ধর্ষণ সমাজে কেবল একটি শারীরিক অপরাধ নয়—এটি মানসিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। ধর্ষণের শিকার অনেক নারী বা শিশু আদালত বা প্রশাসনের কাছে ন্যায়বিচারের জন্য যেতে চান না। কেন? এর পেছনে একাধিক জটিল, গভীর এবং আন্তঃসংযুক্ত কারণ আছে।
সামাজিক অপমান এবং কলঙ্কের ভয়
সমাজে এখনও ধর্ষণের শিকারকে অনেক সময় দোষারোপ করা হয়। পরিবারের মানসম্মান নষ্ট হবে এই ভয়ে অনেক পরিবার মামলা করতে চায় না। অনেকেই ভাবে, “সমাজে মুখ দেখানো যাবে না”। এই অপমানের ভয়েই ভুক্তভোগী নীরব থেকে যায়।
বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা
বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ। একটি ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। এই সময়ে আদালতে বারবার হাজিরা, একই ঘটনার বর্ণনা দিতে দিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া—সব মিলিয়ে এটি অনেক বড় মানসিক চাপ। তাই অনেকে মামলা না করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়াই সহজ মনে করে।
হুমকি ও প্রভাবশালী অপরাধীর ভয়
অনেক ধর্ষণকারী স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী, ধনী, রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। অভিযোগ তুললে উল্টো মামলার ভয়, হামলা, হত্যার হুমকি আসে। পরিবারকে নির্যাতন করা হতে পারে। এই ঝুঁকি এড়াতে অনেকেই নীরব থাকে।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা
মামলা করতে টাকা লাগে—আইনজীবীর ফি, যাতায়াত খরচ, সাক্ষীর খরচ, নথি তৈরি। দরিদ্র পরিবারগুলো এই খরচ বহন করতে পারে না। তারা ভাবে—ন্যায়বিচার চাওয়াই বৃথা।
পারিবারিক বা সামাজিক চাপ
অনেক পরিবার নিজেরা মীমাংসা করতে চায় বা “মেয়ের ভবিষ্যৎ” এর কথা ভেবে মামলা না করতে বলে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সালিশ বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে ন্যায়বিচারকে বিকৃত করে সমঝোতা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
মানসিক ট্রমা ও লজ্জা
ধর্ষণের পর শিকার মারাত্মক মানসিক আঘাতের শিকার হয়। লজ্জা, আতঙ্ক, দুঃস্বপ্ন, আত্মঘৃণা সব মিলে তাকে একেবারে ভেঙে ফেলে। অনেকেই এই মানসিক অবস্থায় কোনো অভিযোগ দিতেই পারে না।
বিশ্বাসের অভাব
অনেকে মনে করেন—অভিযোগ দিলেও কিছু হবে না। অপরাধী শাস্তি পাবে না। পুলিশ-প্রশাসন-আদালত কারো উপরই তাদের বিশ্বাস নেই। এই হতাশা ন্যায়বিচার চাওয়ার ইচ্ছাকেই মেরে ফেলে।
এভাবে দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা আদালত বা প্রশাসনের কাছে না যাওয়ার পেছনে শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং কাঠামোগত অনেক বাধা রয়েছে। এই সমস্যাগুলো দূর করতে হলে দরকার—
- বিচার প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করা
- ভুক্তভোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা
- আর্থিক ও আইনি সহায়তা দেওয়া
- সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
শুধু আইন করে নয়, এই বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থাকেও পরিবর্তন করতে হবে যাতে ধর্ষণের শিকারদের ন্যায়বিচার চাওয়া লজ্জার নয়, স্বাভাবিক ও সহজ একটি কাজ হয়ে দাঁড়ায়।