ভাঙচুরের ঘটনার দিনলিপি
৮ জুন ঈদের ছুটির ভিড়ে পার্কিং ফি নিয়ে এক প্রবাসী দর্শনার্থী ও নিরাপত্তাকর্মীর বাগ্বিতণ্ডা থেকে পরিস্থিতি জটিল আকার নেয়। ঘটনার রেশ ধরে ১০ জুন দুপুরে স্থানীয়দের বিক্ষোভ মিছিল শেষে প্রায় ৫০-৬০ জনের একটি জঙ্গী দল রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি প্রাঙ্গণে ঢুকে অডিটোরিয়ামের দরজা-জানালা, কাস্টোডিয়ানের অফিস ও লাইব্রেরি ভাঙচুর করে; কয়েকজন কর্মী আহত হন। পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্রুত উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে, আর শাহজাদপুর থানায় অজ্ঞাতসহ ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
অনির্দিষ্টকালের জন্য দর্শনার্থী নিষেধাজ্ঞা
হামলার পরদিন ১১ জুন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কুঠিবাড়ি দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক জানান, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রবেশাধিকার স্থগিত থাকবে এবং নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
শাহজাদপুর কুঠিবাড়ির ইতিহাস
১৮৪০ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই জমিদারি কিনে নেন; এরপর রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারকির ফাঁকে এখানে বহুবার বাস করেন। ‘বিচারক’-এর অংশ, ‘সোনার তরী’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘গল্পগুচ্ছ’-সহ অসংখ্য কবিতা-গল্পের অনুপ্রেরণা মেলে এখানেই। পত্রিকায় ভাগনীর কাছে লেখা এক চিঠিতে কবি বলেছেন, “শাহজাদপুরে থাকলেই লেখার প্রেরণা পাই।” বর্তমানে প্রায় ৩০০টি নিদর্শন সংরক্ষিত আছে, যার মধ্যে কবির পালকিসহ ব্যবহৃত আসবাব রয়েছে।
রবীন্দ্র-স্মৃতিতে আঘাত: দেশের প্রতিক্রিয়া
খবর ছড়াতেই সংস্কৃতি অঙ্গন, শিক্ষাবিদ ও সাধারণ দর্শনার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্থানীয় প্রসাশন দোষীদের শাস্তি ও কুঠিবাড়ি সংস্কারে দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দাবি—এত বড় ঐতিহ্যভবনের নিরাপত্তা জোরদার না করা রাষ্ট্রের গাফিলতি; একই সঙ্গে জরুরি সংস্কার, সিসিটিভি ও পর্যাপ্ত গাইড নিয়োগের প্রস্তাব ওঠে।
সীমা পেরিয়ে প্রতিক্রিয়া: আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
১২ জুন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনাটিকে “সংস্কৃতির ওপর লজ্জাজনক আক্রমণ” আখ্যা দিয়ে কড়া নিন্দা জানায় এবং বাংলাদেশকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আহ্বান করে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে “বাঙালির সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক অহংকারে আঘাত” বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান। বিজেপি ও তৃণমূল দু’দলই এক কণ্ঠে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের চোখে ক্ষতি ও করণীয়
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, কুঠিবাড়ির মূল প্রাচীন কাঠামো অক্ষত থাকলেও অডিটোরিয়াম ও অফিসঘরের কাঠ-কাচ ভাঙচুর ভবিষ্যৎ প্রদর্শনীর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করেছে। জরুরি মেরামত, আর্সেনিক-নিরোধক কাঠ ব্যবহার, নিয়মিত আগুন-নিরাপত্তা মহড়া ও পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ইনভেনটরি তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। জাতীয় পর্যায়ের সংরক্ষণ প্রকল্পের পাশাপাশি ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ কর্মসূচিতে কুঠিবাড়ির আর্কাইভ অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও উঠেছে।
শাহজাদপুর কুঠিবাড়ি শুধু ইট-কাঠের স্মৃতিচিহ্ন নয়; এটি বাঙালি শুধু নয় পৃথিবীর অন্যতম সেরা দার্শনিক ও কবি রবীন্দ্রনাথের সৃজনক্ষেত্র, যেখানে পল্লির গন্ধ মিশে আছে কবির কলমে। এক মুহূর্তের উচ্ছৃঙ্খলতায় যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষত মেরামত করা সম্ভব, কিন্তু ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার রক্ষা করতে হলে দরকার দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা, আর জনগণের সচেতনতা। ওই দায়ভার সরকার-প্রশাসনের যেমন, তেমনি আমাদেরও—যাঁরা রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন মানবতাবাদকে নিজেদের সংস্কৃতির শিকড় মনে করি।