দুই দশকের শিক্ষায় অবকাঠামোগত অগ্রগতি, মানে ধস
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিদ্যালয়ভিত্তিক অবকাঠামো ও ভর্তির হার বেড়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক একাধিক সিদ্ধান্ত—বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ের স্কুল-বন্ধে দশা, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা এবং টানা দুটি ‘অটোপাস’—মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জ্ঞানগত শূন্যতা তৈরি করেছে। ইউনিসেফের যৌথ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মহামারির দীর্ঘ ১৮ মাসের স্কুল-বন্ধে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। দূরশিক্ষায় অংশ নিতে পেরেছিল পাঁচ ভাগের একভাগ কম—মাত্র ১৮.৭ শতাংশ শিশু।
কোভিড-১৯: শিক্ষা-ঘাটতি ও ডিজিটাল বিভাজন
লকডাউনের সময়ে অনলাইন ক্লাস, টিভি পাঠ ও রেডিওকেন্দ্রিক পাঠের চেষ্টা হলেও গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ১৫.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো ধরনের দূরশিক্ষায় যুক্ত হতে পেরেছিল। নিম্নমানের ইন্টারনেট, ডিভাইসের অভাব এবং বিদ্যুৎব্যাঘাত ‘ডিজিটাল ডিভাইড’কে তীব্র করেছে; উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থী মৌলিক গণিত, ইংরেজি ও বাংলা দক্ষতা হারিয়েছে বলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খোদ ক্লাসরুমে টের পাচ্ছেন।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও অটোপাস: ভিত্তির ফাঁক
২০২০ সালে প্রথম অটোপাস এবং ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে—বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নে। পরে ২০২৪-এর জুলাই ছাত্র আন্দোলনের মুখে পরীক্ষার বাকি অংশ বাতিল করে তৎকালীন সরকার; শিক্ষার্থীদের ফল ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’-এর মাধ্যমে ঘোষণা করে। ফল প্রকাশের পরে ‘অটোপাস’কে স্থায়ী দাবি হিসেবে তুলতে থাকে একাংশ শিক্ষার্থী; শিক্ষা-বিশেষজ্ঞরা একে ‘ভবিষ্যৎ-ঘাতী’ সিদ্ধান্ত বলে সতর্ক করেন।
জুলাই আন্দোলন: পরীক্ষাহীন উত্তীর্ণের সামাজিক অভিঘাত
শুধু পরীক্ষাক্ষেত্রেই নয়, ২০২৪-এর ছাত্রসহিংসতা রাষ্ট্রীয় শাসনে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে—‘জুলাই বিপ্লব’ নামে সেই আন্দোলন পাঁচ মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। অন্তর্বর্তী সরকার সাময়িক স্থিতি আনলেও, পরীক্ষাহীন উত্তীর্ণরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরির বাজার ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার দরজায় আত্মবিশ্বাসের সংকট বয়ে বেড়াচ্ছে।
ফল না মান—কোথায় মাদ্রাসা শিক্ষা
২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৭৭.৭৮ শতাংশ হলেও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এককভাবে ৯৩.৪০ শতাংশ পাস দেখিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার মধ্যকার মানগত বৈষম্য, ইংরেজি ও বিজ্ঞান দক্ষতার ঘাটতি এবং কর্মবাজার-বিমুখ পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের সমকালীন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে।
শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য: আত্মবিশ্বাসহীনতা ও দক্ষতার ঘাটতি
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা বলছে, ‘অটোপাস ব্যাচ’-এর শিক্ষার্থীরা মৌলিক ধারণায় দুর্বল, প্রশ্নোত্তরে চটজলদি সাড়া দিতে পারে না, আর চাকরির লিখিত পরীক্ষায় গড়পড়তা ফল করছে। মাদ্রাসাপড়ুয়া অনেকেই আরবি পাঠে পারদর্শী হলেও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা ইংরেজি দক্ষতায় পিছিয়ে থাকায় শ্রমবাজারে বেতন-ব্যবধান তৈরি হচ্ছে।
অর্থায়ন ও পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা
শিক্ষা-ঘাটতি কাটাতে বিশ্বব্যাংকের ৩০০ মিলিয়ন ডলারের ‘লার্নিং অ্যাকসেলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন’ (LAISE) কর্মসূচি অনুমোদিত হয়েছে। এর লক্ষ্য ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে গণিতে দক্ষ এবং ৯০ শতাংশকে বাংলায় প্রভূত পারদর্শী করা। সরকার ৫,০০০ স্কুলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি এবং ৮০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু করছে।
কী করতে হবে
- স্থায়ী প্রভাব যাচাইয়ে দ্রুত জাতীয় ‘লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট’ চালু করা
- মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে পূর্ণ সিলেবাসে ফেরা, সাপোর্ট ক্লাস, রিমেডিয়াল প্রোগ্রাম ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ জোরদার করা
- মাদ্রাসা কারিকুলাম আধুনিকীকরণ; বিজ্ঞান ও আইসিটি বাধ্যতামূলক করা
- ডিজিটাল ডিভাইড কমাতে দূরবর্তী এলাকায় স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ও ডিভাইস সরবরাহ
- ভবিষ্যতে কোনো দুর্যোগে পরীক্ষা বাতিলের বদলে প্রক্টরড অনলাইন পরীক্ষা অথবা সীমিত কেন্দ্রে মূল্যায়ন চালু করে শিক্ষার্থীদের সনদসংকট এড়ানো
শিক্ষাবিদদের মতে, ‘অটোপাস-প্রজন্ম’ শুধু একটি ব্যাচের সমস্যা নয়; এটি দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকেও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এখনই শিক্ষা-ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা না নিলে, এই ধস মোকাবিলার ভবিষ্যৎ ব্যয় হবে বহুগুণ।