০৬:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
২০২৫ সালের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আইসল্যান্ড, শীর্ষ দশে সিঙ্গাপুর নৌকার বাংলাদেশ: জেলা-জেলা ঘিরে এক ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বা পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কী? কীভাবে এটি করা হয়? নেতানিয়াহুর বিচার বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ইরানে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের হামলা শেষ হয়েছে- মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শহরে টিসিবির সহায়তা, নিত্যপণ্যের সংকটে উপেক্ষিত গ্রাম আইনি সংস্কার ও দ্রুত বিচারের আহ্বান ব্লাস্টের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অভিনন্দন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের যান্ত্রিক কৃষির যুগে বাংলাদেশ: মাঠে গরু নয়, চলছে মেশিন আগাম বর্ষণে ফল ও সবজি চাষে মিশ্র প্রভাব, বিপাকে কৃষকরা

সাপের ছোবলে মৃত্যু: বর্ষা নামলেই আতঙ্ক বাড়ে, বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা ?

বর্ষা ও আতঙ্ক
বর্ষাকাল বাংলাদেশের প্রকৃতির জন্য যেমন সৌন্দর্যের বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি গ্রামবাংলার মানুষের জন্য নিয়ে আসে এক ভিন্নধর্মী আতঙ্ক—সাপের কামড়। ফসলি জমিতে কাজ করতে গিয়ে, কিংবা রাতের আঁধারে খাট থেকে নামতে গিয়ে, এমনকি ঘরের কোণে পানি জমে থাকা জায়গায়ও সাপের হঠাৎ ছোবলে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। প্রতিবছর বর্ষা নামার পরই এ ধরনের মৃত্যুর খবর যেন নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নীরব এক বিপদ: সাপের কামড়
বাংলাদেশে সাপের কামড় কোনো নতুন ঘটনা নয়। এটি বহুদিন ধরেই জনস্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট হয়ে রয়েছে। অথচ এখনো তা যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাপের কামড় অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য এবং সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে অধিকাংশ মৃত্যুই এড়ানো সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আমাদের প্রস্তুতির জায়গাটা এখনো অনেকটাই দুর্বল।

বাংলাদেশে সাপের বৈচিত্র্য
দেশের জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতি সাপের বিচরণের জন্য খুবই উপযোগী। তাই বাংলাদেশে সাপের প্রজাতিও বৈচিত্র্যময়। পরিবেশ ও বন অধিদপ্তর এবং বন্যপ্রাণ গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৮০ থেকে ১০৮টি সাপের প্রজাতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৭টি প্রজাতি অত্যন্ত বিষধর, যেগুলোর কামড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

এই সাপগুলো প্রধানত তিনটি আবাসস্থলে বসবাস করে—ভূমিতে, জলে এবং বনভূমিতে। ভূমিতে বসবাসকারী সাপগুলোর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাধারণত চাষের জমি, খোলা জায়গা এবং বসতবাড়ির আশপাশে দেখা যাওয়া প্রজাতিগুলো। জলজ বা সামুদ্রিক অঞ্চলে বাস করা সাপও রয়েছে, যাদের অধিকাংশই বিষধর। বনাঞ্চলে বাস করা সাপের মধ্যে পাইথনের মতো বড় আকারের অবিষধর সাপ রয়েছে, তবে সেখানেও বিষধর সাপের অস্তিত্ব আছে।

বাংলাদেশে চারটি বিষধর সাপ সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়ায়—গোখরো, কালাচ, চন্দ্রবোড়া এবং স’ স্কেল্ড ভাইপার। দক্ষিণ এশিয়ায় এদের “বিগ ফোর” বলা হয়। এই চার প্রজাতিই বিষাক্ত সাপের কামড়ের ৯০ শতাংশ ঘটনার জন্য দায়ী।

প্রতিবছর কত মানুষ মারা যায়?
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণাগুলোর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। এর মধ্যে সাত হাজার পাঁচশ থেকে আট হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ মারা যান শুধুমাত্র সাপের কামড়ে।

এমন নয় যে এই মৃত্যুগুলো প্রতিরোধযোগ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা এবং জনসচেতনতা থাকলে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু দেশে এসবের অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে সাপের কামড় একটি প্রতিরোধযোগ্য মহামারির রূপ নিচ্ছে।

বর্ষা এলেই বাড়ে বিপদ
সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর—এই সময়টি বর্ষার মৌসুম। আর এই সময়েই সাপের কামড়ের হার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কেন?

বর্ষায় অতিবৃষ্টির কারণে সাপের স্বাভাবিক বাসস্থান যেমন গর্ত বা নিচু জায়গা প্লাবিত হয়। তখন সাপেরা আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের ঘরবাড়ি, খামার কিংবা উঁচু জমির দিকে চলে আসে। অন্যদিকে, এই সময়টাতে ইঁদুর ও অন্যান্য খাদ্যসন্ধানী প্রাণীও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ির কাছাকাছি আসে। ইঁদুরের গন্ধ পেয়ে সাপও এগিয়ে আসে। ফলে বাড়ে সাপ-মানুষের সংঘর্ষ।

কৃষকরা এই সময়টাতে বেশি সময় মাঠে থাকেন। ধান রোপণ, পরিচর্যা কিংবা সেচের কাজে তাঁরা প্রায়শই খালি পায়ে জমিতে হাঁটেন। অন্ধকারে, কাদা ও জলমগ্ন জমিতে বিষধর সাপের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না, ফলে হঠাৎ কামড় ঘটে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই রাতে ঘুমানোর সময়, মাটির মেঝেতে ঘুমানো মানুষের শরীরেও হামলা করে সাপ।

সম্প্রতি চন্দ্রবোড়া সাপের বিস্তার ২৭টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং ২০২৩-২৪ মৌসুমে এই একটি প্রজাতির কামড়েই অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাপের বিস্তার ও কামড়ের হার দেখে বোঝা যায়, বিষয়টি স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংকট।

চিকিৎসার বাস্তবতা
সাপের কামড়ের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অ্যান্টিভেনম এবং দ্রুত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে পৌঁছানো। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে এখনো পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত নেই। কিছু কিছু উপজেলায় অ্যান্টিভেনম থাকলেও তা অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ বা সংরক্ষণের উপযোগী নয়।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার অভাব। অনেক ডাক্তারই জানেন না কীভাবে সাপের কামড়ের চিকিৎসা করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই ভুল চিকিৎসায় রোগীর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল। সাপের কামড়ের পর দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ ঝুঁকে পড়েন তান্ত্রিক বা কুসংস্কারভিত্তিক চিকিৎসার দিকে, যা মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়ায়।

সরকারের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে সাপের কামড়কে “নোটিফায়েবল ডিজিজ” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার—যেমন প্লেগ বা কলেরা। এর ফলে প্রতিটি ঘটনা বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে রিপোর্ট করতে হবে, যার মাধ্যমে সাপের কামড়ের প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হবে।

এছাড়া অ্যান্টিভেনম সরবরাহ, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ এবং সাপ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার অভিযানও চালানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও ভুয়া চিকিৎসার তথ্য প্রতিরোধেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগ এখনও পর্যাপ্ত নয়। সরকারি পরিকল্পনায় অনেক ঘাটতি আছে। যদি প্রতিটি জেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম মজুদ রাখা, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক নিয়োগ এবং জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে এই বিপদ মোকাবিলা সম্ভব নয়।

প্রতিরোধমূলক করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু সাধারণ পদক্ষেপ নিলে সাপের কামড়ের হার ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। যেমন:

  • খালি পায়ে না হেঁটে জুতা পরা,বিশেষ করে কৃষকদের ক্ষেতখামারে কাজ করার সময়।
    • মাটির মেঝেতে না ঘুমিয়ে উঁচু খাটে ঘুমানো।
    • শস্য, চালডাল বাড়ির ভিতর না রেখে নির্দিষ্ট গুদামে রাখা।
    • সন্ধ্যার পর আলো জ্বালিয়ে চলাফেরা করা।
    • সাপ দেখা গেলে না মেরে সাপ উদ্ধারকারীদের খবর দেওয়া।
    • স্কুল-কলেজে সাপ বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা।

সাপের কামড় বাংলাদেশের জন্য একটি নীরব ও অতি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সংকট। প্রতিবছর হাজারো মানুষ এই বিপদের মুখোমুখি হন—অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য বিপদ। কিন্তু এখনো সরকারি ও বেসরকারি স্তরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও কার্যকর উদ্যোগ নেই।

সাপকে ভয় নয়, বরং বুঝে, চিনে এবং বিবেচনার মাধ্যমে মোকাবিলা করলেই আমরা এই বিপদকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি। এবং সেজন্য দরকার সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। সাপ আমাদের প্রকৃতির অংশ—তাদের বাঁচিয়ে রেখে, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।

২০২৫ সালের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আইসল্যান্ড, শীর্ষ দশে সিঙ্গাপুর

সাপের ছোবলে মৃত্যু: বর্ষা নামলেই আতঙ্ক বাড়ে, বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা ?

০৪:০৯:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

বর্ষা ও আতঙ্ক
বর্ষাকাল বাংলাদেশের প্রকৃতির জন্য যেমন সৌন্দর্যের বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি গ্রামবাংলার মানুষের জন্য নিয়ে আসে এক ভিন্নধর্মী আতঙ্ক—সাপের কামড়। ফসলি জমিতে কাজ করতে গিয়ে, কিংবা রাতের আঁধারে খাট থেকে নামতে গিয়ে, এমনকি ঘরের কোণে পানি জমে থাকা জায়গায়ও সাপের হঠাৎ ছোবলে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। প্রতিবছর বর্ষা নামার পরই এ ধরনের মৃত্যুর খবর যেন নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নীরব এক বিপদ: সাপের কামড়
বাংলাদেশে সাপের কামড় কোনো নতুন ঘটনা নয়। এটি বহুদিন ধরেই জনস্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট হয়ে রয়েছে। অথচ এখনো তা যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাপের কামড় অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য এবং সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে অধিকাংশ মৃত্যুই এড়ানো সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আমাদের প্রস্তুতির জায়গাটা এখনো অনেকটাই দুর্বল।

বাংলাদেশে সাপের বৈচিত্র্য
দেশের জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতি সাপের বিচরণের জন্য খুবই উপযোগী। তাই বাংলাদেশে সাপের প্রজাতিও বৈচিত্র্যময়। পরিবেশ ও বন অধিদপ্তর এবং বন্যপ্রাণ গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৮০ থেকে ১০৮টি সাপের প্রজাতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৭টি প্রজাতি অত্যন্ত বিষধর, যেগুলোর কামড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

এই সাপগুলো প্রধানত তিনটি আবাসস্থলে বসবাস করে—ভূমিতে, জলে এবং বনভূমিতে। ভূমিতে বসবাসকারী সাপগুলোর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাধারণত চাষের জমি, খোলা জায়গা এবং বসতবাড়ির আশপাশে দেখা যাওয়া প্রজাতিগুলো। জলজ বা সামুদ্রিক অঞ্চলে বাস করা সাপও রয়েছে, যাদের অধিকাংশই বিষধর। বনাঞ্চলে বাস করা সাপের মধ্যে পাইথনের মতো বড় আকারের অবিষধর সাপ রয়েছে, তবে সেখানেও বিষধর সাপের অস্তিত্ব আছে।

বাংলাদেশে চারটি বিষধর সাপ সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়ায়—গোখরো, কালাচ, চন্দ্রবোড়া এবং স’ স্কেল্ড ভাইপার। দক্ষিণ এশিয়ায় এদের “বিগ ফোর” বলা হয়। এই চার প্রজাতিই বিষাক্ত সাপের কামড়ের ৯০ শতাংশ ঘটনার জন্য দায়ী।

প্রতিবছর কত মানুষ মারা যায়?
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণাগুলোর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। এর মধ্যে সাত হাজার পাঁচশ থেকে আট হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ মারা যান শুধুমাত্র সাপের কামড়ে।

এমন নয় যে এই মৃত্যুগুলো প্রতিরোধযোগ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা এবং জনসচেতনতা থাকলে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু দেশে এসবের অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে সাপের কামড় একটি প্রতিরোধযোগ্য মহামারির রূপ নিচ্ছে।

বর্ষা এলেই বাড়ে বিপদ
সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর—এই সময়টি বর্ষার মৌসুম। আর এই সময়েই সাপের কামড়ের হার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কেন?

বর্ষায় অতিবৃষ্টির কারণে সাপের স্বাভাবিক বাসস্থান যেমন গর্ত বা নিচু জায়গা প্লাবিত হয়। তখন সাপেরা আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের ঘরবাড়ি, খামার কিংবা উঁচু জমির দিকে চলে আসে। অন্যদিকে, এই সময়টাতে ইঁদুর ও অন্যান্য খাদ্যসন্ধানী প্রাণীও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ির কাছাকাছি আসে। ইঁদুরের গন্ধ পেয়ে সাপও এগিয়ে আসে। ফলে বাড়ে সাপ-মানুষের সংঘর্ষ।

কৃষকরা এই সময়টাতে বেশি সময় মাঠে থাকেন। ধান রোপণ, পরিচর্যা কিংবা সেচের কাজে তাঁরা প্রায়শই খালি পায়ে জমিতে হাঁটেন। অন্ধকারে, কাদা ও জলমগ্ন জমিতে বিষধর সাপের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না, ফলে হঠাৎ কামড় ঘটে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই রাতে ঘুমানোর সময়, মাটির মেঝেতে ঘুমানো মানুষের শরীরেও হামলা করে সাপ।

সম্প্রতি চন্দ্রবোড়া সাপের বিস্তার ২৭টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং ২০২৩-২৪ মৌসুমে এই একটি প্রজাতির কামড়েই অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাপের বিস্তার ও কামড়ের হার দেখে বোঝা যায়, বিষয়টি স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংকট।

চিকিৎসার বাস্তবতা
সাপের কামড়ের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অ্যান্টিভেনম এবং দ্রুত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে পৌঁছানো। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে এখনো পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত নেই। কিছু কিছু উপজেলায় অ্যান্টিভেনম থাকলেও তা অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ বা সংরক্ষণের উপযোগী নয়।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার অভাব। অনেক ডাক্তারই জানেন না কীভাবে সাপের কামড়ের চিকিৎসা করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই ভুল চিকিৎসায় রোগীর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল। সাপের কামড়ের পর দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ ঝুঁকে পড়েন তান্ত্রিক বা কুসংস্কারভিত্তিক চিকিৎসার দিকে, যা মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়ায়।

সরকারের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে সাপের কামড়কে “নোটিফায়েবল ডিজিজ” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার—যেমন প্লেগ বা কলেরা। এর ফলে প্রতিটি ঘটনা বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে রিপোর্ট করতে হবে, যার মাধ্যমে সাপের কামড়ের প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হবে।

এছাড়া অ্যান্টিভেনম সরবরাহ, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ এবং সাপ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার অভিযানও চালানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও ভুয়া চিকিৎসার তথ্য প্রতিরোধেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগ এখনও পর্যাপ্ত নয়। সরকারি পরিকল্পনায় অনেক ঘাটতি আছে। যদি প্রতিটি জেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম মজুদ রাখা, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক নিয়োগ এবং জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে এই বিপদ মোকাবিলা সম্ভব নয়।

প্রতিরোধমূলক করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু সাধারণ পদক্ষেপ নিলে সাপের কামড়ের হার ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। যেমন:

  • খালি পায়ে না হেঁটে জুতা পরা,বিশেষ করে কৃষকদের ক্ষেতখামারে কাজ করার সময়।
    • মাটির মেঝেতে না ঘুমিয়ে উঁচু খাটে ঘুমানো।
    • শস্য, চালডাল বাড়ির ভিতর না রেখে নির্দিষ্ট গুদামে রাখা।
    • সন্ধ্যার পর আলো জ্বালিয়ে চলাফেরা করা।
    • সাপ দেখা গেলে না মেরে সাপ উদ্ধারকারীদের খবর দেওয়া।
    • স্কুল-কলেজে সাপ বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা।

সাপের কামড় বাংলাদেশের জন্য একটি নীরব ও অতি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সংকট। প্রতিবছর হাজারো মানুষ এই বিপদের মুখোমুখি হন—অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য বিপদ। কিন্তু এখনো সরকারি ও বেসরকারি স্তরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও কার্যকর উদ্যোগ নেই।

সাপকে ভয় নয়, বরং বুঝে, চিনে এবং বিবেচনার মাধ্যমে মোকাবিলা করলেই আমরা এই বিপদকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি। এবং সেজন্য দরকার সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। সাপ আমাদের প্রকৃতির অংশ—তাদের বাঁচিয়ে রেখে, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।