অতিরিক্ত চিন্তার বিপদ
“অতিরিক্ত চিন্তা আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে, মানসিক চাপ বাড়ায় এবং জীবনের প্রতিটি দিককে জটিল করে তোলে,” বলেন নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. সিলভিয়া মার্সার।
তিনি জানান, মানুষ সাধারণত এই প্রবণতাকে উপেক্ষা করে কিন্তু এর ফল হয় ক্রমাগত আত্মসন্দেহ, হারানো সুযোগ এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন।
ফলাফল—আপনি নিজেকে ক্লান্ত, আটকে পড়া ও পিছিয়ে পড়া মানুষ হিসেবে অনুভব করেন। সম্পর্ক, কর্মজীবন, ব্যক্তিগত উন্নতি, আত্মযত্ন—সবক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ে।
থেরাপিতেও ব্যর্থতা: সমস্যা কোথায়?
২৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ড. মার্সার বলেন, “অনেক আচরণ-বিশেষজ্ঞও জানেন না কীভাবে অতিরিক্ত চিন্তাকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা যায়।”
তিনি বহু বিখ্যাত থেরাপিস্টের সঙ্গে কাজ করেছেন, কিন্তু দেখেছেন—অতিরিক্ত চিন্তা দূর করার স্থায়ী সমাধান খুব কম জনই দিতে পারেন।
“এটা আপনার দোষ নয়, এটা আপনার মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষা”
ড. মার্সার ব্যাখ্যা করেন—
যদি আপনি কারও প্রতি খুব দ্রুত সংযুক্ত হয়ে পড়েন,
যদি আপনার মেজাজ অন্যের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে,
যদি আপনি মানুষের আচরণের সামান্য পরিবর্তনও লক্ষ্য করেন,
অথবা প্রতিটি বার্তার বিশ্লেষণ করেন—
তাহলে সেটি আপনার ভুল নয়, এটি আপনার মস্তিষ্কের আত্মরক্ষার প্রতিক্রিয়া।
কেন জার্নালিং, মেডিটেশন ও ইচ্ছাশক্তি কাজ করে না
অতিরিক্ত চিন্তার সময় সাধারণত দেখা যায়:
- সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা ও বিলম্ব;
- কথোপকথনের পর নিজেকে দোষারোপ;
- অন্যরা কী ভাবছে তা নিয়ে উদ্বেগ;
- আত্মবিশ্বাসের অভাবে সুযোগ হারানো;
- বিশ্রামের চেষ্টায়ও মন শান্ত না থাকা।
এই মানসিক অবস্থায় মস্তিষ্ক মনোযোগ হারায় এবং সাময়িক স্বস্তির জন্য ছোটখাটো বিভ্রান্তি—যেমন সোশ্যাল মিডিয়া বা খাবারের দিকে ঝুঁকে যায়। কিন্তু এগুলো কেবল অস্থায়ী আরাম দেয়, স্থায়ী সমাধান নয়।
ভুল পরামর্শে আরও হতাশা
অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, “চিন্তা বন্ধ করো, সিদ্ধান্ত নাও।”
কিন্তু ড. মার্সার মনে করেন, এই পরামর্শ কখনো কাজ করে না। বরং মানুষ আরও হতাশ, বিভ্রান্ত ও আত্মসন্দেহে ভোগে।
তারা জার্নাল লেখে, কিন্তু আরও বিশ্লেষণে জড়িয়ে পড়ে;
ধ্যান করে, কিন্তু ভাবতে থাকে “আমি ঠিক করছি তো?”;
একটার পর একটা সেলফ-হেল্প ভিডিও দেখে, কিন্তু পরিবর্তন আসে না।
ডোপামিন ও অতিরিক্ত চিন্তার সংযোগ
গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত চিন্তা মস্তিষ্কের নিউরাল পথ পরিবর্তন করে—যার ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, চাপ বেড়ে যায়।
ড. মার্সার বলেন, “এর মূল কারণ শুধু উদ্বেগ নয়, বরং মস্তিষ্কে ডোপামিনের ভারসাম্যহীনতা।”
যখন ডোপামিনের মাত্রা অস্বাভাবিক হয়, তখন মস্তিষ্ক দ্রুত স্বস্তি খোঁজে, যেমন স্ক্রল করা, ভিডিও দেখা বা অকারণে খাওয়া।
এভাবে “দ্রুত আনন্দ” পাওয়ার অভ্যাসে মস্তিষ্ক বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বিভ্রান্তিতেই ডুবে থাকে। ফলে মানুষ ক্রমাগত চিন্তা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার চক্রে আটকে যায়।
00প্রচলিত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
ড. মার্সার বলেন, “আমি ডোপামিন ও অতিরিক্ত চিন্তার সম্পর্ক গভীরভাবে অনুসন্ধান করি এবং দেখি, প্রচলিত পদ্ধতিগুলো খুব স্বল্পমেয়াদি।”
- মাইন্ডফুলনেস: শুরুতে সাহায্য করে, কিন্তু চাপের মুহূর্তে প্রভাব হারায়।
- স্বাস্থ্যকর ব্যস্ততা: সাময়িক আরাম দেয়, কিন্তু মূল সমস্যা রয়ে যায়।
- পজিটিভ অ্যাফার্মেশন: মন ভালো করে, কিন্তু নেতিবাচক চিন্তার মূল কারণ বদলায় না।
তবে একদিন তিনি এমন একটি পদ্ধতি খুঁজে পান, যা সত্যিই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
“ডোপামিন ডিটক্স”: এক বৈজ্ঞানিক সমাধান
গবেষণার সময় তিনি অনলাইনে ‘মাইন্ডওয়ে’ নামে একটি প্রোগ্রামের কথা জানতে পারেন—যা ‘ডোপামিন ডিটক্স’ ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি।
এটি মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমকে রিসেট করে, আত্মবিশ্বাস ও মনোযোগ বাড়ায়, উদ্বেগ কমায় এবং অতিরিক্ত চিন্তার চক্র ভেঙে দেয়।
প্রোগ্রামটি ব্যক্তিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আপনার “ওভারথিংকিং স্কোর” নির্ধারণ করে এবং মূল কারণ শনাক্ত করে।
বাস্তব ফলাফল: মাত্র ৫ মিনিটের পরিবর্তন
ড. মার্সার তার রোগীদের মধ্যে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন এবং মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই আশ্চর্যজনক ফলাফল দেখতে পান।
তাদের উদ্বেগ, আত্মসন্দেহ ও মানসিক চাপ কমে যায়; আত্মবিশ্বাস বাড়ে; এবং তারা সহজে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা আরও শান্ত, উৎপাদনশীল ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে।
ড. মার্সারের মতে, “মাইন্ডওয়ে কেবল চিন্তা বন্ধ করে না এটি মানুষকে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সাহায্য করে।”
তিনি পরামর্শ দেন, “আমার কথায় বিশ্বাস না করে, নিজের জীবনে চেষ্টা করে দেখুন।”
এই “ডোপামিন ডিটক্স” পদ্ধতি প্রমাণ করে, অতিরিক্ত চিন্তা কোনো দুর্বলতা নয়—এটি মস্তিষ্কের ভুল প্রতিক্রিয়া, যা পুনর্সন্তুলনের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















