নতুন বাণিজ্য চুক্তি সই করা ভারতের নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়েছে, যা দেশটির বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াতে সহায়তা করছে। সম্প্রতি ওমান ও ভারত একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি সই করেছে। এই চুক্তির ফলে ওমানে ভারতের ৯৮ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার মিলবে। ২০২৫ সালে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ওমানে ছয় হাজারের বেশি ভারত–ওমান যৌথ উদ্যোগ পরিচালিত হচ্ছে। ভারত থেকে ওমানে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার।
এই নতুন চুক্তির লক্ষ্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও বাড়ানো এবং বস্ত্র, প্রকৌশল পণ্য, ওষুধ ও কৃষিপণ্যসহ ভারতের বিভিন্ন রপ্তানি খাতকে উৎসাহ দেওয়া। ভারত তাদের মোট শুল্ক তালিকার প্রায় ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশে শুল্ক ছাড় দেবে, যা মূল্যমানের হিসাবে ওমান থেকে আসা ৯৪ শতাংশের বেশি আমদানিকে অন্তর্ভুক্ত করে। একই সঙ্গে ওমান থেকে আসা খেজুর ও পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যের মতো নির্বাচিত কিছু পণ্যে শুল্ক কমাবে ভারত। অঞ্চলটিতে এই সাম্প্রতিক অগ্রগতি কার্যকর অর্থনৈতিক কূটনীতি গ্রহণের একটি স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক স্টেটক্রাফট’ গ্রন্থে ডেভিড বাল্ডউইন অর্থনৈতিক কূটনীতির কার্যকারিতা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কৌশল নতুনভাবে মূল্যায়ন করেন। এখানে ‘স্টেটক্রাফট’ বলতে রাষ্ট্র পরিচালকদের সেই পররাষ্ট্রনীতি সরঞ্জামকে বোঝানো হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। অর্থনৈতিক কূটনীতির মধ্যে পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যবহৃত সব ধরনের অর্থনৈতিক হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ইতিবাচক রূপ রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় প্রণোদনা—আর্থিক সহায়তা, বিনিয়োগ, রপ্তানি ও আমদানিতে ভর্তুকি এবং অনুকূল শুল্ক সুবিধা। আবার নেতিবাচক রূপও আছে, যেগুলোকে বলা হয় চাপের কৌশল—অবরোধ, বর্জন, লাইসেন্স বাতিল, কালো তালিকাভুক্তি, শুল্ক বৃদ্ধি কিংবা সম্পদ জব্দ। বাল্ডউইনের মতে, অর্থনৈতিক কৌশলের খরচ সাধারণত প্রচারণা বা কূটনীতির চেয়ে বেশি হওয়ায় এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাও তুলনামূলকভাবে বেশি।

এরও আগে, ১৯৪৫ সালে আলবার্ট হিরশম্যান ‘ন্যাশনাল পাওয়ার অ্যান্ড দ্য স্ট্রাকচার অব ফরেন ট্রেড’ বইয়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কে বাণিজ্যের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেন। তাঁর মতে, দেশ ‘এ’-এর সঙ্গে দেশ ‘বি’, ‘সি’ বা ‘ডি’-এর বাণিজ্য তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তারা সেই বাণিজ্য বজায় রাখতে দেশ ‘এ’-কে সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে সম্মত হয়।
আন্দ্রেয়াস গ্রিমেল ও ভিক্টর এসজটারহাই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগকে অর্থনৈতিক কূটনীতির একটি উদাহরণ হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা বাল্ডউইনের প্রথাগত ধারণার সঙ্গে হিরশম্যানের নীতির তুলনা করেছেন। বাল্ডউইনের ধারণা নির্দিষ্ট আচরণে প্রভাব ফেলার দিকে মনোযোগী, আর হিরশম্যানের নীতি দেশগুলোকে স্বেচ্ছায় নিজেদের নীতিগত লক্ষ্য পরিবর্তনে উৎসাহিত করতে চায়, যাতে সেগুলো অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
বর্তমান অনিশ্চিত ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা নতুন মিত্র খোঁজার প্রয়োজন তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ওমান ও ভারত তাদের অর্থনৈতিক কূটনীতিকে প্রধান কৌশলগত নীতি হিসেবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যা বাল্ডউইন ও হিরশম্যানের ধারণার তুলনার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। সামগ্রিকভাবে নতুন বাণিজ্য চুক্তি সই করা ভারতের অর্থনৈতিক কূটনীতির একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। একদিকে এটি নেতিবাচক অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সহায়ক, অন্যদিকে পরোক্ষভাবে অন্যান্য দেশকে প্রভাবিত করার পথও খুলে দেয়।
এই চুক্তি এমন এক সময়ে সই হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে চাপ সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চিলি ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা চলার পাশাপাশি ১৫টির বেশি বাণিজ্য চুক্তি সই করে ভারত বিশ্বজুড়ে নিজের প্রভাব বাড়াচ্ছে।
ওমানও এই অর্থনৈতিক কূটনীতির সুফল নিচ্ছে, কারণ এর মাধ্যমে দেশটি আন্তর্জাতিক অংশীদার বৈচিত্র্য করতে পারছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২৫ সালের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেলের দামের ওঠানামা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ওমান ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের দেশগুলোর অর্থনীতি গভীর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কাসিম আল-মাশানি ওমানের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কীভাবে দেশটি রাজস্ব ঘাটতি কমানো ও ঋণ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সংস্কার করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং তেলবহির্ভূত শিল্প খাত জোরদার করতে ওমান বেসরকারিকরণ উদ্যোগ ও সরকারি বিনিয়োগ কর্মসূচি চালু করেছে।
ভারত ও ওমান উভয়ই সামরিক শক্তির পরিবর্তে অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাল্ডউইনের ভাষায়, সামরিক কৌশলের খরচ অনেক বেশি এবং তা সব সময় কার্যকর নাও হতে পারে। তুলনায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কূটনীতি বা প্রচারণার চেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং সামরিক পদক্ষেপের মতো সহিংস প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিও কম। তাঁর উপসংহার হলো, অর্থনৈতিক কূটনীতি কোনো দুর্বল বিকল্প নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে এটি সর্বোত্তম নীতি। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় তাই প্রণোদনাভিত্তিক অর্থনৈতিক কূটনীতিই সবচেয়ে কার্যকর পথ হিসেবে সামনে আসছে। বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে অর্থনীতির বৈচিত্র্য বাড়ে এবং দেশগুলো একে অপরকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করার সুযোগ পায়—যা প্রকৃত অর্থেই একটি পারস্পরিক লাভের পরিস্থিতি তৈরি করে।
ড. ডায়ানা গালেয়েভা 



















