আমাজনের অন্তঃস্থলে এখন এক ভয়াবহ নীরবতা। নদী আর জীবনের উৎস নয়— হয়ে উঠেছে বিষের বাহক। অবৈধ স্বর্ণখনির পারদে দূষিত এই নদীগুলোর ধারে বসবাসরত নারীরা আজ গর্ভধারণকেই ভয় পাচ্ছেন। মাতৃদুগ্ধে বিষ, শিশুর শরীরে অক্ষমতা— এক প্রজন্মজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক অদৃশ্য মানবিক বিপর্যয়।
পারা রাজ্যে এক ভয়াবহ বাস্তবতা
ব্রাজিলের পারা প্রদেশে, যেখানে ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ–৩০’, সেখানেই স্বাস্থ্য গবেষকরা উন্মোচন করছেন এক ভয়াবহ তথ্য। অবৈধ স্বর্ণখনির পারদ দূষণ স্থানীয় আদিবাসী শিশুদের মধ্যে স্নায়বিক বিকলতা ও জন্মগত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে প্রমাণ মিলছে।
ফিওক্রুজ নামের ব্রাজিলের জাতীয় জনস্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই গবেষণা পরিচালনা করছে। তারা জানায়, সাই সিনজা নামের মুণ্ডুরুকু আদিবাসী গ্রামের অন্তত ৩৬ জন মানুষ — বেশিরভাগই শিশু — জেনেটিক পরীক্ষায় ব্যাখ্যাতীত স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত।
“মাতৃদুগ্ধ আর নিরাপদ নয়”
আমাজনের গভীরে আজ অনেক আদিবাসী নারী সন্তান ধারণে ভয় পান। এক সময় জীবনদায়ী নদীগুলো এখন পারদে দূষিত। মুণ্ডুরুকু জনগোষ্ঠীর নেতা আলেসান্দ্রা কোরাপ হতাশ কণ্ঠে বলেন, “মাতৃদুগ্ধ আর বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
তিন বছর বয়সী রানি কেটলেন মাথা তুলতে পারে না, হাত ও পায়ের পেশি বারবার শক্ত হয়ে যায়। তার পরিবার বুঝতে পারছে না, কেন এই অবস্থা। এখন বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এর উত্তর লুকিয়ে আছে পারদের দূষণে।

মাছ খাও বা না খেয়ে মরো
রানির বাবা রোসিয়েলটন সাঁও বহু বছর ধরে গ্রামের কাছে সোনার খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর বাবা রোসেনিল্ডোও ছিলেন স্বর্ণখনি শ্রমিক। তারা জানেন পারদ বিপজ্জনক, কিন্তু প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ গ্রাম সোনা উত্তোলনই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস।
পরিবারটি নিয়মিত নদীর মাছ খায় — বিশেষ করে সুরুবিম নামের মাংসাশী মাছ, যা শরীরে প্রচুর পারদ জমায়। রানির খাওয়ার সমস্যা এত গুরুতর যে, সে মাছের ঝোল খেয়ে বেঁচে আছে।
সরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একই ধরনের অসুস্থতা অঞ্চলের অনেক মানুষের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধার অভাবে পূর্ণ চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি।
পারদের বিষে জীবন ও নদী
বিজ্ঞানীরা বলছেন, নদীর পাড়ে সোনা আলাদা করতে শ্রমিকরা পারদ ব্যবহার করে, যা পানিতে মিশে গিয়ে খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে। মাছের মাধ্যমে তা মানবদেহে প্রবেশ করছে। গর্ভবতী নারীদের প্লাসেন্টা, মাতৃদুগ্ধ ও নবজাতকের দেহে বিপজ্জনক মাত্রায় পারদ পাওয়া যাচ্ছে — যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত।
গ্রামের প্রধান ও নার্স জিলদোমার মুণ্ডুরুকু বলেন, “আমাদের মাছ না খেলে অনাহারে মরতে হবে। তাই নিয়ম মানলে পেট চলবে না।”
বন্ধ হলেও পারদ থাকবে দশকের পর দশক
সাই সিনজা থেকে বহু নিচে, টাপাজোস নদীর তীরে আগামী মাসে বিশ্বনেতারা জমায়েত হবেন কপ–৩০ জলবায়ু সম্মেলনে। ব্রাজিলের আয়োজকরা একে বলছে “ফরেস্ট কপ”— যেখানে অবৈধ খনন ও বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করা হবে।

রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা ক্ষমতায় ফিরে ২০২৩ সাল থেকে হাজারো খনি শ্রমিককে আদিবাসী ভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন — বাতাস, পানি ও মাটির চক্রে প্রবাহিত পারদ কখনও সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয় না।
ফিওক্রুজ গবেষক পাওলো বাস্তা বলেন, “আজই যদি সব খনন বন্ধ হয়, তবুও নদী ও মাটিতে থাকা পারদ আরও কয়েক দশক স্থায়ী হবে।”
সরকার এখন নিয়মিতভাবে পারদের মাত্রা পর্যবেক্ষণ, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দূরবর্তী গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির উৎস স্থাপন করছে। কিন্তু ক্ষতির গভীরতা এত বেশি যে তা এক প্রজন্মেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
মায়েদের দেহে পাঁচগুণ বেশি পারদ
গবেষকেরা এখন ১৭৬ জন গর্ভবতী নারীকে অনুসরণ করছেন — তাদের সন্তানদের জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রাথমিক তথ্য বলছে, মায়েদের দেহে পারদের মাত্রা নিরাপদ সীমার পাঁচগুণ, আর তাদের নবজাতকদের ক্ষেত্রে তিনগুণ।
২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিনটি মুণ্ডুরুকু গ্রামে পরীক্ষা করা ১৫ জন মায়ের মধ্যে ১০ জনের শরীরে পারদের মাত্রা স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ইয়ানোমামি গ্রামেও একই প্রবণতা — ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনের রক্তে বিপজ্জনক পারদের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
সরকারি ডাটাবেজে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত ৫৪৬টি আক্রান্ত কেসের অধিকাংশই বাস্তা ও তার দলের মাধ্যমে সংগৃহীত। তিনি বলেন, “এটা কেবল বরফখণ্ডের চূড়া মাত্র — মুণ্ডুরুকু, ইয়ানোমামি ও কায়াপো জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ পারদের ঝুঁকিতে আছেন।”
“এ যেন নিখুঁত অপরাধ, কোনো চিহ্ন নেই”
বর্তমান গবেষণায় বাস্তার দল সেই অনুপস্থিত যোগসূত্র খুঁজছেন — প্রমাণ করতে যে পারদই প্রতিবন্ধকতার মূল কারণ। কিন্তু এটি প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন।
সাঁও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট ফার্নান্দো কক বলেন, “যেসব রোগীর ক্ষেত্রে বংশগত কারণ নেই, সেখানে পারদই মূল সন্দেহভাজন। তবে একে একমাত্র কারণ বলা যায় না।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, মানুষের দেহে পারদের উপস্থিতি শুধু সাম্প্রতিক খাদ্যাভ্যাসের ছবি দেয় — এটি প্রমাণ করে না যে আগের কোনো সময়ের সংক্রমণই বর্তমান রোগের উৎস। “এটা এক নিখুঁত অপরাধ — কোনো স্বাক্ষর রাখে না,” বলেন কক।
ফিওক্রুজের নার্স ক্লেইডিয়ান কার্ভালহো বলেন, “এই রোগ খুঁজে না দেখলে ধরা পড়বে না। গবেষণাগুলো না থাকলে এই সংকট চিরতরে উপেক্ষিত থেকে যেত।”

এক অনন্ত মানবিক বিপর্যয়
আমাজনের স্বর্ণলোভ এখন এক দীর্ঘস্থায়ী মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। পারদের বিষ নদী, মাছ ও মাতৃদুগ্ধে রয়ে যাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। শিশুদের মুখে দুধের সঙ্গে ঢুকছে বিষের ছোঁয়া, আর তাদের দেহে জন্ম নিচ্ছে অদৃশ্য অক্ষমতা।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, এখনই যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শক্তভাবে এগিয়ে না আসে, তবে এই বিপর্যয়ের প্রভাব বহু দশক ধরে থাকবে — আমাজনের হৃদয়ে, আর সেই মুণ্ডুরুকু মাতাদের কোলের শিশুর জীবনে।
#আমাজন #স্বর্ণখনি #পারদদূষণ #আদিবাসী #স্বাস্থ্যসংকট #ব্রাজিল #COP30 #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















