০২:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ঈদে উৎসবের বদলে ভয় — রাজনৈতিক হয়রানিতে বিধ্বস্ত হাজারো পরিবার

নিস্তব্ধ এক ঈদ

ঢাকার মিরপুরের একতলা ভাড়া–ঘরে রওশন আরা গত কোরবানির ঈদে নতুন কাপড় কেনেননি। স্বামী কামাল উদ্দিন গত বছরের শেষ দিকে “তৃতীয় শক্তির” সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই পরিবারের আয় স্তব্ধ। মাংস প্রতিবেশীকে ভাগ দেওয়ার বদলে এ বছর তিনি নিজেই ভাতের পাশে এক টুকরো গরুর চর্বি দিয়ে ঈদ কাটিয়েছেন। রওশনদের গল্প অনন্য নয়—সারা দেশে কমপক্ষে ১০ হাজার ৫০৬টি রাজনৈতিক হয়রানি মামলার আসামি পরিবার (সরকারি হিসাব) একই রকম শূন্যতা আর আতঙ্ক নিয়ে এবারের ঈদ অতিক্রম করেছে।

রাজনৈতিক মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিবাস্তবে দোলা

অন্তর্বর্তী সরকারের আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথ­ভাবে ঘোষণা করেছে, ২০০৯-২০২৪ সময়কালে দায়ের করা “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি” মামলাগুলি পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে। জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠিত হলেও ঈদের আগ পর্যন্ত মাত্র অল্পসংখ্যক চার্জশিট বাতিল হয়েছে। ফলে বহু আসামি এখনো জামিনে বা পলাতক অবস্থায়; তাঁদের সন্তানদের স্কুলের ফি জমেছে ছয় মাসেরও বেশি। পরিস্থিতি সাময়িক স্বস্তি দিলেও যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য জেলে আছেন, তাদের ঈদ-আনন্দ দূরের বিষয়।

সমষ্টিগত চাপ: নিরাপত্তা বনাম ভয়

ঈদের আগে র‍্যাব ও পুলিশ বাড়তি টহল, ভাড়া-নিয়ন্ত্রণ ও ছিনতাই-রোধের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী—সব পথেই রাজনৈতিক পরিচয় যাচাইয়ের নামে তল্লাশি ও জেরার অভিযোগ উঠেছে। ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এক ঘণ্টার রাস্তা তিন ঘণ্টা লেগেছে; তিন-বার গাড়ি থামিয়ে এনআইডি চেক করেছে।’ নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি, এগুলো “রুটিন চেক”।

নারীর দ্বিগুণ বোঝা

রাজনৈতিক কর্মী কিংবা তাঁদের আত্মীয়েরা শুধু নয়—নারী সাংবাদিক, শিক্ষক ও উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে হয়রানির ঘটনা ঈদের আগে-পরেই বেড়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের দাবি। মে মাসের শেষে এক নারী কলেজ-শিক্ষক সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত দেওয়ায় হামলার মুখে পড়েন; ঈদের দিনও তিনি থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নোটিশ পান। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এটি ক্রমশ একটি ‘নতুন স্বীকৃত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি’ হয়ে উঠছে।

কোরবানির খরচ নয়মামলা-খরচ

রাজনৈতিক মামলায় জড়িয়ে থাকা পরিবারের মাসিক ব্যয়ের বড় অংশ এখন আইনি খরচে যায়। দিনমজুর আজিজুল হকের হিসাব, ‘দুই মাসে তিনটি হাজিরা, ৯ হাজার টাকা গেজেট নকল, আর ১২ হাজার টাকা আইনজীবীর পারিশ্রমিক।’ ঈদের গরুর বদলে তিনি ৯০০ টাকার একটি খাসি কিনেছিলেন, সেটিও বন্ধু-স্বজনের ধার-দেনায়।

শিশুদের ঈদ

গাজীপুরের বারোবাড়ি গ্রামে ১১-বছরের রাফি খেলনার বদলে থানা থেকে ফিরে-আসা বাবাকে পেয়ে ঈদই সেরেছে। কিন্তু বাবা-ছেলের প্রথম কথাই ছিল, ‘কবে আবার ডাকা হবে?’ মামলার মুচলেকার শর্ত অনুযায়ী তিনি গ্রামের বাইরে যেতে পারবেন না। রাজনৈতিক হয়রানি যে শিশুমনেও অনিশ্চয়তা ঢুকিয়ে দিয়েছে, তা স্পষ্ট।

স্বেচ্ছানির্বাসন ও বাড়ি-ফেরা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক (নাম গোপন) তিন বছর পরে প্রথমবার বাড়ি ফিরেও মসজিদের ঈদের নামাজে যেতে সাহস পাননি—নিজের দলীয় পরিচয়ের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এখনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। তিনি বলেছেন, ‘ঈদ মানে যেখানে ফিরে যাওয়া, সেখানে আমার জন্য ঈদ মানে চিরন্তন ফেরার নিষেধাজ্ঞা।’

ঐক্যের ছোট ইশারা

তবু কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও হয়েছে। কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের জন্য বিশেষ ঈদ-প্রার্থনা, স্বজনদের রান্না-করা খাবার পাঠানোর সুযোগ, আর তৃতীয় দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ। পরিবারের সদস্যরা এটিকে ‘এক ফোঁটা মিঠে জল’ বলে বর্ণনা করেছেন।

বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ

রাজনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুর রহমানের মতে, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার স্থায়ী সমাধান ছাড়া সামাজিক উৎসবগুলোও বৈষম্যের আয়নায় বন্দী থাকবে।’ ফ্রিডম হাউসের ২০২৫-এর রিপোর্টেও উল্লেখ আছে, সামাজিক নিপীড়ন, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও জমি দখল অব্যাহত থাকায় সামষ্টিক অধিকার সঙ্কুচিত হচ্ছে।

ঈদের পরে যে প্রশ্ন

কোরবানির পশুর ছাল শুকাবে, কিন্তু মামলার নোটিশ শুকোবে কবে? ঈদের আনন্দ যখন রাজনৈতিক ভীতিতে ম্লান হয়ে যায়, তখন স্পষ্ট হয় সমাজের গভীরে থাকা অবিশ্বাস। পরিবারের টানাপোড়েন শুধু অর্থনৈতিক নয়—সাংস্কৃতিক নিঃসঙ্গতারও। পুনর্মিলন, শুভেচ্ছা আর ত্যাগের উৎসব ঈদ যদি কাউকে ভয় পেরিয়ে আলোয় না আনে, তবে উৎসবের অন্তরায় যে রাজনীতি, তার সংস্কার এখনই জরুরি—না হলে আগামী ঈদের সকালেও হাজারো রওশন আরা একই প্রশ্ন উচ্চারণ করবেন, ‘এই ঈদেও কি মুক্তির খবর মিলবে না?’

 

ঈদে উৎসবের বদলে ভয় — রাজনৈতিক হয়রানিতে বিধ্বস্ত হাজারো পরিবার

০৭:১৩:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ জুন ২০২৫

নিস্তব্ধ এক ঈদ

ঢাকার মিরপুরের একতলা ভাড়া–ঘরে রওশন আরা গত কোরবানির ঈদে নতুন কাপড় কেনেননি। স্বামী কামাল উদ্দিন গত বছরের শেষ দিকে “তৃতীয় শক্তির” সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই পরিবারের আয় স্তব্ধ। মাংস প্রতিবেশীকে ভাগ দেওয়ার বদলে এ বছর তিনি নিজেই ভাতের পাশে এক টুকরো গরুর চর্বি দিয়ে ঈদ কাটিয়েছেন। রওশনদের গল্প অনন্য নয়—সারা দেশে কমপক্ষে ১০ হাজার ৫০৬টি রাজনৈতিক হয়রানি মামলার আসামি পরিবার (সরকারি হিসাব) একই রকম শূন্যতা আর আতঙ্ক নিয়ে এবারের ঈদ অতিক্রম করেছে।

রাজনৈতিক মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিবাস্তবে দোলা

অন্তর্বর্তী সরকারের আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথ­ভাবে ঘোষণা করেছে, ২০০৯-২০২৪ সময়কালে দায়ের করা “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি” মামলাগুলি পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে। জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠিত হলেও ঈদের আগ পর্যন্ত মাত্র অল্পসংখ্যক চার্জশিট বাতিল হয়েছে। ফলে বহু আসামি এখনো জামিনে বা পলাতক অবস্থায়; তাঁদের সন্তানদের স্কুলের ফি জমেছে ছয় মাসেরও বেশি। পরিস্থিতি সাময়িক স্বস্তি দিলেও যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য জেলে আছেন, তাদের ঈদ-আনন্দ দূরের বিষয়।

সমষ্টিগত চাপ: নিরাপত্তা বনাম ভয়

ঈদের আগে র‍্যাব ও পুলিশ বাড়তি টহল, ভাড়া-নিয়ন্ত্রণ ও ছিনতাই-রোধের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী—সব পথেই রাজনৈতিক পরিচয় যাচাইয়ের নামে তল্লাশি ও জেরার অভিযোগ উঠেছে। ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এক ঘণ্টার রাস্তা তিন ঘণ্টা লেগেছে; তিন-বার গাড়ি থামিয়ে এনআইডি চেক করেছে।’ নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি, এগুলো “রুটিন চেক”।

নারীর দ্বিগুণ বোঝা

রাজনৈতিক কর্মী কিংবা তাঁদের আত্মীয়েরা শুধু নয়—নারী সাংবাদিক, শিক্ষক ও উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে হয়রানির ঘটনা ঈদের আগে-পরেই বেড়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের দাবি। মে মাসের শেষে এক নারী কলেজ-শিক্ষক সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত দেওয়ায় হামলার মুখে পড়েন; ঈদের দিনও তিনি থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নোটিশ পান। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এটি ক্রমশ একটি ‘নতুন স্বীকৃত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি’ হয়ে উঠছে।

কোরবানির খরচ নয়মামলা-খরচ

রাজনৈতিক মামলায় জড়িয়ে থাকা পরিবারের মাসিক ব্যয়ের বড় অংশ এখন আইনি খরচে যায়। দিনমজুর আজিজুল হকের হিসাব, ‘দুই মাসে তিনটি হাজিরা, ৯ হাজার টাকা গেজেট নকল, আর ১২ হাজার টাকা আইনজীবীর পারিশ্রমিক।’ ঈদের গরুর বদলে তিনি ৯০০ টাকার একটি খাসি কিনেছিলেন, সেটিও বন্ধু-স্বজনের ধার-দেনায়।

শিশুদের ঈদ

গাজীপুরের বারোবাড়ি গ্রামে ১১-বছরের রাফি খেলনার বদলে থানা থেকে ফিরে-আসা বাবাকে পেয়ে ঈদই সেরেছে। কিন্তু বাবা-ছেলের প্রথম কথাই ছিল, ‘কবে আবার ডাকা হবে?’ মামলার মুচলেকার শর্ত অনুযায়ী তিনি গ্রামের বাইরে যেতে পারবেন না। রাজনৈতিক হয়রানি যে শিশুমনেও অনিশ্চয়তা ঢুকিয়ে দিয়েছে, তা স্পষ্ট।

স্বেচ্ছানির্বাসন ও বাড়ি-ফেরা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক (নাম গোপন) তিন বছর পরে প্রথমবার বাড়ি ফিরেও মসজিদের ঈদের নামাজে যেতে সাহস পাননি—নিজের দলীয় পরিচয়ের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এখনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। তিনি বলেছেন, ‘ঈদ মানে যেখানে ফিরে যাওয়া, সেখানে আমার জন্য ঈদ মানে চিরন্তন ফেরার নিষেধাজ্ঞা।’

ঐক্যের ছোট ইশারা

তবু কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও হয়েছে। কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের জন্য বিশেষ ঈদ-প্রার্থনা, স্বজনদের রান্না-করা খাবার পাঠানোর সুযোগ, আর তৃতীয় দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ। পরিবারের সদস্যরা এটিকে ‘এক ফোঁটা মিঠে জল’ বলে বর্ণনা করেছেন।

বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ

রাজনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুর রহমানের মতে, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার স্থায়ী সমাধান ছাড়া সামাজিক উৎসবগুলোও বৈষম্যের আয়নায় বন্দী থাকবে।’ ফ্রিডম হাউসের ২০২৫-এর রিপোর্টেও উল্লেখ আছে, সামাজিক নিপীড়ন, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও জমি দখল অব্যাহত থাকায় সামষ্টিক অধিকার সঙ্কুচিত হচ্ছে।

ঈদের পরে যে প্রশ্ন

কোরবানির পশুর ছাল শুকাবে, কিন্তু মামলার নোটিশ শুকোবে কবে? ঈদের আনন্দ যখন রাজনৈতিক ভীতিতে ম্লান হয়ে যায়, তখন স্পষ্ট হয় সমাজের গভীরে থাকা অবিশ্বাস। পরিবারের টানাপোড়েন শুধু অর্থনৈতিক নয়—সাংস্কৃতিক নিঃসঙ্গতারও। পুনর্মিলন, শুভেচ্ছা আর ত্যাগের উৎসব ঈদ যদি কাউকে ভয় পেরিয়ে আলোয় না আনে, তবে উৎসবের অন্তরায় যে রাজনীতি, তার সংস্কার এখনই জরুরি—না হলে আগামী ঈদের সকালেও হাজারো রওশন আরা একই প্রশ্ন উচ্চারণ করবেন, ‘এই ঈদেও কি মুক্তির খবর মিলবে না?’