট দেবে না।

বাংলাদেশে এ ধরনের নির্বাচন শুধু শেখ হাসিনা ২০২৪ এ একবার করেননি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াও একবার করেছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। বিএনপির ওই নির্বাচনেও ওই অর্থে কোন ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাইনি।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: ১৯৯৬ ও ২০২৪

দুটো নির্বাচনের চরিত্র একই ছিলো — পার্থক্য হলো, ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করার পরে বিএনপি মাত্র ১২ দিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলো। আর শেখ হাসিনা ৬ মাস ক্ষমতায় ছিলো।

পার্থক্য হলো, বিএনপির ওই ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরে রাজপথে আন্দোলন হয়েছিলো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে। তাই দেশ থেকে রাজনীতি চলে যায়নি।

ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রভাব ও বিএনপির দ্বন্দ্ব

আর শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে মেটিকুলাস ডিজাইনের ফলে; তাই বিএনপির মতো সেন্টার রাইট রাজনৈতিক দলটিও এখন বিপদে। অরাজনৈতিক ব্যক্তি, মৌলবাদীদের কথামতো তাদেরকে চলতে হচ্ছে, তুষ্ট করতে হচ্ছে।

আর বিএনপি যে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই তা গত এক বছরে তাদের বারবার অবস্থান পরিবর্তন শুধু নয় — ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি হবে না তা নিয়ে তাদের নেতারা এখনও নিশ্চিত নয়।

নির্বাচন নিয়ে সংশয়

এছাড়া এ মুহূর্তে গণভোট, জুলাই চার্টার এমনি নানান কিছু সামনে এনে ইন্টারিম প্রধান এমন একটি খাদে বিএনপিকে ফেলে দিয়েছে যেখানে বিএনপি প্রায় ‘লোন উলফ’।

ইউনূস জাপানের নিক্কি ফোরামে গিয়ে যে কথা বলেছিলেন — একটি মাত্র দল (যদিও তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ করেননি) এ মহূর্তে নির্বাচন চায়। এখন বাস্তবতা তিনি প্রায় সেখানেই নিয়ে এসেছেন। বিএনপি ছাড়া আর কেউই প্রত্যক্ষ ভোটের এই পার্লামেন্ট নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে চাচ্ছে না।

বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বিধা ও আশঙ্কা

আবার বিএনপি নির্বাচন চাইলেও তাদের দলের অনেক নেতার ভেতর একটি দ্বন্ধ কাজ করছে। তারা একবার ভাবছে, আওয়ামীলীগকে ছাড়া নির্বাচন করতে পারলে হেসে খেলে ক্ষমতায় যেতে পারবে।

আবার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনের শুধু নয়, ২০২৪ এর ৫ আগষ্টের আফটারম্যাথ আসলে শেষ হয়েছে কিনা তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

 

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও রাজনৈতিক পরিণতি

কারণ, ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পরে বেশ কয়েকটি আফটার শক যায় দেশের ওপর দিয়ে। যার পরিনতিতে তাদের দলের স্রষ্টাকেও প্রাণ দিতে হয়।

তাদের নেতা প্রাণ দেন ৩১ মে ১৯৮১। ১৫ নভেম্বরে, ১৯৮১ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (তখন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ছিলো) তাদের দলীয় প্রার্থী সাত্তার জয়লাভ করে। তারপরেও নির্বাচন জিতেও সরকার মাত্র ৪ মাসের মতো ক্ষমতায় টিকতে পারে।

রাষ্ট্রীয় সংকট ও আর্মির ভূমিকা

অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা এই আফটারম্যাথগুলো হিসেব করতে না পারলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কিছু নেতা তো অবশ্যই করতে পারছেন।

তাছাড়া, ২০২৪ এর আগস্ট থেকে এ অবধি রাষ্ট্রের ও সমাজের সব জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের পুলিশ প্রশাসন, জুডিশিয়ারি, সিভিল প্রশাসন, সমাজের সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক, উদারপন্থী ইসলামিক আধ্যাত্মিক ও জাগতিক দুই অংশ, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়, খৃষ্টান সম্প্রদায়, আদিবাসী সম্প্রদায় সবাইকে আঘাত করা হয়েছে।

সর্বশেষ রাষ্ট্রের শেষ আশ্রয়স্থল ও পৃথিবীর আদি সংগঠন আর্মিকেও সংসদ ছাড়া বিধি পরিবর্তন করে আর্মি আইনের বাইরে এনে যা করা হয়েছে – সেটা সাধারণ মানুষ ও আর্মি কীভাবে নিয়েছে – এ নিয়ে এখন কেউই তার মনের কথাটি বলছে না।

ভবিষ্যৎ নির্বাচনের প্রশ্ন

রাষ্ট্রের এই ধরনের একটা পরিস্থিতিতে যে কোন শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও সর্বোপরি দেশের সমস্যা সমাধানমূলক নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়, তা দেশের মানুষ বুঝতে পারছে প্রতি মুহূ‍র্তে।

তাই এখন বাংলাদেশে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন — ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশান কি হবে?

বরং সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ২৫ অক্টোবর বলেছেন, আগামী কয়েক মাসে । বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরে

আরো খারাপ হবে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কোন দেশে অবস্থানরত বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা যে সবাই ওই দেশকে বুঝতে পারেন তা নয়। সেটা সম্ভবও নয়।

তবে যারা বুঝতে পারছেন, তাদেরও প্রশ্ন — নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে কীভাবে হবে? আর একপক্ষীয় নির্বাচন হলে কতদিন টিকবে? আবার একপক্ষীয় নির্বাচনের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট নতুন বাঘের পিঠে কে উঠতে যাবে? তাই বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এখনও বাস্তবে তরল পদার্থ।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

( লেখাটি India Today প্রকাশ করেতার বাংলা অনুবাদ এখানে দেয়া হলো।   India Today- এর link https://www.indiatoday.in/opinion/story/bangladesh-election-uncertain-muhammad-yunus-not-happening-bnp-sheikh-hasina-awami-league-ban-bnp-history-2809571-2025-10-29 https://www.indiatoday.in/opinion/story/bangladesh-election-uncertain-muhammad-yunus-not-happening-bnp-sheikh-hasina-awami-league-ban-bnp-history-2809571-2025-10-29#google_vignette

সাঙ্গু নদী: পাহাড়ের কোলে জন্ম, জীবনের ধারায় প্রবাহ

নির্বাচন কি এখনও অনিশ্চিত, না কি ভোটারবিহীন?

১২:১৫:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার আবহ

বাংলাদেশের ইন্টিরিম ব্যবস্থার প্রধানসহ কয়েক উপদেষ্টা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে রমাদানের আগে নির্বাচন হবে। সে অর্থে নির্বাচনের জন্যে সময় আছে তিন মাস ও কয়েকদিন।

কিন্তু এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ইন্টারিম ব্যবস্থা যে নির্বাচনটি করতে চাচ্ছে, তা অনেকটা একপক্ষীয় একটা নির্বাচন — যেমনটি শেখ হাসিনা করেছিলেন, ২০২৪ সালে। বাংলাদেশে সর্বশেষ ভালো নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

যদি ওই নির্বাচনের দল ভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের হারের হিসাব ধরা হয়, তাহলে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) ৩২.৫%, জামায়া-ই-ইসলামীর ৪.২৮% ও অনান্যদের যারা বিএনপি জামায়াতের অনেক কাছাকাছি তাদের প্রায় ৩% ভোটারকে বাদ দিয়ে অর্থাত্‌ দেশের মোট ভোটারের ৩৯.৭৮ (৪০% ধরা যেতে পারে) ভাগ ভোটারকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করেছিলেন।

বর্তমান ইন্টারিম ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তত্‌পরতা বন্ধ করেছে। নির্বাচন কমিশনও বলেছে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে না। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কিনা সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রশ্নে ধোঁয়াশা

কারণ, ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রধান বা তাদের সৃষ্ট কমিশনগুলো যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয় না। তাই তাদেরকেও যদি নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়, তাহলে ২০০৮ এর নির্বাচনের প্রাপ্ত ভোটের হিসাব অনুযায়ী নির্বাচনের বাইরে থাকবে আওয়ামী লীগের ৪৮.০৪%, জাতীয় পার্টির ৭.০৪% ও আওয়ামী লীগের জোটের ওয়ার্কাস পার্টি ও জাসদের মিলে ১.৯% — মোট ৫৬.১৭% ভোটার।

ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, লোকে বলে আওয়ামী লীগের ২০% ভোট এখনও আছে। কিন্তু তিনি তা বিশ্বাস করেন না। যে কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ সম্মান করা উচিত। কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর রাজনীতির বাস্তবতা কখনই এক সঙ্গে যায় না।

আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

যেমন অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগ এখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের থেকেও খারাপ অবস্থায়। ১৯৭৫ সালের পরে ১৯৭৯-এ যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায় আওয়ামী লীগ — ওই সময়ে আওয়ামী লীগ মূলত তিনভাগে ভাগ ছিলো।

তার ভেতর আওয়ামী লীগ (মালেক ও রাজ্জাক)কে মূল আওয়ামী লীগ মনে করতো ওই দলের কর্মীরা। বাকি মিজান চৌধুরি ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর আওয়ামী লীগকে মূল দল হিসেবে মনে করেনি আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরা।

ভোটের ইতিহাস ও ফলাফল

১৯৭৯ সালের নির্বাচন মোটেই ভালো নির্বাচন ছিলো না। তারপরেও মালেক-রাজ্জাক আওয়ামী লীগ ২৪.৫৬% ভোট পায়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনও ভালো নির্বাচন ছিলো না। তারপরেও আওয়ামী লীগ ২৬.১৬% ভোট পায়।

১৯৯১ এ বিএনপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছিলো। তবে বিএনপি পেয়েছিলো ৩০.৮১% ভোট আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ৩০.০৮% ভোট। বিএনপি মোট ভোট পায় ১ কোটি ৫০ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯ ভোট — এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ১ কোটি ২৫ লাখ ৯ হাজার ৮৬৬ ভোট।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের লুকানো দিক

ওই নির্বাচনের একটি বিষয় খুব বেশি আলোচনা হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ হিসেবে শেখ হাসিনার ভাষণকে দায়ী করা হলেও এ বিষয়টি সামনে আসেনি।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের সাবেক জেনারেল সেক্রেটারী আব্দুর রাজ্জাক নিজে আওয়ামী লীগের প্রতীকে নির্বাচন করলেও একশ’র বেশি আসনে তাঁর দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) নিজস্ব প্রতীকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন করে । তারা মোট ভোটের ১.৮১% ভোট পায়।

বাকশাল ও আওয়ামী লীগের ভোট বিভাজন

এই ভোট সবই আওয়ামী লীগের ভোট। বাকশালের কারণে ৪০টিরও বেশি আসনে আওয়ামী লীগ ১শ’র কম ভোট থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়।

ওই সব আসনে বাকশাল প্রার্থী ৫০ হাজার থেকে ১০ হাজারের মতো ভোট পায়। বাকশালের মোট প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৬১ লাখ ৬০ হাজার ১৪। বাকশালের ভোট ও আওয়ামী লীগের ভোট যোগ হলে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮ শ ৮৮ ভোট। অর্থাত্‌ একক সংখ্যা গরিষ্ট দল বিএনপির থেকেও বাস্তবে ২৭ লাখের বেশি ভোট পেয়েছিলো আওয়ামী লীগ।

২০০৮-এর নির্বাচনের পর থেকে ভোট প্রবণতা

এরপরে ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪৪%, বিএনপি পায় ৩৩.৪০% আর জাতীয় পার্টি পায় ১৬.৪০%, জামায়াতে-ই-ইসলামী পেয়েছিলো মাত্র .১১%।

এর আগে ২০০১ এর নির্বাচনে ও ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের হার উল্লেখ করেছি। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাক্তন ছাত্র নেতা ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ নাজিম কামরান চৌধুরি ২০০৬ এ যে নির্বাচন হবার কথা ছিলো, ওই নির্বাচন নিয়ে যে জনমত জরিপ করেন, তার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা গিয়েছিলো — আওয়ামী লীগ যে ভোট পাবে ২০০৬ এর নির্বাচনে, যা মূলত ২০০৮ এ হয়েছিলো — ওই নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে তাদের ৪০ ভাগের বেশি আওয়ামী পরিবারের ভোট।

 

আওয়ামী পরিবারের সামাজিক প্রভাব

অর্থাত্‌ আওয়ামী লীগ ২০০৮ এ নির্বাচনে যে ৪৮.০৪% ভোট পেয়েছিলো, তার ৪০% এসেছিলো আওয়ামী পরিবার থেকে।

বাংলাদেশে আওয়ামী পরিবারের মতো ঠিক ওইভাবে অন্য কোন দলের মতাদর্শগত পরিবার হওয়া সম্ভব নয়। এর প্রধান কারণ দুটো — শেখ মুজিবই বাংলাদেশে একমাত্র কাল্ট, আর বাংলাদেশের সব থেকে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধ, যা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছিলো।

শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কাল্ট রাজনীতি

এই সর্বোচ্চ ঘটনা ও তাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কাল্টকে ঘিরে ওই অনুসারী পরিবার হবেই। যে কারণে একটি অংশ আওয়ামীলীগারদের কাছে আওয়ামী লীগ অনেকটা ধর্মের মতো।

শেখ হাসিনা নিজেও ৭৮ বছর বয়স এসেও এবং পাঁচ বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে ‘মুজিব কন্যা’ বা ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা’ হিসেবে পরিচয় দেন। এমনকি এখনও যে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল থেকে প্রায় প্রতিদিন যারা গ্রেফতার হচ্ছে, সে সব মিছিলের সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও ফুটেজ দেখলে শোনা যায়, তারা স্লোগান দেয় “শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধু” ও মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান “জয় বাংলা” ।

শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক বাস্তবতা

অন্যদিকে শেখ হাসিনার পতনের পরে অতি উত্‌সাহী কিছু মানুষ ওই ঘটনাকে বিপ্লব বলেছিলো, বেশি মানুষ গণ-অভূত্থান বলেছিলো, সেটা ৯০ ভাগ উড়িয়ে দেন — মুহাম্মদ ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশানে, শেখ হাসিনার পতন “দীর্ঘ মেটিকুলাস ডিজাইনের ফসল” বলে।

ইউনূসের এই স্বীকারোক্তি মূলত আওয়ামী লীগারদের ভিন্নভাবে ভাবিয়েছে — এরপর থেকে তারা মনে করে তাদের রাজনৈতিক পরাজয় হয়নি, ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে গেছে।

দমননীতি ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

এর পাশাপাশি দেশের ৫৫টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইন্টারিম ব্যবস্থা ও তার সমর্থক মাত্র ১৮টি রাজনৈতিক দল যারা জুলাই চার্টারে সই করেছে এবং ইউনুস সমর্থিত ছাত্রদের দল — এই ১৯টি দলের কিছু মানুষ সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বিচারে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করে এদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে।

যার ফলে দেখা যাচ্ছে — আওয়ামী লীগের এতবড় বিপর্যয়ের পরেও একজনও আওয়ামীলীগার বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয়নি। বরং বিএনপি থেকে জামায়াত, জামায়াত থেকে বিএনপিতে যাচ্ছে।

অর্থনীতিসমাজ ও জনমত

গত এক বছরে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়া, মার্কেটে মধ্যবিত্তের বিলাস পণ্যে ভয়াবহ রকম খরা — সব কিছু মিলে শুধু সোশ্যাল ফোরাম কেন, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এখন অনেকে বলতে শুরু করেছেন, “আগে ভালো ছিলাম।”

তাই ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রধানের কাছে আওয়ামী লীগের ভোটের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত হলেও বাস্তবতা কি সেটা সাধারণ মানুষ অর্থাত্‌ গ্রামে ও দরিদ্র শ্রেণীর ভেতর গিয়েই বুঝতে হবে।

রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি

তবে যারা রাজনীতিবিদ তারা অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যেমন বিশিষ্ট ছাত্র নেতা, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ওই দলের সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছিলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না — তিনি তার বর্তমান দল নিয়ে জুলাই চার্টারে সই করলেও প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশান (পি আর) পদ্ধতির পক্ষে নয়।

তিনি সাংবাদিক সম্মেলেনেই বলেছেন, পি আর পদ্ধতিতে যদি ভোট হয় আর আওয়ামী লীগ যদি অংশ গ্রহণ করার সুযোগ পায়, তাহলে তার ভাষায় “আমরা সবাই মিলে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে পারবো না।”

বিএনপির উদ্বেগ ও ঐক্যের বার্তা

বিষয়টি যে বিএনপিও বুঝছে না তা নয়। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ২৫ অক্টোবরে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, সবাইকে এক থাকতে হবে, নইলে ফ্যাসিস্ট (আওয়ামী লীগ) ফিরে আসবে।

অন্যদিকে ২৪ ও ২৫ দুই দিনেই দুটি সভায় মীর্জা ফখরুল ইসলাম, বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, জামাত, ছাত্রদের দল এনসিপি সহ সকল দলকে এক থাকতে হবে। তা না হলে ফ্যাসিস্টরা ফিরে আসবে।

আওয়ামী লীগ এখনও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী

তাদের এই কথার ভেতর দিয়ে হয়তো এখনই প্রকাশ পাচ্ছে না যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ গ্রহন করার সুযোগ পাবে। কিন্তু তাদের কথার ভেতর দিয়ে এই সত্য প্রমাণ পাচ্ছে, আওয়ামী লীগের বা আওয়ামী লীগের জোটের বিরুদ্ধে বিএনপি বা বর্তমান ইন্টারিম সমর্থিত দলগুলোকে সম্মলিতভাবে দাঁড়াতে হবে।

অর্থাত্‌ রাজনীতির বাস্তব মাঠে এখন বিএনপিসহ ইন্টারিম সমর্থিত সম্মিলিত শক্তির প্রতিদ্বন্ধি আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনের বাস্তবতা ও ভোটার অনুপস্থিতি

এর অর্থ দাঁড়ায়, ২০০১ এর আওয়ামী লীগের ৪০.১৩% বা ২০০৮ এর ৪৮.০৪% ভোটের কাছাকাছি যদি ভোট নাও থাকে তারপরেও আওয়ামীলীগই এখনও তাদের প্রতিদ্বন্ধি।

বাংলাদেশের ভোটের ট্রেন্ড বিচার করলে ভালো নির্বাচন হলে এই প্রতিদ্বন্ধিতায় ভোটের পার্থক্য খুব বেশি নয়। তাই বাস্তবে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক ভোটারকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে সেটা ২০২৪ এর শেখ হাসিনার নির্বাচনের থেকে অন্য কিছু হবে না।

পূর্ববর্তী একপক্ষীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা

অর্থাত্‌ ২০২৪ এর নির্বাচনের মতো এখানে দলের নমিনেশান পাওয়াটাই বড় থাকবে। ভোটার এসে ভোট কেন্দ্রে ভোট দেবে না।

বাংলাদেশে এ ধরনের নির্বাচন শুধু শেখ হাসিনা ২০২৪ এ একবার করেননি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াও একবার করেছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। বিএনপির ওই নির্বাচনেও ওই অর্থে কোন ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাইনি।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: ১৯৯৬ ও ২০২৪

দুটো নির্বাচনের চরিত্র একই ছিলো — পার্থক্য হলো, ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করার পরে বিএনপি মাত্র ১২ দিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলো। আর শেখ হাসিনা ৬ মাস ক্ষমতায় ছিলো।

পার্থক্য হলো, বিএনপির ওই ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরে রাজপথে আন্দোলন হয়েছিলো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে। তাই দেশ থেকে রাজনীতি চলে যায়নি।

ইন্টারিম ব্যবস্থার প্রভাব ও বিএনপির দ্বন্দ্ব

আর শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে মেটিকুলাস ডিজাইনের ফলে; তাই বিএনপির মতো সেন্টার রাইট রাজনৈতিক দলটিও এখন বিপদে। অরাজনৈতিক ব্যক্তি, মৌলবাদীদের কথামতো তাদেরকে চলতে হচ্ছে, তুষ্ট করতে হচ্ছে।

আর বিএনপি যে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই তা গত এক বছরে তাদের বারবার অবস্থান পরিবর্তন শুধু নয় — ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি হবে না তা নিয়ে তাদের নেতারা এখনও নিশ্চিত নয়।

নির্বাচন নিয়ে সংশয়

এছাড়া এ মুহূর্তে গণভোট, জুলাই চার্টার এমনি নানান কিছু সামনে এনে ইন্টারিম প্রধান এমন একটি খাদে বিএনপিকে ফেলে দিয়েছে যেখানে বিএনপি প্রায় ‘লোন উলফ’।

ইউনূস জাপানের নিক্কি ফোরামে গিয়ে যে কথা বলেছিলেন — একটি মাত্র দল (যদিও তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ করেননি) এ মহূর্তে নির্বাচন চায়। এখন বাস্তবতা তিনি প্রায় সেখানেই নিয়ে এসেছেন। বিএনপি ছাড়া আর কেউই প্রত্যক্ষ ভোটের এই পার্লামেন্ট নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে চাচ্ছে না।

বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বিধা ও আশঙ্কা

আবার বিএনপি নির্বাচন চাইলেও তাদের দলের অনেক নেতার ভেতর একটি দ্বন্ধ কাজ করছে। তারা একবার ভাবছে, আওয়ামীলীগকে ছাড়া নির্বাচন করতে পারলে হেসে খেলে ক্ষমতায় যেতে পারবে।

আবার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনের শুধু নয়, ২০২৪ এর ৫ আগষ্টের আফটারম্যাথ আসলে শেষ হয়েছে কিনা তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

 

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ও রাজনৈতিক পরিণতি

কারণ, ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পরে বেশ কয়েকটি আফটার শক যায় দেশের ওপর দিয়ে। যার পরিনতিতে তাদের দলের স্রষ্টাকেও প্রাণ দিতে হয়।

তাদের নেতা প্রাণ দেন ৩১ মে ১৯৮১। ১৫ নভেম্বরে, ১৯৮১ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (তখন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ছিলো) তাদের দলীয় প্রার্থী সাত্তার জয়লাভ করে। তারপরেও নির্বাচন জিতেও সরকার মাত্র ৪ মাসের মতো ক্ষমতায় টিকতে পারে।

রাষ্ট্রীয় সংকট ও আর্মির ভূমিকা

অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা এই আফটারম্যাথগুলো হিসেব করতে না পারলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কিছু নেতা তো অবশ্যই করতে পারছেন।

তাছাড়া, ২০২৪ এর আগস্ট থেকে এ অবধি রাষ্ট্রের ও সমাজের সব জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের পুলিশ প্রশাসন, জুডিশিয়ারি, সিভিল প্রশাসন, সমাজের সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক, উদারপন্থী ইসলামিক আধ্যাত্মিক ও জাগতিক দুই অংশ, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়, খৃষ্টান সম্প্রদায়, আদিবাসী সম্প্রদায় সবাইকে আঘাত করা হয়েছে।

সর্বশেষ রাষ্ট্রের শেষ আশ্রয়স্থল ও পৃথিবীর আদি সংগঠন আর্মিকেও সংসদ ছাড়া বিধি পরিবর্তন করে আর্মি আইনের বাইরে এনে যা করা হয়েছে – সেটা সাধারণ মানুষ ও আর্মি কীভাবে নিয়েছে – এ নিয়ে এখন কেউই তার মনের কথাটি বলছে না।

ভবিষ্যৎ নির্বাচনের প্রশ্ন

রাষ্ট্রের এই ধরনের একটা পরিস্থিতিতে যে কোন শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও সর্বোপরি দেশের সমস্যা সমাধানমূলক নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়, তা দেশের মানুষ বুঝতে পারছে প্রতি মুহূ‍র্তে।

তাই এখন বাংলাদেশে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন — ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশান কি হবে?

বরং সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ২৫ অক্টোবর বলেছেন, আগামী কয়েক মাসে । বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরে

আরো খারাপ হবে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কোন দেশে অবস্থানরত বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা যে সবাই ওই দেশকে বুঝতে পারেন তা নয়। সেটা সম্ভবও নয়।

তবে যারা বুঝতে পারছেন, তাদেরও প্রশ্ন — নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে কীভাবে হবে? আর একপক্ষীয় নির্বাচন হলে কতদিন টিকবে? আবার একপক্ষীয় নির্বাচনের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট নতুন বাঘের পিঠে কে উঠতে যাবে? তাই বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এখনও বাস্তবে তরল পদার্থ।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

( লেখাটি India Today প্রকাশ করেতার বাংলা অনুবাদ এখানে দেয়া হলো।   India Today- এর link https://www.indiatoday.in/opinion/story/bangladesh-election-uncertain-muhammad-yunus-not-happening-bnp-sheikh-hasina-awami-league-ban-bnp-history-2809571-2025-10-29 https://www.indiatoday.in/opinion/story/bangladesh-election-uncertain-muhammad-yunus-not-happening-bnp-sheikh-hasina-awami-league-ban-bnp-history-2809571-2025-10-29#google_vignette