ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপ যে আর বেশি দূর যাবে না তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প-পুতিনের শান্তি প্রস্তাব আপাতদৃষ্টিতে অনেক পার্থক্য মনে হলেও বাস্তবে দুজনের মূল প্রক্রিয়া ও সমাধান কাছাকাছি।
যার ফলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—
যেমন, রাশিয়া তার নিরাপত্তার স্ট্রাটেজিতে ইউক্রেনের যে এলাকাগুলো তার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতো—তার প্রায় সবটুকু রাশিয়ার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে মেনে নেওয়া হবে।
ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে না। তাছাড়া ন্যাটোর ভবিষ্যতও খুব বেশি ভালো না। সে আলোচনা এখানে নয়। এখানে শুধু বলা যেতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধের এই পরিণতি এবং রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সখ্যতা সব মিলে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া সমর্থক আরেকটি জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
রাশিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; তবে এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ভূ-রাজনীতিতে নতুন বার্তা দিতে সমর্থ হয়েছে রাশিয়া—যা অনেকটা বৃহৎ শক্তির আধিপত্যের প্রকাশ ও বেলি স্টেটের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেওয়া।

পাশাপাশি বিশ্বের একক ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র আমেরিকাকেও একটি নতুন বার্তা যে, পৃথিবী আর একক বা দুই পরাশক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। কারণ, আঞ্চলিক বড় শক্তিগুলো অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে কম নয়। আমেরিকাকে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে চলতে হবে।
অন্যদিকে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যেমন একদিকে তার ভূমি হারিয়েছে, তেমনি তার যে ভূ-রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিকাল গুরুত্ব ছিল তা-ও হারিয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে শুধু আমেরিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ইউক্রেনের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে হলে আগামী দশ বছরে ২’শ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। যা তাকে আমেরিকাও দিতে পারবে না। তেমনি দিতে পারবে না বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য অর্থসহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইউক্রেনের ভবিষ্যত যখন এদিকে এগোচ্ছে—সে সময় স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসছে, ইউক্রেনে রঙীন বিপ্লবের ভেতর দিয়ে জেলেনস্কিকে ক্ষমতায় এনে বড় প্রতিবেশী বা আঞ্চলিক বড় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা কি কোনো একটি লিটমাস টেস্ট ছিল? যা বর্তমান বিশ্বের জিওগ্রাফিকাল পাওয়ার বদলে আঞ্চলিক শক্তিগুলো এখনো ক্ষমতাশালী না আমেরিকা এখনও একক রয়েছে—তা পরীক্ষা করা।
বাস্তবে এ ধরনের একটি ন্যারেটিভ বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখায় উঠে আসছে। তবে তার সবটুকু সত্য নয়। কারণ, ২০০৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ রাশিয়া, চায়না, আমেরিকা ও ভারতের বেলি স্টেটগুলোর ভবিষ্যৎ করণীয় কী, এবং এই বড় শক্তির বাইরে গেলে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যত কী—তার স্পষ্ট ধারণা তাঁর একটি লেখায় তুলে ধরেছিলেন। লেখাটি বাংলাভাষাতেই তিনি লিখেছিলেন। উনি তার কোনো ইংরেজি ভার্সন বা জার্নাল-উপযোগী করেছেন বলে চোখে পড়েনি। তবে ওই সংক্ষিপ্ত লেখায় তিনি এই ভবিষ্যৎই বলে দিয়েছিলেন এবং এর বাইরে গেলে বিপদগুলোর ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে এই ধরনের ছোট ছোট বেলি স্টেট ঘিরে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। প্রথমত, এ ধরনের রাষ্ট্রগুলোর সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে বিবেচনা করে—রাষ্ট্রের বাইরেও পৃথিবীতে আরও কিছু বড় শক্তি রয়েছে—যেমন বিভিন্ন খনিজ সম্পদ, পোর্ট সম্পদ, এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। এরা সব সময় সক্রিয় থাকে।
এই শক্তিগুলো কখনও কখনও এই ধরনের ছোট রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধাক্রান্ত করে বা রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করে এবং তাদের অর্থে নানা নামে, এমনকি ধর্মের নামে, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে, বিশেষ ধরনের জাতীয়তাবাদের নামে, বৈষম্যের নামে—সারা পৃথিবীতে যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো গড়ে উঠেছে এবং প্রয়োজনে গড়ে তোলে—তাদেরকে ব্যবহার করে।
তাই সাধারণ নিয়মের বাইরে যখনই কোনো রাষ্ট্রে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয় তখন বড় রাষ্ট্রের দিকে শুধু আঙুল না তুলে এটাও খুঁজে দেখা দরকার—এই শক্তিগুলো এখানে কাজ করেছে কি না। কারণ, এই শক্তিগুলো বড় রাষ্ট্রগুলোর অনেক অংশকেও প্রভাবিত করতে পারে। যেমন ইউক্রেনের পোর্ট ও তার জিওগ্রাফিকাল অবস্থান শুধু স্বীকৃত কোম্পানির জন্য নয়, আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণকারীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন জিওগ্রাফিকালি লিবিয়াও ছিল অনেক প্রয়োজনীয়—ভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করলে।
কোনো রাষ্ট্রই পৃথিবীর এই আধা-দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বা আন্ডারওয়ার্ল্ড শক্তিকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কারণ, তাদেরও ছদ্মাবরণ আছে—এমনকি সেটা মানবাধিকার থেকে উদার গণতন্ত্রের পোশাকও মাঝে মাঝে পরে।
তবে যে কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রই যেমন তার অর্থনীতি, সমরনীতি, কূটনীতি ও দেশের মানুষের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে—তেমনি পৃথিবীর রাষ্ট্রের বাইরের এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজও করে।
আর রাষ্ট্রের বাইরের এই শক্তি সব সময় ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্র যেগুলোর সম্পদ ও জিওগ্রাফিকাল পাওয়ার আছে—সেগুলোকেই টার্গেট করে।
অতীতে দেখা গেছে এই রাষ্ট্রগুলো নিয়ে যাতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই শক্তিগুলো বেশি খেলাধুলা করতে না পারে—সেজন্য তার পাশের বড় রাষ্ট্রগুলোর প্রথম পদক্ষেপ থাকতো সেখানে স্থিতিশীল সরকারকে শক্তিশালী করা। তা সম্ভব না হলে—একটি রাষ্ট্রকে দুই বা আরও বেশি রাষ্ট্রে পরিণত করে তাদের জিওগ্রাফিকাল পাওয়ার নষ্ট করে দেওয়া। এছাড়া নানান সফট পাওয়ার দিয়েও তারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতো।
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ভেতর দিয়ে রাশিয়া যে অবস্থানে পৌঁছে গেছে এবং ট্রাম্প যে শান্তিচুক্তি নিয়ে এগোচ্ছেন—তার ভেতর দিয়ে ভূ-রাজনীতিতে আরেকটি নতুন বিষয় যোগ হতে যাচ্ছে।

অর্থাৎ ইউক্রেনের জিওগ্রাফিকাল পাওয়ারটুকুই রাশিয়া নিজ দখলে নিয়ে শুধু আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক শক্তি নয়—ইউরোপকেও শক্তির দিক পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এবং আমেরিকা, চায়না সহ সকল বড় ও আঞ্চলিক শক্তি শেষ বিচারে এর পক্ষেই থাকবে। কারণ, কোনো বড় রাষ্ট্রই আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রিত কোনো ছোট রাষ্ট্রের পক্ষে যায় না। প্রতিটি বড় রাষ্ট্রই পারস্পারিক অর্থনীতির জন্য বড় বাজার এবং নানান বিষয়ে উভয়ে উভয়ের পরিপূরক।
তাছাড়া ওই ধরনের অদৃশ্য শক্তি-নিয়ন্ত্রিত কোনো দেশের সঙ্গে গেলে তার যেমন অর্থনীতির ক্ষতি হয়—তেমনি নিজ দেশেও অস্থিতিশীলতাকে আহ্বান করা হয়। তাই এ আন্ডারওয়ার্ল্ডের পরোক্ষ সমর্থন যখন কোনো রাষ্ট্রের সরকারের প্রতি থাকে—তার সঙ্গে কোনো বড় রাষ্ট্র শতভাগ সম্পর্ক বা কোনো জোট তৈরি করে না।
জেলেনস্কি অবশ্য শেষ চেষ্টা করছে একটি তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেকে ও তার আন্ডারওয়ার্ল্ড শক্তিকে শক্তিশালী করার। তবে ঘটনা যেদিকে এগোচ্ছে—তাতে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে সম্ভব হবে না। বরং নির্বাচনের নামে তার শক্তিকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতি ও ভবিষ্যত আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.
#geopolitics | UkraineWar | RussiaStrategy

স্বদেশ রায় 


















