শনিবার রাতে ভারতের দিল্লির কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা বেস্টনি ভেদ করে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেছে ‘হিন্দু চরমপন্থীদের’ একটি দল।
রবিবার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এ খবর দিলেও ভারত কিংবা বাংলাদেশ – কর্তৃপক্ষের তরফে কোন পক্ষ থেকেই প্রথমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।
বিকেল নাগাদ প্রথমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ফেসবুকে এ নিয়ে একটি বিবৃতি দেন, আর তার কিছু পরেই বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা একটি ব্রিফিং করেন।
তারপরই জানা যায় শনিবার রাতে দিল্লির চানক্যপুরীতে যেখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অফিস, সেখানে একদল হিন্দু চরমপন্থী নিরাপত্তা বেস্টনি পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল।
এ সময় ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তবে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে উদ্ধৃত করে ফেসবুকে দেয়া বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, “একদল যুবক বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাসের ঘটনার প্রতিবাদ করে শ্লোগান দিয়েছে, কিন্তু বেস্টনি ভেদ করা বা নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরির কোনো চেষ্টা ছিলো না।”
যদিও ভারতের এ বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন তৌহিদ হোসেন।
সপ্তাহখানেক ধরে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপােড়েন বাড়ছে, এবং দুই দেশেই এ নিয়ে তিক্ত ঘটনা বেড়ে চলেছে।
গত ১২ই ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন, এবং তার সন্দেহভাজন হামলাকারী ‘ভারতে পালিয়েছেন’- এমন খবর সামাজিক মাধ্যমে চাউর হওয়ার পর ঢাকায় মূলত ভারতবিরোধী প্রচারণা নতুন গতি পেয়েছে।
বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে কী ঘটেছিল শনিবার রাতে?
দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, শনিবার রাত নয়টার দিকে হাইকমিশনের সামনে ‘হিন্দু চরমপন্থীদের’ একটি দল বিক্ষোভ করে।
তারা বাংলাদেশ হাউসের মূল ফটকের সামনে উপস্থিত হয়। এ সময় তারা বাংলাদেশ বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেয়।
এ সময় তারা ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে গালিগালাজ করে।
কিছুক্ষণ অবস্থানের পর এক সময় তারা সেখান থেকে চলে যায়।
গতকাল রাতের ওই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে কােনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া হয়নি।
তবে, বিকেলে ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন অভিযোগ করেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি।
কী বলছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়?
বিকেলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে উদ্ধৃত করে একটি বিবৃতিতে দেয়া হয়েছে, যেখানে শুরুতেই অভিযােগ করা হয়েছে গত রাতের ঘটনাটি নিয়ে বাংলাদেশের কতিপয় গণমাধ্যম ভুল সংবাদ প্রকাশ করছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “শনিবার রাতে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে ২০-২৫ জন যুবক বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাসের নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ করে স্লােগান দিয়েছে। সাথে তারা বাংলাদেশে সকল সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তা দাবি করে স্লােগান দেয়।”

“কিন্তু হাইকমিশনের বেস্টনি ভেদ করা বা কােনো ধরনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরির কোনো চেষ্টা ছিলো না।”
প্রসঙ্গত, ১৯শে ডিসেম্বর রাতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাস নামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন পোশাক শ্রমিককে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।
যদিও এ ঘটনায় ‘ধর্ম অবমাননার’ কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০ জনকে আটক করেছে র্যাব ও স্থানীয় পুলিশ।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরাে বলা হয়েছে, পুলিশ কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই যুবকদের দলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ওই ঘটনার ‘ভিজ্যুয়াল এভিডেন্স’ জনগণের জন্য উন্মুক্ত, চাইলে সেটি যে কেউ দেখে নিতে পারেন।
সাথে উল্লেখ করা হয়েছে, “ভারত ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী তার ভূখণ্ডের মধ্যে বিদেশী মিশমনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ”।
এছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে ভারত উদ্বিগ্ন উল্লেখ করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে ভারত নিবিড় দৃষ্টি রাখছে।
সাথে দিপু চন্দ্র দাসের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানানাে হয় বিবৃতিতে।

কী বলছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়?
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তৌহিদ হোসেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য খারিজ করে দেন।
তিনি প্রশ্ন তােলেন, দিল্লিতে বাংলাদেশের মিশন কূটনৈতিক এলাকার বেশ ভেতরে এবং সেখানে হিন্দু চরমপন্থীদের ২৫ জনের একটি দল এতদূর পর্যন্ত আসতে পারবে কেনো?
“তার মানে তাদের আসতে দেওয়া হয়েছে। যেভাবেই হোক তারা এসেছে। আসতে পারার কথা নয় কিন্তু। তারা যে হিন্দু নাগরিকের হত্যার প্রতিবাদ করে চলে গেছে তা নয় কিন্তু। তারা আরও অনেক কিছু বলেছে।”
“প্রমাণ নেই, কিন্তু শুনেছি তাকে (বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে) হুমকি দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত আসতে পারবে কেন। হুমকি দিতে পারবে কেন,” বলছিলেন মি. হোসেন।
তিনি বলেন, সাধারণত হাইকমিশন বা দূতাবাস এলাকায় কোনো গ্রুপ গেলে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে জানানো হয় ও পুলিশ দূরেই তাদের আটকে দেয়, যা সব দেশেই দেখা যায়।
“তারা শুধু এসে দুটো শ্লোগান দিয়েছে তা নয়। হাইকমিশনার ও তার পরিবার ওখানে বাস করে। তারা হুমকি বোধ করেছে, আতঙ্কিত হয়েছে কারণ দুজন গার্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো,” বলেন উপদেষ্টা।
ময়মনসিংহের দিপু চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, একজন বাংলাদেশী নাগরিক নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন এবং এ বিষয়ে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে।
কিন্তু দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের নিরাপত্তার বিষয়ে যেসব দায়িত্ব সেটি ঠিক মতো পালিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“আমরা আশা করবো এ ধরনের পরিবেশ আর হবে না। দু পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ আছে। সে প্রেক্ষাপটেই প্রেসনোট এসেছে। আমরা এখনো ভরসা রাখছি যে ভারত যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবে”।
বিবিসি বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















