যুক্তরাষ্ট্র ও তার লাতিন আমেরিকান মিত্রদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে সেই দিনের জন্য, যেদিন এই দুই দেশের স্বৈরশাসকদের পতন ঘটবে। দক্ষিণ ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির দিকে সবার দৃষ্টি থাকলেও ভেনেজুয়েলার ভেতরে দমন–পীড়নের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে কম আলোচনায় এসেছে। স্বৈরশাসক নিকোলাস মাদুরো এখন আহত রাজাসুলভ আচরণ করছেন।
কিউবার পরিস্থিতিও খুব একটা ভিন্ন নয়। সেখানে ভিন্নমতাবলম্বীরা আগের মতোই নির্যাতনের শিকার, আর হাভানায় টিকে থাকা ৬৭ বছর পুরোনো শাসনব্যবস্থা সমাজ ও অর্থনীতির ওপর এক বিশাল বোমা হয়ে বসে আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ—এবং তার প্রভাব হিসেবে কিউবার ক্ষেত্রেও—পশ্চিম গোলার্ধের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে, যাতে তারা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় দুই হুমকি থেকে মুক্তি পেতে পারে। এই সুযোগ কাজে না লাগানো হবে চরম ব্যর্থতা। তবে এটাও মনে করা ভুল যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা ছাড়া কোনো একটি দেশেও শান্তিপূর্ণ রূপান্তর সম্ভব। স্বৈরাচারীদের অপসারণ হয়তো তুলনামূলকভাবে সহজ হবে, কিন্তু তার পরের সকালটাই সবচেয়ে জটিল হয়ে উঠতে পারে।
২ ডিসেম্বর কারাকাসে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এদমুন্দো গনসালেসের জামাতাকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গনসালেস বর্তমানে স্পেনে নির্বাসনে থাকায় মাদুরো সরকার তাঁর পরিবারকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে বিরোধী আন্দোলন দমনে। বেসরকারি সংস্থা ফোরো পেনালের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদুরোর হাতে প্রায় ৯০০ রাজনৈতিক বন্দি আটক ছিলেন। বুধবার নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ও বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো সামাজিক মাধ্যমে জানান, তিনি ভেনেজুয়েলায় রাজনৈতিক বন্দিদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার সরাসরি ও নিয়মিত হুমকির তথ্য পেয়েছেন।
কিউবার অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অনেকেই ট্রাম্প প্রশাসনের ভেনেজুয়েলান তেল অবরোধকে দায়ী করেন, কিন্তু বাস্তবে দ্বীপটির ভাঙন নিজস্ব ব্যবস্থার ফল। বিপ্লবের শুরু থেকেই শাসকগোষ্ঠী কারাবন্দি, নিহত বা নির্বাসিত পুঁজিপতিদের সম্পদ লুট করে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। এরপর তিন দশক ধরে তারা মস্কোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ধস এড়াতে কিউবা বিদেশি বিনিয়োগের দুয়ার খোলে এবং কিছু শীতল সংস্কার আনে। কিন্তু ১৯৯৯ সালে ভেনেজুয়েলার তৎকালীন নেতা হুগো চাভেজ সাহায্যের হাত বাড়ালে সেই পথ থেকে তারা আবার সরে আসে। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পর ভেনেজুয়েলার সহায়তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং কিউবার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়।
মাদুরোর সাম্প্রতিক দমন–পীড়ন দেখিয়ে দেয় যে ট্রাম্পের চাপের নীতির কোনো মূল্য নেই—এ কথা বলা ঠিক নয়। এখন পিছু হটলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ভেনেজুয়েলাবাসীরা ভেঙে পড়বে। একই সঙ্গে হাভানার শাসনব্যবস্থাও নতুন করে প্রাণ পাবে। তখন চীন ও রাশিয়া কিউবাকে গুপ্তচরবৃত্তি ও আমেরিকাজুড়ে নিজেদের ক্ষতিকর প্রভাব বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
ভেনেজুয়েলায় এদমুন্দো গনসালেস ও মারিয়া কোরিনা মাচাদোর প্রথম দিন থেকেই নেতৃত্ব নেওয়ার বৈধতা রয়েছে। মাচাদো দেশটির জন্য উদারনৈতিক চিন্তার ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন এবং তিনি জনপ্রিয়। ভেঙে পড়া প্রশাসন ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যবস্থা তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলেও স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে নতুন প্রজাতন্ত্র গড়ার অঙ্গীকার তাঁকে শক্ত ভিত দেবে।
মুক্ত ভেনেজুয়েলার জন্য বিদেশি সহায়তা প্রয়োজন হবে, এমনকি সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলেও। লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও ক্ষুধায় জর্জরিত দেশের মানবিক চাহিদা মেটানো হবে প্রথম কাজ। ভেনেজুয়েলার জন্য কোনো মার্শাল পরিকল্পনা দরকার নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল মজুত তাদের আছে এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে তারা আবার শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। তবে এই রূপান্তরের সময় আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা অপরিহার্য।
অনেক কিছুই ভুল পথে যেতে পারে, তাই যুক্তরাষ্ট্রকে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবু এসব চ্যালেঞ্জ কিউবার গণতান্ত্রিকদের সামনে থাকা সমস্যার তুলনায় ছোট। দ্বীপটিতে গণতন্ত্রের কোনো স্মৃতি নেই, আর স্বৈরতন্ত্র নাগরিক সংগঠনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। কিউবার অর্থনীতি বিল পরিশোধের মতো বৈদেশিক মুদ্রাও উৎপাদন করতে পারে না। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা জোড়াতালি দিয়ে চলছে। রাস্তায় আবর্জনার স্তূপ। জনসংখ্যা কমছে। বিশুদ্ধ পানি, বাসস্থান ও ওষুধের তীব্র সংকট চলছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ওরোপুচে জ্বর ছড়িয়ে পড়েছে।
কিউবা স্বৈরতন্ত্রের এই ক্যানসার অপসারণ ছাড়া কখনোই সমৃদ্ধ হতে পারবে না। এরপর তাদের দরকার হবে বাইরের সহায়তা—আইন প্রয়োগ ও রাজনৈতিক অর্থনীতি রূপান্তরের জন্য নিয়ম নির্ধারণে কোনো বহুপাক্ষিক উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়া জরুরি।
মানবিক সংকট তীব্র হলেও এর সমাধান কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দখল নয়। লাতিন আমেরিকার মিত্ররা সাহায্য করতে পারে, কিউবার গির্জাগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২১ সালের ১১ জুলাইয়ের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, যখন হাজারো কিউবান রাস্তায় নেমে শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল—কিউবানরা মুক্ত হলে নিজের দেশ গড়তে তারা নিজেরাই এগিয়ে আসে।
প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের কি সত্যিই কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা আছে?
মেরি আনাস্তাসিয়া ও’গ্র্যাডি 


















