এরপর থেকে শিশু-কিশোরদের অনলাইন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আরও গুরুত্ব পেতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায় অনেক সরকার নতুন নীতি ও আইনি কাঠামো নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
অস্ট্রেলিয়া পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ১৬ বছরের নিচের শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এই তালিকায় রয়েছে এক্স, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও স্ন্যাপচ্যাট। নতুন নিয়ম মানতে ব্যর্থ হলে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানার মুখে পড়তে হবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ এখন জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়।
ইউরোপ এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশ একই ধরনের পদক্ষেপ বিবেচনা করছে। সিঙ্গাপুরের শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলকেন্দ্রিক উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী জানুয়ারি থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুল সময়ের মধ্যে স্মার্টফোন বা স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করতে পারবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগে থেকেই এমন নীতি চালু রয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো স্কুল সময়কে আবারও সরাসরি যোগাযোগ ও মনোযোগী শিক্ষার সময় হিসেবে গড়ে তোলা।

বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, স্কুল চলাকালে অবাধ স্মার্টফোন ব্যবহার শিক্ষার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার জন্যও ক্ষতিকর। শিক্ষকদের মতে, ব্যক্তিগত ডিভাইস শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট করে এবং নোটিফিকেশন ও বিভিন্ন অ্যাপ এক কাজ থেকে আরেক কাজে মনোযোগ সরিয়ে দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর বয়সে অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সঙ্গে সাইবার বুলিং, সামাজিক তুলনা এবং ঘুমের সমস্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এসব কারণে উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যার চিন্তা ও আত্মক্ষতির প্রবণতা বাড়ে।
ফ্রান্স, স্পেন ও ব্রিটেনের মতো দেশগুলোতে স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে শৃঙ্খলার কারণে নয়, বরং শিশু সুরক্ষার যুক্তিতে।
ডিজিটাল যুগে শৈশব নিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিভাইস শিক্ষার সুযোগ, খেলা ও সামাজিক সংযোগের সুবিধা দিলেও অতিরিক্ত ও নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে শিশুদের বিকাশ, ঘুম, শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর সঙ্গে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও অনলাইনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্পর্কও পাওয়া গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বহু সরকার। এতে রাষ্ট্র, অভিভাবক ও শিশুদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক ও দায়িত্ববোধে এক ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। বেইজিং ও ব্রাসেলসের রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হলেও, এশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের রাজধানীগুলো একই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে—সংযুক্ত পৃথিবীতে শিশুদের বড় হতে দেওয়ার সময় কীভাবে তাদের এমন প্রযুক্তি ও পণ্য থেকে রক্ষা করা যায়, যা তাদের কল্যাণ মাথায় রেখে তৈরি হয়নি।
অভিভাবকদের উদ্বেগ নতুন নয়, তবে প্রযুক্তি সেই উদ্বেগকে আরও গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী করেছে। আগে স্কুলে সীমাবদ্ধ থাকা ঠাট্টা, গুজব বা বিবাদ এখন ফোনের মাধ্যমে বাড়িতেও চলে আসে। যা একসময় সময়সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা চব্বিশ ঘণ্টার ডিজিটাল চাপে রূপ নিয়েছে, যা সহজেই স্ক্রিনশট নেওয়া, ছড়িয়ে দেওয়া ও বারবার দেখানো যায়।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় সাইবার বুলিংকে একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা অনলাইনে নিগৃহীত হয়, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, একাকিত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বেশি দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা কাজ করে। বন্ধুদের দ্বারা বাদ পড়া, বিচার হওয়া বা অবাস্তব মানদণ্ডের মুখোমুখি হওয়া বড় হওয়ার অংশ হলেও, সারাক্ষণ অনলাইনে থাকার ফলে এই চাপ বহুগুণে বেড়ে যায়। অনেক শিশু বন্ধুত্ব, আত্মপ্রকাশ ও মানসিক সহায়তার জন্য অনলাইন জগতে নির্ভর করে। কিন্তু এই জায়গাগুলোই আবার উদ্বেগ বাড়াতে, বিশ্রাম নষ্ট করতে এবং নেতিবাচক আচরণকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।

তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গিও উপেক্ষা করা যায় না। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু সময় কাটানোর মাধ্যম নয়; এটি স্কুল আঙিনা, শিল্পচর্চার জায়গা ও খেলার মাঠ—সবকিছুর সমন্বয়। অনেক তরুণ অনলাইন কমিউনিটি গড়ে তুলতে সময় ও শ্রম দেয় এবং এগুলোকে নিজেদের সুস্থতা ও ভবিষ্যৎ পেশার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তাদের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা সুরক্ষার চেয়ে নিজেদের তৈরি করা জায়গা থেকে উচ্ছেদের মতো মনে হয়, যেখানে তারা আবারও প্রবেশের চেষ্টা করবে।
শিশুরা ক্লাসের চেয়ে ঘরে বসেই বেশি সময় অনলাইনে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের মান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—সমস্যা তৈরি করতেও, আবার তা কমাতেও।
অভিভাবকেরা যদি যুক্তিসংগত স্ক্রিন সময় নির্ধারণ করেন, নিজের ফোন ব্যবহারে সচেতন উদাহরণ তৈরি করেন এবং শিশুদের অনলাইনে কী দেখছে বা করছে তা নিয়ে নিয়মিত কথা বলেন, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। এতে শিশুরা মানসিক চাপ বা সহপাঠীদের চাপ মোকাবিলায় তুলনামূলকভাবে শক্ত হতে পারে।
ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতি কার্যকর করতে হলে ঘর ও স্কুলের উদ্যোগকে আলাদা না রেখে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। শিক্ষা ও শিশু সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ ক্রমেই বলছে, অনলাইন নিরাপত্তা একটি যৌথ দায়িত্ব। স্কুলগুলো স্পষ্ট নিয়ম করতে পারে, ফিল্টারযুক্ত নেটওয়ার্ক ব্যবহার ও ডিজিটাল নাগরিকত্ব শেখাতে পারে। অভিভাবকেরা দৈনন্দিন কার্যক্রমে নজর রাখতে পারেন, মানসিক সহায়তা দিতে পারেন এবং সমস্যা দেখা দিলে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে পারেন।
এই বাস্তবতায় বয়সসীমা, স্কুলে বিধিনিষেধ, প্ল্যাটফর্মের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবারকে বাস্তব সহায়তার সমন্বয় একটি যৌথ পথ দেখায়। এশিয়া হোক বা পশ্চিম—ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার সরকারগুলো এখন স্বীকার করছে, সমস্যাটি সবারই এক। পরিবার, শিক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সম্মিলিত ভূমিকার মাধ্যমেই শিশুদের এমন এক অনলাইন দুনিয়ায় পথ দেখানো সম্ভব, যা বাস্তবতায় আর ফিরে যাওয়ার নয়।
বার্নার্ড চ্যান 


















