মালয়েশিয়ার সেতিয়া আলামে তখন আকাশ শান্ত। কিন্তু আবহাওয়ার অনিশ্চয়তায় কখন যে পরিস্থিতি বদলে যাবে, কেউ জানে না। সেই অজানা সময়ের জন্যই প্রস্তুত থাকে ইউনাইটেড শিখস মালয়েশিয়া। বন্যা, ভূমিকম্প বা যে কোনো মানবিক সংকটে ডাক পড়ার আগেই তারা তৈরি থাকে। কোনো প্রচার নয়, কোনো ঢাকঢোল নয়—শুধু কাজ। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তাদের নিয়ম।
সংকট এলেই মাঠে নেমে পড়া
ইউনাইটেড শিখস মালয়েশিয়ার মূল দর্শন খুব স্পষ্ট। কোথাও বিপদ হলে সময় নষ্ট না করে যা করা দরকার, সেটাই করা। সংগঠনের সহসভাপতি মানদীপ সিংহ বলেন, তারা অপেক্ষা করেন না পরিস্থিতি বড় হয়ে ওঠার। অনেক সময় অন্যরা বোঝার আগেই তারা মাঠে নেমে পড়েন। এই দ্রুততার কারণেই বহু মানুষ সময়মতো সাহায্য পান।
সেবার জন্য প্রস্তুত অবকাঠামো
সেতিয়া আলামের অফিসটি শুধু দপ্তর নয়, এক ধরনের জরুরি সেবা কেন্দ্র। সেখানে রাখা আছে হাসপাতালের শয্যা, হুইলচেয়ার, অক্সিজেন কনসেনট্রেটরসহ নানা চিকিৎসা সরঞ্জাম। আরও বড় মজুত রয়েছে রাওয়াংয়ের গুদামে। সবকিছু সাজানো হয়েছে একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে—যেন সংকট এলেই এক মুহূর্ত দেরি না হয়।
ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানবতার বন্ধন
শিখ ধর্মের আদর্শ থেকে জন্ম নিলেও ইউনাইটেড শিখস মালয়েশিয়া কোনো ধর্ম বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে আছেন নানা ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সাহায্যও দেওয়া হয় সবাইকে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের হাট ইয়াইয়ে ভয়াবহ বন্যার সময় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। সেখানে আটকে পড়া মালয়েশিয়ানদের উদ্ধারে সীমান্ত পেরিয়ে ছুটে যান সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা।
প্রতিষ্ঠাতার উত্তরাধিকার
সংগঠনের দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো শুধু স্মৃতি নয়, এক ইতিহাস। সেখানে সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখটি প্রয়াত ঋষিবন্ত সিংহ রন্ধাওয়ার। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের প্রাণ। ২০১৮ সালে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরও তার দর্শনই পথ দেখায় ইউনাইটেড শিখসকে। ‘সমগ্র মানবজাতিকে এক হিসেবে দেখো’—এই বিশ্বাস থেকেই তার কাজের শুরু, আর সেখান থেকেই সংগঠনের পথচলা।

বন্যা উদ্ধার ছাড়াও বিস্তৃত কাজ
মানুষ সাধারণত বন্যা উদ্ধারের ছবিতেই ইউনাইটেড শিখসকে দেখে। কিন্তু এর বাইরেও তাদের কাজের পরিসর অনেক বড়। তারা নিয়মিত খাবার পৌঁছে দেয় গৃহহীন ও দরিদ্র পরিবারে। বিনা মূল্যে চিকিৎসা শিবির আয়োজন করে, দরিদ্র রোগীদের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জাম জোগাড় করে। কোভিডের সময় তারা শুধু খাবার বা চিকিৎসাই নয়, অবহেলিত মৃতদের সম্মানের সঙ্গে শেষকৃত্যের ব্যবস্থাও করেছে।
আইনি সহায়তা ও শিক্ষায় পাশে থাকা
আইনি জটিলতায় আটকে পড়া অসহায় মানুষদের দিকেও নজর দেয় সংগঠনটি। আইনি পরামর্শ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়। পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনার জন্য যেসব শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, তাদের পাশে দাঁড়ায় ইউনাইটেড শিখস মালয়েশিয়া।
নিঃশব্দ সেবার শক্তি
সংগঠনের সভাপতি সুনীল শুকভীর সিংহ বলেন, মানুষ সাধারণত নাটকীয় মুহূর্তগুলো দেখে। কিন্তু প্রকৃত কাজ হয় নীরবে, আলোচনার বাইরে। কারও শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়ানোই তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
শিখ দর্শনের প্রেরণা
ভান্ড কে ছকনা—যা আছে তা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া—এই শিক্ষাই তাদের মূল প্রেরণা। শিখ ধর্মে সেবা কোনো বাড়তি বিষয় নয়, এটি জীবনের অংশ। সেই দর্শন থেকেই ইউনাইটেড শিখস মালয়েশিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ।
মানবিক মালয়েশিয়ার প্রতিচ্ছবি
এই সংগঠনের কাজের ভেতর দিয়ে এক ধরনের মালয়েশিয়াকে দেখা যায়, যেখানে সীমান্তের চেয়ে মানবতা বড়, আর পরিচয়ের চেয়ে প্রয়োজন গুরুত্বপূর্ণ। অনিশ্চিত আবহাওয়া আর সংকটের ভিড়েও এই স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রমাণ করে চলেছেন—মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ালেই সমাজ টিকে থাকে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















