কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলে গড়িয়াহাট মানেই এক অনন্য বাজার সংস্কৃতি—সস্তা স্ট্রিট শপিং থেকে শুরু করে অভিজাত ব্র্যান্ড শোরুম পর্যন্ত সবকিছুর মিলনমেলা। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে প্রবল বর্ষণ আর জলাবদ্ধতা সেই রঙিন বাজারের আবহটাই পাল্টে দিয়েছে। গড়িয়াহাট পুজো বাজার—যেখানে উৎসাহ, কেনাবেচা, মিটার-দীর্ঘ রোড শপিং, হকারদের চাটি আর ক্রেতাদের গুড়গুড়ি মিলেমিশে এক প্রাণোচ্ছল পরিবেশ তৈরি করে—সেখানে এবার বৃষ্টির থাবা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রাকৃতিক বাধা ও তার প্রভাব

জলাবদ্ধতা ও নিষ্কাশন বিঘ্ন
এক ভয়াবহ “ক্লাউডবার্স্ট” আছড়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন অংশে, বিশেষত গড়িয়াহাট ও আশপাশের এলাকায়। এর ফলে বাজারের গলিপথ, ফুটপাত ও রাস্তার নিম্নভূমি এলাকায় পানি জমে যায়। ক্রেতারা বাধ্য হয়ে উঁচু পথ খুঁজে চলাচল করেছেন।
ম্যান্ডেভিল গার্ডেন এলাকায় এক দোকানে আগুন ধরে যায়, যেখানে আশপাশের সড়কও তখন পানিতে নিমজ্জিত ছিল। জলমগ্ন রাস্তায় ড্রেন পরিষ্কারের ঘাটতি পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। কলকাতা পুরনিগম ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি পাম্প চালু রেখেছে এবং দক্ষিণ কলকাতার নিম্নাঞ্চলে বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছে।
বিদ্যুৎ, অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা
গড়িয়াহাট এলাকায় আগুন লাগার খবর বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বৃষ্টিতে ভিজে থাকা অংশে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি বেড়েছে। ম্যান্ডেভিল গার্ডেনে এক শপে আগুন লাগার সময় চৌরাস্তার জলাবদ্ধ অংশ আতঙ্ক তৈরি করে। এমনকি জলমগ্ন এলাকা থেকে এক ব্যক্তির মরদেহও উদ্ধার হয়। স্থানীয়দের ধারণা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অথবা পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় বাজার–শহর–উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
ব্যবসা ও বিক্রেতাদের অবস্থা

হকারদের দুঃখ—উত্তেজনা ও ঝুঁকি
হকাররা, যারা ফাঁকা রাস্তায় পোশাক, সাজসজ্জা কিংবা পুজোর সামগ্রী সাজিয়ে রাখতেন, তারা এবার প্লাস্টিক শীট আর অস্থায়ী ঢাল ব্যবহার করে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অনেক জায়গায় আইনগত চাপের মুখে ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসা চালাচ্ছেন। জলমুক্ত জায়গা কম থাকায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে। দোকানদাররা বলছেন, নতুন স্টক আনতে ভয় পাচ্ছেন—কারণ সামান্য বৃষ্টিতেই পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ক্রেতা-আনা ও বিক্রয় পরিমাণ
প্রবল বর্ষণের কারণে অনেক ক্রেতাই বাজারে আসার পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। গড়িয়াহাটসহ অন্যান্য বাজারে ক্রেতার সংখ্যা একেবারে কমে গেছে। বিকেলের দিকেই কিছু মানুষ সীমিত পরিসরে কেনাকাটা করতে বের হচ্ছেন, যাতে আবার বৃষ্টিতে আটকা না পড়েন। বিক্রেতাদের অভিযোগ, বিক্রি যেমন কমছে, খরচ তেমনই বাড়ছে—পানি দূষণ, শুকানোর খরচ, পণ্যের ক্ষতি সব মিলিয়ে চাপ বেড়েই চলেছে।
অভ্যন্তরীণ সংকট : বাজারের গড় থেকে পতন
দোকান-শাটার ও মন্দ অবস্থা
ভারী বৃষ্টির কারণে অনেক দোকান কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হয়েছে। শপিং শোরুম ও প্রবেশপথ আগের মতো আকর্ষণীয় ও সহজ আর থাকেনি। ভাঙাচোরা রাস্তা আর পানির স্তর গ্রাহকদের প্রবেশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধ
বাজার প্রশাসন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার, পাম্প ব্যবহারের মাধ্যমে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। বিক্রেতারা বিকল্প পরিকল্পনা করছেন—কেনাবেচার সময় পরিবর্তন, দ্রুত পণ্য বিক্রি কিংবা শুকানোর বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করছেন। গ্রাহকরাও ছাতা, জলরোধী ব্যাগ আর দ্রুত কেনাকাটার মানসিকতা নিয়ে বাজারে আসছেন।
কিছু দৃষ্টান্ত
- • ম্যান্ডেভিল গার্ডেনের আগুন — দমকল একাধিক দফায় আগুন নেভাতে কাজ করেছে, কিন্তু আশপাশ তখনও জলমগ্ন ছিল।
- • গড়িয়াহাটে মরদেহ — পানির গভীরতা কমতেই এক ব্যক্তি মৃত অবস্থায় উদ্ধার হন, তদন্ত চলছে।
- • বিক্রেতাদের হতাশা — “নতুন স্টক সব ভিজে গেল”, “ক্রেতা নেই”, “ছুটির বিক্রি মাটি”—এমন আক্ষেপ শোনা গেছে প্রায় প্রতিটি দোকানে।
গড়িয়াহাট পুজো বাজার, যা একসময় উৎসবের আনন্দ আর বাণিজ্যের উচ্ছ্বাসে ভরে থাকত, এবার প্রবল বৃষ্টির চাপে বিপর্যস্ত। তবু প্রতিকূলতার মাঝেই মানুষ খুঁজছে নতুন পথ—কেউ অভিযোজন করছে, কেউ নতুন কৌশল নিচ্ছে। পুজোর আনন্দ, বাজারের ধুকপুক, মানুষের আশা—সবই আজ বৃষ্টির ছত্রছায়ায় টিকে থাকার সংগ্রামে রূপ নিয়েছে।
সৌগত দত্ত, কোলকাতা থেকে 



















