০৮:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫
মৃতদের আহ্বান: মেক্সিকোর মৃত্যু সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়ন সীতাকুণ্ডে প্রার্থী ঘোষণাকে ঘিরে সহিংসতার অভিযোগে বিএনপির চার নেতাকে বহিষ্কার ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের প্রশাসনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে শেয়ারবাজারে টানা পতন: ডিএসই ও সিএসই-তে লেনদেন কমেছে অনলাইন জুয়া লেনদেন বন্ধে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে কঠোর নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশের বিমান খাতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হবে এয়ারবাস: ফরাসি দূত তালেবানের ‘গ্রেটার আফগানিস্তান’ মানচিত্র: শক্তির নয়, হতাশার প্রতিফলন সিলেটে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত অন্তত ৩০ ঢাকায় এক তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার নোয়াখালীর কবিরহাটে ট্রাক-অটোর সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যু

একাত্তরে খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধা কামাল সিদ্দিকীর ভূমিকা

কামাল সিদ্দিকী মারা যাবার পরে মিডিয়াতে খুব ছোট পরিসরে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়েছে। সেখানে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী মারা গেছেন। কেউ লেখেনি বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল সিদ্দিকী মারা গেছেন।

আর কামাল সিদ্দিকী এমন একটা সময়ে মারা গেলেন, যে সময়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি অনেকেই লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন।

কামাল সিদ্দিকী একজন তরুণ এসডিও হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মুজিবনগরে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেওয়ার জন্যে তাঁর যেতে একটু দেরি হয়েছিলো। কারণ, ওই সময়ে প্রায় প্রতিটি মহকুমায় আওয়ামী নেতাদের নেতৃত্বে ও মহকুমা প্রশাসকদের সহায়তায় অনেকখানি তাদেরও নেতৃত্বেও – মার্চ থেকে এপ্রিল মাস জুড়ে –কোন কোন স্থানে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ, ছাত্র, জনতা, পুলিশ, ইপিআর, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য ও পাকিস্তান বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে আসা সদস্যরা পাকিস্তান বাহিনী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং নিজ নিজ এলাকা দীর্ঘদিন মুক্ত রাখে।

ওই সময়ে অনেক মহকুমা প্রশাসক বা জেলা প্রশাসক কীভাবে নিজহাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তা শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৯৭১ সালে জুলাই–আগস্টের দিকে বের হওয়া একটি মুক্তিযুদ্ধের রিপোর্ট সংকলনের প্রতিবেদনগুলো পড়লে জানা যায়। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহী কীভাবে নিজহাতে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন, তাছাড়া মানস ঘোষের বই পড়লেও জানা যায়, পাবনার নুরুল কাদের খান কীভাবে নিজহাতে অস্ত্র নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন।

এছাড়া ১৯৭১ সালের পত্রপত্রিকার আরও একটি নিউজ কালেকশনে (এ মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না, নিজের কাছেও এসব বই আর নেই। ভাড়া বাসায় বাস করতে হলে জীবনে মাঝে মাঝে বই ফেলে দেওয়া ও পুরানো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না) ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন) পাহাড়ে পাহাড়ে কীভাবে ঘোড়ায় চড়ে রাইফেল হাতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন খন্দকার মোশতাক | বণিক বার্তা

কামাল সিদ্দিকী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। তাই তিনি মুজিবনগর পৌঁছে সরকারে যোগ দেওয়ার জন্যে যান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাকে বাংলাদেশ সরকারের ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন।

নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পরেও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম জানিয়েও কামাল সিদ্দিকী তাঁর রুমে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাজউদ্দিন আহমদ হঠাৎ কাজ থেকে মুখ তুলে দেখেন, কামাল সিদ্দিকী তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাকে তাঁর মন্ত্রীর কাছে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চান।

কামাল সিদ্দিকী বিনয়ের সঙ্গে বলেন, তার কাজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন বিশেষ নির্দেশ আছে কিনা তা জানার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন।

তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমরা একটি দেশ সৃষ্টির জন্যে মুক্তিযুদ্ধ করছি। তাই এখানে সব থেকে বড়, আমাদের বিবেকের কাছে আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। এবং কোন ব্যক্তি নয়, দেশ ও দেশের স্বার্থই হবে আমাদের সবার কাছে বড়। সবার ওপরে দেশের স্বার্থ নিয়ে তোমার বিবেকই তোমাকে বলে দেবে কী করতে হবে।

এর পরের ইতিহাস তো আর নতুন করে বলার দরকার নেই। বাংলাদেশ ডেলিগেশন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতিসংঘে যাবার প্রস্তুতিকালে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে একটি বিশেষ দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কথা হয়। এবং খন্দকার মোশতাক তাদেরকে কথা দেন, তিনি জাতিসংঘে গিয়ে কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন।

খন্দকার মোশতাকের এই কনফেডারেশনের ঘোষণা দেওয়ার পক্ষে তখন বেশ কয়েকজন এমপি ও নেতা ছিলেন। তারা একটি চতুর স্লোগানও তুলেছিলেন মুজিবনগরে – “আমরা আগে মুজিবভাইকে চাই না, বাংলাদেশ চাই?” ওই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়া দুটো বিষয়ই সমান আবেগের ছিল। তবে খন্দকার মোশতাকগং খুবই মোক্ষম সময় বেছে নিয়েছিলেন এই স্লোগান তোলার জন্যে।

কারণ, প্রথম দিকের প্রতিরোধ যুদ্ধ ও পাকিস্তানের এলোমেলো অবস্থা নিয়ে মানুষ মনে করেছিল, আর কয়েক দিনের বা দুই এক মাসের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। আর ভারতও শীঘ্রই আক্রমণ করে দেশ জয় করে দেবে।

কাল তাজউদ্দীন আহমদ স্মরণে বিশেষ স্মৃতিচারণ সভা

কিন্তু তার বিপরীতে মানুষ দেখতে পায়, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছে। প্রশাসনেও তাদের কর্তৃত্ব মোটামুটি স্থির করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রহসনের বিচার শুরু হয়েছে। পাশাপাশি পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার প্রস্তুতিও এগিয়ে চলেছে।

অন্যদিকে ভারতীয় প্রশাসন অনেকটা নীরব। তারা কী করছে তা হয়তো শুধুমাত্র ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ জানেন। সব মিলে দেশের ভেতর, মুজিবনগরে সবখানেই একটা হতাশা নেমে আসে।

এই সময়টি বেছে নিয়ে খন্দকার মোশতাকগং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে ওই আবেগঘন স্লোগান ছেড়ে দেন – “আগে বঙ্গবন্ধুকে চাই না, আগে স্বাধীনতা চাই।” যা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে অনেক বড় অস্ত্র ছিল।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদসহ অন্যান্য বড় নেতারা এর বিপরীতে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, আমরা স্বাধীনতাও চাই এবং মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও চাই। এর জন্যে আমরা শেষ মুহূর্ত অবধি লড়াই চালিয়ে যাব।

যাহোক, তারপরেও যে খন্দকার মোশতাকগং একটি গোষ্ঠীকে হাতে পায়নি তা নয়, পেয়েছিল। যার পরবর্তী প্রকাশ দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে আরও স্পষ্ট হয়।

যাহোক, রাজনীতির মাঠকে ষড়যন্ত্রের জন্যে প্রস্তুত করে নিয়ে খন্দকার মোশতাক ওই সময়ে তার মোক্ষম কাজটি করার জন্যে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে গিয়ে তিনি যে কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন তার খসড়া তৈরি করে ফেলেন। সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুলের মতে ছিল, ওই খসড়া খন্দকার মোশতাককে সরবরাহ করা হয়েছিলো।

যাহোক, এর পরে আসে কামাল সিদ্দিকীর সেই বিনিদ্র ও অস্থিরতার কঠিন রাত্রি। সে সময়ে মুজিবনগরে সবাইকে অনেক কষ্ট করেই জীবনযাপন করতে হতো। কারণ, ভারত তখন আজকের ভারত নয়; অনেক দরিদ্র এক ভারত। কতটা দরিদ্র ছিল তা একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যাবে – ভারত যখন ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সঙ্গে কনভেনশনাল ওয়ারে যায়, সে সময়ে তার খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল মাত্র চার মাস কয়েক দিন, অর্থাৎ পাঁচ মাসের কাছাকাছি।

এ কারণে মুজিবনগরে শরণার্থী বা মুক্তিযোদ্ধাদের খুব বেশি সাহায্য করার সক্ষমতা ভারতের ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে তাই খাদ্য থেকে থাকার স্থান অবধি সব কিছুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো।

বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম

সে সময়ে কামাল সিদ্দিকী ও আলী আকবর খান (পরবর্তীতে সচিব ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খান) একটি চৌকিতে দুজনে রাতে ঘুমাতেন।

কিন্তু এক রাতে বাসায় ফেরার পরে কামাল সিদ্দিকী বিছানায় গেলেও কেন যেন ঘুমাতে পারছেন না, ছটফট করছেন বিছানায়, বারবার উঠছেন, বাথরুমে যাচ্ছেন, মুখে পানি দিচ্ছেন। রাতের গভীরতা যত বাড়ছে, কামাল সিদ্দিকী যেন ততই অস্থির হয়ে পড়ছেন।

তাঁর অস্থিরতায় বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আকবর আলী খানের। আকবর আলী খান এক পর্যায়ে বুঝতে পারেন, কামাল সিদ্দিকী কোন একটা জটিল সমস্যায় পড়ে গেছেন।

তখন তিনি কামাল সিদ্দিকীকে বলেন, কামাল, আমি বুঝতে পারছি তুমি কোন অসুস্থতায় ছটফট করছো না, তুমি কোন একটা জটিল সমস্যায় পড়েছো। ব্যক্তিগত না হলে আমাকে বলতে পারো।

কামাল সিদ্দিকী তার পরে বিষয়টি আকবর আলী খানের সঙ্গে শেয়ার করেন। তিনি বলেন, দেখো, তুমি আমি আমরা সকলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এবং আমরা একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করছি। এখন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমাদের নীতি তুমি ভালো করে জানো। আমার নির্বাহীকে বাইপাস করে আমি কোন তথ্য সর্বোচ্চ নির্বাহীকে দিতে পারি না। সে হিসেবে আমি আমার মন্ত্রীকে না জানিয়ে কোন তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দিতে পারি না বা মন্ত্রী নির্দেশ না দিলে কোন তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দিতে পারব না।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, দেশের স্বার্থে আমি যেন বিবেক অনুযায়ী দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি দায়বদ্ধ থাকি। এখন যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, এ যদি আমি প্রধানমন্ত্রীকে না জানাই তাহলে দেশের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে – ক্ষতি হবে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের।

সরকারের নথিপত্র একাধিক জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে: ড. আকবর আলি

তখন আকবর আলী খান বিষয়টি জেনে শুধু বলেন, তুমি যদি দেশের স্বার্থ দেখো, তাহলে তোমার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মানা উচিত। এবং আমি মনে করি তুমি সেটাই করো। আর চিন্তা করো না, এটাই সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন একটু ঘুমাও।

সে রাতে কামাল সিদ্দিকী ঘুমাতে পারেননি। খুব ভোরেই গিয়ে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের অফিসে। আজকের প্রজন্ম জানে না, ওই প্রজন্মের নেতারা কী আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে এই দেশটি সৃষ্টি করেছিলেন।

কামাল সিদ্দিকী ওই ভোরে গিয়েই দেখেন, প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আলো জ্বলছে। এখানে একটু বলা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ পরিবারের সঙ্গে থাকতেন না; তিনি অফিসেই থাকতেন।

কামাল সিদ্দিকী দেখেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ খালি গায়ে, তোয়ালে পরে বাথরুমে নিজে হাতে কাপড় পরিষ্কার করছেন। তিনি কামাল সিদ্দিকীকে দেখেই সেখানে ডাক দেন। এবং সেখানে দাঁড়িয়েই কামাল সিদ্দিকী বিস্তারিত জানান, জাতিসংঘে গিয়ে খন্দকার মোশতাক কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন এবং সে ঘোষণার খসড়ায় মূলত এই এই বিষয়গুলো আছে।

কামাল সিদ্দিকী দেখলেন, তার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর মুখের কোন পরিবর্তন হলো না। ততদিনে তারাও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে জেনে গেছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীকে সালাম জানিয়ে কামাল সিদ্দিকী বের হয়ে আসেন।

তারপরে খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যাওয়া বন্ধ হয়। এবং এর পর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে থাকেন আব্দুস সামাদ আজাদ। খন্দকার মোশতাক এক ধরনের নজরদারীতে ছিলেন।

কামাল সিদ্দিকী পরবর্তীতে ড. কামাল সিদ্দিকী ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পরে ক্ষমতায় এলে ওএসডি হন। সেদিন বাইরে অনেকেই মনে করেছিলেন, কামাল সিদ্দিকী হয়তো বিএনপি আমলে ভালো পদোন্নতি পেয়েছেন বলেই এটা করা হয়েছে।

কিবরিয়ার একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

বাস্তবে বিষয়টি তা ছিল না। তাঁর প্রতি এই অবিচারটি ঘটেছিল শুধুমাত্র ওই সময়ে আওয়ামী লীগে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ও টেকনোক্র্যাট কোটায় অর্থমন্ত্রী হওয়া শাহ এ এস এম কিবরিয়ার কারণে। মি. কিবরিয়া অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, ভালো বুরোক্র্যাট ছিলেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তারপরেও ওই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যে কারণে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কামাল সিদ্দিকীর মতো মেধাবী বুরোক্র্যাটকে ওএসডি হতে হয়েছিল। আর এর ফলে ১৯৯৬ সালের ওই সরকার একজন মুক্তিযোদ্ধা ও যোগ্য সরকারি কর্মকর্তার সেবা থেকে দেশকে বঞ্চিত করেছিল।

তাকে নিয়ে আরও অনেক ঘটনা সাংবাদিক জীবনের চলার পথে জেনেছি বা জানতে হয়েছে। হয়তো কোন একদিন সে সব লেখার সময়ও পেতে পারি, হয়তো নাও পেতে পারি।

তবে যে যাই বলুন না কেন, একজন সাংবাদিক হিসেবে তাকে যেভাবে দেখেছি এবং ভেতর থেকে কিছুটা জানার সুযোগ পেয়েছি, সে হিসাব মিলিয়ে বলবো – মুক্তিযোদ্ধা ড. কামাল সিদ্দিকী প্রজাতন্ত্রের মুখ্য সচিব হিসেবেই তাঁর বাংলাদেশ সরকারের চাকরি জীবন শেষ করেছিলেন। আর তাঁর সব থেকে বড় পরিচয়, তিনি মুক্তিযোদ্ধা কামাল সিদ্দিকী।

ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধাবান প্রজন্ম তাকে সেই সম্মান জানাবেই। কারণ, বাংলাদেশ বাংলাদেশই। এখানে কোন ১৯৪৭-এর বন্দোবস্ত হবে না। এটা কোন এব্যান্ডন প্রপার্টি নয় যে এখানে “বন্দোবস্তের” প্রশ্ন আসবে। আর ইতিহাসের পথ সব সময়ই দীর্ঘ, মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। আমরা দেখে যেতে পারলাম কি পারলাম না – তা বড় নয়, ইতিহাস বড় নির্মম। সেখানেও এক ধরনের দোজখ ও বেহেশত আছে। ইতিহাস তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্যে ইতিহাসের বেহেশত বরাদ্দ করে, আর বেঈমান, চক্রান্তকারীদের জন্য দোজখই বরাদ্দ করে।

কামাল সিদ্দিকীর সর্বোচ্চ পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তাই শব্দহীন, দৃষ্টিহীন সময়ে বসেও স্পষ্ট দেখা যায় – তার জন্য ইতিহাস কোন স্থান বরাদ্দ করে রেখেছেন।

লেখকঃ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.

জনপ্রিয় সংবাদ

মৃতদের আহ্বান: মেক্সিকোর মৃত্যু সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়ন

একাত্তরে খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধা কামাল সিদ্দিকীর ভূমিকা

০১:২১:০৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর ২০২৫

কামাল সিদ্দিকী মারা যাবার পরে মিডিয়াতে খুব ছোট পরিসরে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়েছে। সেখানে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী মারা গেছেন। কেউ লেখেনি বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল সিদ্দিকী মারা গেছেন।

আর কামাল সিদ্দিকী এমন একটা সময়ে মারা গেলেন, যে সময়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি অনেকেই লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন।

কামাল সিদ্দিকী একজন তরুণ এসডিও হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মুজিবনগরে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেওয়ার জন্যে তাঁর যেতে একটু দেরি হয়েছিলো। কারণ, ওই সময়ে প্রায় প্রতিটি মহকুমায় আওয়ামী নেতাদের নেতৃত্বে ও মহকুমা প্রশাসকদের সহায়তায় অনেকখানি তাদেরও নেতৃত্বেও – মার্চ থেকে এপ্রিল মাস জুড়ে –কোন কোন স্থানে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ, ছাত্র, জনতা, পুলিশ, ইপিআর, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য ও পাকিস্তান বাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে আসা সদস্যরা পাকিস্তান বাহিনী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং নিজ নিজ এলাকা দীর্ঘদিন মুক্ত রাখে।

ওই সময়ে অনেক মহকুমা প্রশাসক বা জেলা প্রশাসক কীভাবে নিজহাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তা শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৯৭১ সালে জুলাই–আগস্টের দিকে বের হওয়া একটি মুক্তিযুদ্ধের রিপোর্ট সংকলনের প্রতিবেদনগুলো পড়লে জানা যায়। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহী কীভাবে নিজহাতে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন, তাছাড়া মানস ঘোষের বই পড়লেও জানা যায়, পাবনার নুরুল কাদের খান কীভাবে নিজহাতে অস্ত্র নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন।

এছাড়া ১৯৭১ সালের পত্রপত্রিকার আরও একটি নিউজ কালেকশনে (এ মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না, নিজের কাছেও এসব বই আর নেই। ভাড়া বাসায় বাস করতে হলে জীবনে মাঝে মাঝে বই ফেলে দেওয়া ও পুরানো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না) ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন) পাহাড়ে পাহাড়ে কীভাবে ঘোড়ায় চড়ে রাইফেল হাতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন খন্দকার মোশতাক | বণিক বার্তা

কামাল সিদ্দিকী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। তাই তিনি মুজিবনগর পৌঁছে সরকারে যোগ দেওয়ার জন্যে যান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাকে বাংলাদেশ সরকারের ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন।

নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পরেও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম জানিয়েও কামাল সিদ্দিকী তাঁর রুমে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাজউদ্দিন আহমদ হঠাৎ কাজ থেকে মুখ তুলে দেখেন, কামাল সিদ্দিকী তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাকে তাঁর মন্ত্রীর কাছে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চান।

কামাল সিদ্দিকী বিনয়ের সঙ্গে বলেন, তার কাজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন বিশেষ নির্দেশ আছে কিনা তা জানার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন।

তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমরা একটি দেশ সৃষ্টির জন্যে মুক্তিযুদ্ধ করছি। তাই এখানে সব থেকে বড়, আমাদের বিবেকের কাছে আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। এবং কোন ব্যক্তি নয়, দেশ ও দেশের স্বার্থই হবে আমাদের সবার কাছে বড়। সবার ওপরে দেশের স্বার্থ নিয়ে তোমার বিবেকই তোমাকে বলে দেবে কী করতে হবে।

এর পরের ইতিহাস তো আর নতুন করে বলার দরকার নেই। বাংলাদেশ ডেলিগেশন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতিসংঘে যাবার প্রস্তুতিকালে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে একটি বিশেষ দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কথা হয়। এবং খন্দকার মোশতাক তাদেরকে কথা দেন, তিনি জাতিসংঘে গিয়ে কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন।

খন্দকার মোশতাকের এই কনফেডারেশনের ঘোষণা দেওয়ার পক্ষে তখন বেশ কয়েকজন এমপি ও নেতা ছিলেন। তারা একটি চতুর স্লোগানও তুলেছিলেন মুজিবনগরে – “আমরা আগে মুজিবভাইকে চাই না, বাংলাদেশ চাই?” ওই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়া দুটো বিষয়ই সমান আবেগের ছিল। তবে খন্দকার মোশতাকগং খুবই মোক্ষম সময় বেছে নিয়েছিলেন এই স্লোগান তোলার জন্যে।

কারণ, প্রথম দিকের প্রতিরোধ যুদ্ধ ও পাকিস্তানের এলোমেলো অবস্থা নিয়ে মানুষ মনে করেছিল, আর কয়েক দিনের বা দুই এক মাসের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। আর ভারতও শীঘ্রই আক্রমণ করে দেশ জয় করে দেবে।

কাল তাজউদ্দীন আহমদ স্মরণে বিশেষ স্মৃতিচারণ সভা

কিন্তু তার বিপরীতে মানুষ দেখতে পায়, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছে। প্রশাসনেও তাদের কর্তৃত্ব মোটামুটি স্থির করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রহসনের বিচার শুরু হয়েছে। পাশাপাশি পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার প্রস্তুতিও এগিয়ে চলেছে।

অন্যদিকে ভারতীয় প্রশাসন অনেকটা নীরব। তারা কী করছে তা হয়তো শুধুমাত্র ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ জানেন। সব মিলে দেশের ভেতর, মুজিবনগরে সবখানেই একটা হতাশা নেমে আসে।

এই সময়টি বেছে নিয়ে খন্দকার মোশতাকগং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে ওই আবেগঘন স্লোগান ছেড়ে দেন – “আগে বঙ্গবন্ধুকে চাই না, আগে স্বাধীনতা চাই।” যা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে অনেক বড় অস্ত্র ছিল।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদসহ অন্যান্য বড় নেতারা এর বিপরীতে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, আমরা স্বাধীনতাও চাই এবং মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও চাই। এর জন্যে আমরা শেষ মুহূর্ত অবধি লড়াই চালিয়ে যাব।

যাহোক, তারপরেও যে খন্দকার মোশতাকগং একটি গোষ্ঠীকে হাতে পায়নি তা নয়, পেয়েছিল। যার পরবর্তী প্রকাশ দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে আরও স্পষ্ট হয়।

যাহোক, রাজনীতির মাঠকে ষড়যন্ত্রের জন্যে প্রস্তুত করে নিয়ে খন্দকার মোশতাক ওই সময়ে তার মোক্ষম কাজটি করার জন্যে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে গিয়ে তিনি যে কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন তার খসড়া তৈরি করে ফেলেন। সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুলের মতে ছিল, ওই খসড়া খন্দকার মোশতাককে সরবরাহ করা হয়েছিলো।

যাহোক, এর পরে আসে কামাল সিদ্দিকীর সেই বিনিদ্র ও অস্থিরতার কঠিন রাত্রি। সে সময়ে মুজিবনগরে সবাইকে অনেক কষ্ট করেই জীবনযাপন করতে হতো। কারণ, ভারত তখন আজকের ভারত নয়; অনেক দরিদ্র এক ভারত। কতটা দরিদ্র ছিল তা একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যাবে – ভারত যখন ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সঙ্গে কনভেনশনাল ওয়ারে যায়, সে সময়ে তার খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল মাত্র চার মাস কয়েক দিন, অর্থাৎ পাঁচ মাসের কাছাকাছি।

এ কারণে মুজিবনগরে শরণার্থী বা মুক্তিযোদ্ধাদের খুব বেশি সাহায্য করার সক্ষমতা ভারতের ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে তাই খাদ্য থেকে থাকার স্থান অবধি সব কিছুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো।

বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম

সে সময়ে কামাল সিদ্দিকী ও আলী আকবর খান (পরবর্তীতে সচিব ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খান) একটি চৌকিতে দুজনে রাতে ঘুমাতেন।

কিন্তু এক রাতে বাসায় ফেরার পরে কামাল সিদ্দিকী বিছানায় গেলেও কেন যেন ঘুমাতে পারছেন না, ছটফট করছেন বিছানায়, বারবার উঠছেন, বাথরুমে যাচ্ছেন, মুখে পানি দিচ্ছেন। রাতের গভীরতা যত বাড়ছে, কামাল সিদ্দিকী যেন ততই অস্থির হয়ে পড়ছেন।

তাঁর অস্থিরতায় বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আকবর আলী খানের। আকবর আলী খান এক পর্যায়ে বুঝতে পারেন, কামাল সিদ্দিকী কোন একটা জটিল সমস্যায় পড়ে গেছেন।

তখন তিনি কামাল সিদ্দিকীকে বলেন, কামাল, আমি বুঝতে পারছি তুমি কোন অসুস্থতায় ছটফট করছো না, তুমি কোন একটা জটিল সমস্যায় পড়েছো। ব্যক্তিগত না হলে আমাকে বলতে পারো।

কামাল সিদ্দিকী তার পরে বিষয়টি আকবর আলী খানের সঙ্গে শেয়ার করেন। তিনি বলেন, দেখো, তুমি আমি আমরা সকলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এবং আমরা একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করছি। এখন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমাদের নীতি তুমি ভালো করে জানো। আমার নির্বাহীকে বাইপাস করে আমি কোন তথ্য সর্বোচ্চ নির্বাহীকে দিতে পারি না। সে হিসেবে আমি আমার মন্ত্রীকে না জানিয়ে কোন তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দিতে পারি না বা মন্ত্রী নির্দেশ না দিলে কোন তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দিতে পারব না।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, দেশের স্বার্থে আমি যেন বিবেক অনুযায়ী দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি দায়বদ্ধ থাকি। এখন যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, এ যদি আমি প্রধানমন্ত্রীকে না জানাই তাহলে দেশের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে – ক্ষতি হবে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের।

সরকারের নথিপত্র একাধিক জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে: ড. আকবর আলি

তখন আকবর আলী খান বিষয়টি জেনে শুধু বলেন, তুমি যদি দেশের স্বার্থ দেখো, তাহলে তোমার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মানা উচিত। এবং আমি মনে করি তুমি সেটাই করো। আর চিন্তা করো না, এটাই সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন একটু ঘুমাও।

সে রাতে কামাল সিদ্দিকী ঘুমাতে পারেননি। খুব ভোরেই গিয়ে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের অফিসে। আজকের প্রজন্ম জানে না, ওই প্রজন্মের নেতারা কী আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে এই দেশটি সৃষ্টি করেছিলেন।

কামাল সিদ্দিকী ওই ভোরে গিয়েই দেখেন, প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আলো জ্বলছে। এখানে একটু বলা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ পরিবারের সঙ্গে থাকতেন না; তিনি অফিসেই থাকতেন।

কামাল সিদ্দিকী দেখেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ খালি গায়ে, তোয়ালে পরে বাথরুমে নিজে হাতে কাপড় পরিষ্কার করছেন। তিনি কামাল সিদ্দিকীকে দেখেই সেখানে ডাক দেন। এবং সেখানে দাঁড়িয়েই কামাল সিদ্দিকী বিস্তারিত জানান, জাতিসংঘে গিয়ে খন্দকার মোশতাক কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন এবং সে ঘোষণার খসড়ায় মূলত এই এই বিষয়গুলো আছে।

কামাল সিদ্দিকী দেখলেন, তার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর মুখের কোন পরিবর্তন হলো না। ততদিনে তারাও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে জেনে গেছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীকে সালাম জানিয়ে কামাল সিদ্দিকী বের হয়ে আসেন।

তারপরে খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যাওয়া বন্ধ হয়। এবং এর পর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে থাকেন আব্দুস সামাদ আজাদ। খন্দকার মোশতাক এক ধরনের নজরদারীতে ছিলেন।

কামাল সিদ্দিকী পরবর্তীতে ড. কামাল সিদ্দিকী ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পরে ক্ষমতায় এলে ওএসডি হন। সেদিন বাইরে অনেকেই মনে করেছিলেন, কামাল সিদ্দিকী হয়তো বিএনপি আমলে ভালো পদোন্নতি পেয়েছেন বলেই এটা করা হয়েছে।

কিবরিয়ার একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

বাস্তবে বিষয়টি তা ছিল না। তাঁর প্রতি এই অবিচারটি ঘটেছিল শুধুমাত্র ওই সময়ে আওয়ামী লীগে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ও টেকনোক্র্যাট কোটায় অর্থমন্ত্রী হওয়া শাহ এ এস এম কিবরিয়ার কারণে। মি. কিবরিয়া অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, ভালো বুরোক্র্যাট ছিলেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তারপরেও ওই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যে কারণে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কামাল সিদ্দিকীর মতো মেধাবী বুরোক্র্যাটকে ওএসডি হতে হয়েছিল। আর এর ফলে ১৯৯৬ সালের ওই সরকার একজন মুক্তিযোদ্ধা ও যোগ্য সরকারি কর্মকর্তার সেবা থেকে দেশকে বঞ্চিত করেছিল।

তাকে নিয়ে আরও অনেক ঘটনা সাংবাদিক জীবনের চলার পথে জেনেছি বা জানতে হয়েছে। হয়তো কোন একদিন সে সব লেখার সময়ও পেতে পারি, হয়তো নাও পেতে পারি।

তবে যে যাই বলুন না কেন, একজন সাংবাদিক হিসেবে তাকে যেভাবে দেখেছি এবং ভেতর থেকে কিছুটা জানার সুযোগ পেয়েছি, সে হিসাব মিলিয়ে বলবো – মুক্তিযোদ্ধা ড. কামাল সিদ্দিকী প্রজাতন্ত্রের মুখ্য সচিব হিসেবেই তাঁর বাংলাদেশ সরকারের চাকরি জীবন শেষ করেছিলেন। আর তাঁর সব থেকে বড় পরিচয়, তিনি মুক্তিযোদ্ধা কামাল সিদ্দিকী।

ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধাবান প্রজন্ম তাকে সেই সম্মান জানাবেই। কারণ, বাংলাদেশ বাংলাদেশই। এখানে কোন ১৯৪৭-এর বন্দোবস্ত হবে না। এটা কোন এব্যান্ডন প্রপার্টি নয় যে এখানে “বন্দোবস্তের” প্রশ্ন আসবে। আর ইতিহাসের পথ সব সময়ই দীর্ঘ, মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। আমরা দেখে যেতে পারলাম কি পারলাম না – তা বড় নয়, ইতিহাস বড় নির্মম। সেখানেও এক ধরনের দোজখ ও বেহেশত আছে। ইতিহাস তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্যে ইতিহাসের বেহেশত বরাদ্দ করে, আর বেঈমান, চক্রান্তকারীদের জন্য দোজখই বরাদ্দ করে।

কামাল সিদ্দিকীর সর্বোচ্চ পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তাই শব্দহীন, দৃষ্টিহীন সময়ে বসেও স্পষ্ট দেখা যায় – তার জন্য ইতিহাস কোন স্থান বরাদ্দ করে রেখেছেন।

লেখকঃ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.