গত পঁচিশ বছরে আমরা বিশ্বায়ন ও দ্রুত প্রবৃদ্ধির যুগ থেকে এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যাকে কেউ কেউ বৈশ্বিক খণ্ডিতকরণ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক কাঠামো থেকেও ধীরে ধীরে সরে আসার প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও মহামারির মতো বৈশ্বিক ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ যুক্ত হওয়ায়, অতীতে এশিয়ার বহু অর্থনীতিকে যে প্রবৃদ্ধি রূপান্তরিত করেছিল, ভবিষ্যতে সেই ধরনের প্রবৃদ্ধি কোথা থেকে আসবে—তা স্পষ্টভাবে বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবু বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং তথাকথিত মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে থাকা অর্থনীতিগুলো এগিয়ে যেতে পারে, উচ্চ আয়ের দেশে রূপ নিতে পারে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল ও টেকসই অর্থনীতি ও সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হতে পারে।

এই লক্ষ্য অর্জনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে এমন পাঁচটি মূল স্তম্ভ রয়েছে।
প্রথমত, প্রয়োজন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। এর মধ্যে রয়েছে সুসংহত রাজস্বনীতি এবং শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থা। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি ও উচ্চমানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তোলে এবং সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ ও সরকারি বিনিয়োগের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সক্ষম করে। আর্থিক খাত যখন ক্রমেই বিনিয়োগের জন্য পুঁজি সংগ্রহে বড় ভূমিকা রাখছে, তখন পুঁজির পর্যাপ্ততা, ঝুঁকি মূল্যায়ন ও তথ্য প্রকাশ—জলবায়ুজনিত ঝুঁকিসহ—এ ধরনের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করে এমন নীতিকে সমর্থন করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসব ক্ষেত্র আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
অতীতে উন্মুক্ত অর্থনীতি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সফল শিল্পনীতি এশিয়ার দ্রুত উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছিল। ভবিষ্যতের জন্য সেই চালিকাশক্তিগুলোকে নতুনভাবে ধারণ করা বা পুনর্গঠন করাও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবৃদ্ধির ভিত্তিকে শক্ত করে দ্বিতীয় স্তম্ভটি হলো আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংহতি। আসিয়ান অর্থনৈতিক সম্প্রদায়, আরসিইপি এবং কারেকের মতো আঞ্চলিক কাঠামো ইতিমধ্যেই সরবরাহ শৃঙ্খল ও প্রযুক্তি বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সরকারগুলো আরও গভীর বাণিজ্য সংযোগের দিকে এগোতে পারে। একই সঙ্গে মধ্যস্থতা ও মীমাংসার মতো বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় সহযোগিতা জোরদার হলে আস্থা বাড়ে, লেনদেন ব্যয় কমে এবং সীমান্ত পেরোনো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশ আরও পূর্বানুমানযোগ্য হয়।
বিশ্বকে নতুনভাবে রূপ দিচ্ছে উদ্ভাবন ও ডিজিটাল রূপান্তর—এটাই এশিয়ার প্রবৃদ্ধির তৃতীয় স্তম্ভ। ফিনটেক থেকে শুরু করে জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পর্যন্ত ডিজিটাল উদ্ভাবন বোঝা, উন্নয়ন করা ও কাজে লাগানো এশীয় অর্থনীতিগুলোর জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাবর্তন কমে আসার প্রেক্ষাপটে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ এবং গতিশীল বাজার কাঠামো গড়ে তোলাও উৎপাদনশীলতানির্ভর, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক রূপান্তরে সহায়ক হতে পারে।
এশিয়ার উচ্চ আয়ের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চতুর্থ স্তম্ভটি হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। এর লক্ষ্য দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অগ্রগতি নিশ্চিত করা। বৈষম্য কমলে সামাজিক সংহতি বাড়ে, বাজার বিস্তৃত হয় এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জোরদার হয়। মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিতে সমান সুযোগ থাকলে মানবসম্পদ ও উৎপাদনশীলতা বাড়ে। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকলে মানুষ অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও জলবায়ুজনিত ধাক্কা মোকাবিলা করতে পারে। গ্রামীণ অবকাঠামো, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় বিনিয়োগ শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমাতে এবং উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে।
এশিয়ার অতীতের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি মূলত দ্রুত শিল্পায়ন ও কার্বননির্ভর বৃহৎ অবকাঠামো বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে এই অগ্রগতি ধরে রাখতে এখন প্রয়োজন পরিবর্তন। প্রয়োজন টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন এবং টেকসই অবকাঠামোর দিকে রূপান্তর—এটাই পঞ্চম স্তম্ভ।
এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোতে এই রূপান্তর বাস্তবায়ন নির্ভর করে পরিবহন, জ্বালানি, ডিজিটাল, পানি ও স্যানিটেশনের মতো মৌলিক অবকাঠামো খাতে পরিবর্তনের ওপর। এসব খাত একসঙ্গে বিনিয়োগের পরিমাণ ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নির্ধারণ করে। সঠিক পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা স্বল্প কার্বন অবকাঠামো, দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা, নির্ভরযোগ্য জ্বালানি ও পানির সরবরাহ এবং জলবায়ু সহনশীল নগর নকশা প্রবৃদ্ধি ও সমতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকিও কমাতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন শিল্প কাঠামোর পরিবর্তন, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, শ্রমবাজারের রূপান্তর এবং নগর জীবনের মান উন্নয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
এগুলো এশিয়ার বহু উন্নয়নশীল দেশের চলমান চ্যালেঞ্জ। এসব সমস্যার সমাধান জটিল এবং জাতিসংঘের মতে, সংশ্লিষ্ট বহু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাই এখনও লক্ষ্যের অনেক বাইরে রয়েছে।
তবু জ্ঞান, দক্ষতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের একত্র করা গেলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে ডিসেম্বরের শুরুতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইনস্টিটিউট জাকার্তায় প্রথম নীতিগত গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সেখানে ‘গুণগত প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এশিয়ার ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি গঠন’ শীর্ষক একটি প্রধান উদ্যোগের সূচনা হয়। সরকারি মন্ত্রণালয়, বিশ্বব্যাংকসহ বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আঞ্চলিক থিংক ট্যাংক ও বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। এই উদ্যোগ গবেষণা, শিক্ষা ও আলোচনার জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি থিংক ট্যাংক হিসেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইনস্টিটিউট পাঁচটি স্তম্ভের সবকটিতেই নীতিনির্ধারকদের সহায়তায় সক্ষমতা উন্নয়ন ও প্রমাণভিত্তিক গবেষণার কাজ চালিয়ে যাবে। অঞ্চল ও বিশ্বের বিভিন্ন অংশের অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই শতকে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো এগিয়ে যাবে এবং সমৃদ্ধ হবে।
লেখক: বামবাং ব্রদজোনেগোরো এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইনস্টিটিউটের ডিন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
বামবাং ব্রদজোনেগোরো 



















